২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

লাহোর প্রস্তাব ও বেকার হোস্টেল

-

আমরা ছাত্র ছিলাম, দেশকে ভালোবাসতাম, দেশের জন্য কাজ করতাম, এই সকল জঘন্য নীচতা এই প্রথম দেখলাম, পরে যদিও অনেক দেখেছি, কিন্তু এই প্রথমবার। এই সমস্ত খান বাহাদুরদের দ্বারা পাকিস্তান আসবে, দেশ স্বাধীন হবে, ইংরেজকে তাড়ানোও যাবে, বিশ্বাস করতে কেন যেন কষ্ট হতো! মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠান পূর্বে ছিল খান সাহেব, খান বাহাদুর ও ব্রিটিশ খেতাবধারীদের হাতে, আর এদের সাথে ছিল জমিদার, জোতদার শ্রেণীর লোকেরা এদের দ্বারা কোনো দিন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হতো না। শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেব যদি বাংলার যুবক ও ছাত্রদের মধ্যে মুসলিম লীগকে জনপ্রিয় না করতে পারতেন এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে টেনে আনতে না পারতেন, তাহলে কোনো দিনও পাকিস্তান আন্দোলন বাংলার কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারত না। যদিও এই সমস্ত নেতাদের আমরা একটু বাধা দিতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করতে পারি নাই। যার ফলে পাকিস্তান হওয়ার সাথে সাথেই এই খান বাহাদুর ও ব্রিটিশ খেতাবধারীরা তৎপর হয়ে উঠে ক্ষমতা দখল করে ফেলল। কি কারণে এমন ঘটল তা পরবর্তী ঘটনায় পরিষ্কার হয়ে যাবে।
শহীদ সাহেব মন্ত্রিত্ব চলে যাওয়ার পরে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠানের দিকে মন দিলেন। যুদ্ধের প্রথম ধাক্কা সামলিয়ে ইংরেজ যুদ্ধের গতির পরিবর্তন করে ফেলল। এই সময় কংগ্রেস ‘ভারত ত্যাগ করো’ আন্দোলন’ ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। পাকিস্তান আন্দোলনকেও শহীদ সাহেব এবং হাশিম সাহেব জনগণের আন্দোলনে পরিণত করতে পেরেছিলেন। আমাদেরও ইংরেজের বিরুদ্ধে একটা জাতক্রোধ ছিল। হিটলারের ফ্যাসিস্ট নীতি আমরা সমর্থন করতাম না, তথাপি যেন ইংরেজের পরাজিত হওয়ার খবর পেলেই একটু আনন্দ লাগত। এই সময় নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করে ভারতবর্ষের হিন্দু ও মুসলমান সৈন্যদের ধরে নিয়ে ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছেন। মনে হতো, ইংরেজের থেকে জাপানই বোধ হয় আমাদের আপন। আবার ভাবতাম, ইংরেজ যেয়ে জাপান আসলে স্বাধীনতা কোনো দিনই দিবে না। জাপানের চীন আক্রমণ আমাদের ব্যথাই দিয়েছিল। মাঝে মাঝে সিঙ্গাপুর থেকে সুভাষ বাবুর বক্তৃতা শুনে চঞ্চল হয়ে উঠতাম। মনে হতো, সুভাষ বাবু একবার বাংলাদেশে আসতে পারলে ইংরেজকে তাড়ান সহজ হবে। আবার মনে হতো, সুভাষ বাবু আসলে তো পাকিস্তান হবে না। পাকিস্তান না হলে ১০ কোটি মুসলমানের কি হবে? আবার মনে হতো, যে নেতা দেশ ত্যাগ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে পারেন, তিনি কোনো দিন সাম্প্রদায়িক হতে পারেন না। মনে মনে সুভাষ বাবুকে তাই শ্রদ্ধা করতাম।
