২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মিনি বিড়ালের নতুন জামা

-

রহস্যভেদ পর্ব
মিনি মন খারাপ করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। সে এখন কী করবে, কোথায় যাবে, কিভাবে খুঁজে পাবে তার ছোট্ট বন্ধু তুহিনকে। মিনি মিউ মিউ করে কাঁদতে লাগল, কিন্তু তার চোখের পানি মুছে দেয়ার মতো কেউ নেই। কত বড় এই শহর, কত উঁচু উঁচু বাড়ি, রঙ-বেরঙের গাড়ি, কত রকম মানুষজন। আজ সবাইকে খুব খুশি খুশি লাগছে। মিনি মনে মনে ভাবল, আজ কি কোনো বিশেষ দিন। আরে আজ তো ঈদের দিন, কথাটি মনে হতেই মিনি আবারো কেঁদে উঠল।
আব্বু-আম্মুর সাথে ঈদের শপিং করতে এসেছিল তুহিন। সাথে তার ছোট্ট বিড়াল মিনি। তুহিন মিনির জন্য একটি লাল টুকটুকে জামা কিনবে। তার কাছে ১০০ টাকা আছে, কিন্তু ১০০ টাকা দিয়ে এই মার্কেটে কোনো জামা পাওয়া যায় না। তাকে ফুটপাথে যেতে হবেÑ বলল এক দোকানদার। তারপর তুহিন ও মিনি দু’জনে মিলে ফুটপাথ নামক দোকানটি খুঁজতে লাগল। চার দিকে লোকজনের ভিড়, পথ চলতে হিমশিম খেতে লাগল ছোট্ট তুহিন। তার হাতে বাঁধা বেল্টটি কখন যে ছিঁড়ে গেল টেরই পেল না। মিনি মিউ মিউ করে উঠল। ছুটতে লাগল তুহিনের পিছু পিছু। চিৎকার করে বলার চেষ্টা করলÑ বন্ধু, আমি হারিয়ে যাচ্ছি তোমার কাছ থেকে। কিন্তু ভিড় ঠেলে তুহিনের কানে পৌঁছল না সেই শব্দ। মুহূর্তেই তুহিনকে হারিয়ে ফেলল মিনি।
তুহিনের জন্য দুশ্চিন্তা হতে লাগল মিনির। একা একা এদিক-ওদিক তুহিনকে খুঁজতে লাগল। একটি ছোট্ট মেয়ে মিনিকে দেখে কোলে তুলে নিলো। আরে কী সুন্দর বিড়াল! আমি এ বিড়ালটিকে পোষব। মিনি কান্নাভরা চোখে মেয়েটির দিকে তাকলÑ