অখণ্ড ভারতে যে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না, এটা আমি মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতাম। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হিন্দু নেতারা ক্ষেপে গেছেন কেন? ভারতবর্ষেও মুসলমান থাকবে এবং পাকিস্তানেও হিন্দুরা থাকবে। সকলেই সমান অধিকার পাবে। পাকিস্তানের হিন্দুরাও স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বাস করবে। ভারতবর্ষের মুসলমানরাও সমান অধিকার পাবে। পাকিস্তানের মুসলমানরা যেমন হিন্দুদের ভাই হিসেবে গ্রহণ করবে, ভারতবর্ষের হিন্দুরাও মুসলমানদের ভাই হিসেবে গ্রহণ করবে। এই সময় আমাদের বক্তৃতার ধারাও বদলে গেছে। অনেক সময় হিন্দু বন্ধুদের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এ নিয়ে আলোচনা হতো। কিছুতেই তারা বুঝতে চাইত না। ১৯৪৪-৪৫ সালে ট্রেনে, স্টিমারে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে তুমুল তর্কবিতর্ক হতো। সময় সময় এমন পর্যায়ে আসত যে, মুখ থেকে হাতের ব্যবহার হওয়ার উপক্রম হয়ে উঠত। এখন আর মুসলমান ছেলেদের মধ্যে মতবিরোধ নাই। পাকিস্তান আনতে হবে-এই একটাই সেøাগান সকল জায়গায়।
একদিন হক সাহেব আমাদের ইসলামিয়া কলেজের কয়েকজন ছাত্র প্রতিনিধিকে খাওয়ার দাওয়াত করলেন। দাওয়াত নেব কি নেব না এই নিয়ে দুই দল হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত আমি বললাম, ‘কেন যাব না, নিশ্চয়ই যাব। হক সাহেবকে অনুরোধ করব মুসলিম লীগে ফিরে আসতে। আমাদের আদর্শ যদি এত হালকা হয় যে, তার কাছে গেলেই আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চলে যাব, তাহলে সে পাকিস্তান আন্দোলন আমাদের না করাই উচিত।’ আমি খুলনার একরামুল হককে সাথে নিলাম, যদিও সে ইসলামিয়ায় পড়ে না। তথাপি তার একটা প্রভাব আছে। আমাকে সে মিয়াভাই বলত। আমরা ছয়-সাতজন গিয়েছিলাম। শেরে বাংলা আমাদের নিয়ে খেতে বসলেন এবং বললেন, ‘আমি কি লীগ ত্যাগ করেছি? না, আমাকে বের করে দেয়া হয়েছে? জিন্নাহ সাহেব আমাকে ও আমার জনপ্রিয়তাকে সহ্য করতে পারেন না। আমি বাঙালি মুসলমানদের জন্য যা করেছি, জিন্নাহ সাহেব সারা জীবনে তা করতে পারবেন না। বাঙালিদের স্থান কোথাও নাই, আমাকে বাদ দিয়ে নাজিমুদ্দীনকে নেতা করার ষড়যন্ত্র।’ আমরাও আমাদের মতামত বললাম। একরামুল হক বলল ‘স্যার, আপনি মুসলিম লীগে থাকলে আর পাকিস্তান সমর্থন করলে আমরা বাংলার ছাত্ররা আপনার সাথে না থেকে অন্য কারও সাথে থাকতে পারি না। ‘পাকিস্তান’ না হলে মুসলমানদের কি হবে?’ শেরে বাংলা বলেছিলেন, ‘১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব কে করেছিল, আমিই তো করেছিলাম! জিন্নাহকে চিনত কে?’ আমরা তাকে আবার অনুরোধ করে সালাম করে চলে আসলাম। আরো অনেক আলাপ হয়েছিল, আমার ঠিক মনে নাই। তবে যেটুকু মনে আছে, সেটুকু বললাম। তার সঙ্গে স্কুল জীবনে একবার ১৯৩৮ সালে দেখা হয়েছিল ও সামান্য কথা হয়েছিল গোপালগঞ্জে। আজ শেরে বাংলার সামনে বসে আলাপ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।
এদিকে মুসলিম লীগ অফিসে ও শহীদ সাহেবের কানে পৌঁছে গিয়েছে ্আমরা শেরে বাংলার বাড়িতে যাওয়া-আসা করি। তার দলে চলে যেতে পারি। কয়েক দিন পরে যখন আমি শহীদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যাই তিনি হাসতে হাসতে বললেন, ‘কি হে, আজকাল খুব হক সাহেবের বাড়িতে যাও, খানাপিনা কর?’ বললাম, ‘একবার গিয়েছি জীবনে।’ তাকে সমস্ত ঘটনা বললাম। তিনি বললেন, ভালই করছ, তিনি যখন ডেকেছেন, কেন যাবে না?’ আরো বললাম, ‘আমরা তাকে অনুরোধ করেছি মুসলিম লীগে আসতে।’ শহীদ সাহেব বললেন, ‘ভালই তো হত যদি তিনি আসতেন। কিন্তু আসবেন না, আর আসতে দিবেও না। তার সাথে কয়েকজন লোক আছে, তিনি আসলে সেই লোকগুলোর জায়গা হবে না কোথাও। তাই তাকে মুসলিম লীগের বাইরে রাখতে চেষ্টা করছে।’
শহীদ সাহেব ছিলেন উদার, কোনো সংকীর্ণতার স্থান ছিল না তার কাছে, কিন্তু অন্য নেতারা কয়েকদিন খুব হাসি তামাশা করেছেন আমাদের সাথে। আমি খুব রাগী ও একগুঁয়ে ছিলাম, কিছু বললে কড়া কথা বলে দিতাম। কারও বেশি ধার ধারতাম না। আমাকে যে কাজ দেয়া হতো, আমি নিষ্ঠার সাথে সে কাজ করতাম। কোনো দিন ফাঁকি দিতাম না। ভীষণভাবে পরিশ্রম করতে পারতাম। সেই জন্য আমি কড়া কথা বললেও কেউ আমাকে কিছুই বলত না। ছাত্রদের আপদে-বিপদে আমি তাদের পাশে দাঁড়াতাম। কোন ছাত্রের কি অসুবিধা হচ্ছে, কোন ছাত্র হোস্টেলে জায়গা পায় না, কার ফ্রি সিট দরকার, আমাকে বললেই প্রিন্সিপাল ড. জুবেরী সাহেবের কাছে হাজির হতাম। আমি অন্যায় আবদার করতাম না। তাই শিক্ষকরা আমার কথা শুনতেন। ছাত্ররাও আমাকে ভালোবাসত। হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট সাইদুর রহমান সাহেব জানতেন, আমার অনেক অতিথি আসত। বিভিন্ন জেলার ছাত্রনেতারা আসলে কোথায় রাখব, একজন না একজন ছাত্র আমার সিটে থাকতই। কারণ সিট না পাওয়া পর্যন্ত আমার রুমই তাদের জন্য ফ্রি রুম। একদিন বললাম, ‘স্যার, কোনো ছাত্র রোগগ্রস্ত হলে যে কামরায় থাকে, সেই কামরাটা আমাকে দিয়ে দেন। সেটা অনেক বড় কামরা দশ-পনেরজন লোক থাকতে পারে।’ বড় কামরাটায় একটা বিজলি পাখাও ছিল। নিজের কামরাটা তো থাকলই। তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, দখল করে নাও। কোনো ছাত্র যেন নালিশ না করে।’ বললাম, ‘কেউই কিছু বলবে না। দু-একজন আমার বিরুদ্ধে থাকলেও সাহস পাবে না।’
বেকার হোস্টেলে কতগুলো ফ্রি রুম ছিল, গরিব ছাত্রদের জন্য। তখনকার দিনে সত্যিকার যার প্রয়োজন তাকেই তা দেয়া হত। আজকালকার মত টেলিফোনে দলীয় ছাত্রদের রুম দেয়ার জন্য অনুরোধ আসত না। ইসলামিয়া কলেজে গরিব ছেলেদের সাহায্য করবার জন্য একটা ফান্ড ছিল। সেই ফান্ড দেখাশোনা করার ভার ছিল বিজ্ঞানের শিক্ষক নারায়ণ বাবুর। আমি আর্টসের ছাত্র ছিলাম, তবু নারায়ণ বাবু আমাকে খুব ভালবাসতেন। তিনি যদিও জানতেন, আমি প্রায় সকল সময়ই ‘পাকিস্তান, পাকিস্তান’ করে বেড়াই। ইসলামিয়া কলেজের সকল ছাত্রই মুসলমান। একজন হিন্দু শিক্ষককে সকলে এই কাজের ভার দিত কেন? কারণ তিনি সত্যিকারের একজন শিক্ষক ছিলেন। হিন্দুও না, মুসলমানও না। যে টাকা ছাত্রদের কাছ থেকে উঠত এবং সরকার যা দিত, তা ছাড়াও তিনি অনেক দানশীল হিন্দু-মুসলমানদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে জমা করতেন এবং ছাত্রদের সাহায্য করতেন। এই রকম সহানুভূতিপরায়ণ শিক্ষক আমার চোখে খুব কমই পড়েছে।
এই সময় আমি বাধ্য হয়ে কিছু দিনের জন্য ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হই। অনেক চেষ্টা করেও দুই গ্রুপের মধ্যে আপস করতে পারলাম না। দুই গ্রুপই অনুরোধ করল, আমাকে সাধারণ সম্পাদক হতে, নতুবা তাদের ইলেকশন করতে দেয়া হোক। পূর্বের দুই বৎসর নির্বাচন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় করেছি। ইলেকশন আবার শুরু হলে আর বন্ধ করা যাবে না। মিছামিছি গোলমাল, লেখাপড়া নষ্ট, টাকা খরচ হতে থাকবে। আমি বাধ্য হয়ে রাজি হলাম এবং বলে দিলাম তিন মাসের বেশি আমি থাকব না। কারণ পাকিস্তান ইস্যুর ওপর ইলেকশন আসছে, আমাকে বাইরে বাইরে কাজ করতে হবে। কলেজে আসতেও সময় পাব না। আমি তিন মাসের মধ্যেই পদত্যাগপত্র দিয়ে আরেকজনকে সাধারণ সম্পাদক করে দিই।
১৯৪৫ সালে গোড়ার থেকেই ইলেকশনের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে ইলেকশন হবে, সমস্ত ভারতবর্ষব্যাপী মুসলমানরা ‘পাকিস্তান’ চায় কি চায় না তা নির্ধারণ করতে। কারণ কংগ্রেস দাবি করে যে, তারা হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করেন। নজির হিসাবে তারা বলেন, মওলানা আবুল কালাম আজাদ কংগ্রেসের সভাপতি। এ কথা সত্য যে, কয়েকজন খ্যাতনামা মুসলমান নেতা তখন পর্যন্ত কংগ্রেসে ছিলেন। তাদের বক্তব্য ছিল যে, ভারতবর্ষ এক থাকলে দশ কোটি মুসলমানের উপর হিন্দুরা অত্যাচার করতে সাহস পাবে না। তা ছাড়া কতগুলো প্রদেশে মুসলমান সংখ্যাগুরু আছে। আর যদি পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান দুইটা রাষ্ট্র হয়, তবে হিন্দুস্থানে যে সমস্ত মুসলমানরা থাকবে, তাদের অস্তিত্ব থাকবে না। অন্য দিকে মুসলিম লীগের বক্তব্য পরিষ্কার, পাকিস্তানের হিন্দুরাও সমান নাগরিক অধিকার পাবে। আর হিন্দুস্থানের মুসলমানরা সমান নাগরিক অধিকার পাবে। লাহোর প্রস্তাবে এ কথা পরিষ্কার করে লেখা আছে।হ
(অসমাপ্ত আত্মজীবনী পৃষ্ঠা-৩৫-৩৯)

 


আরো সংবাদ



premium cement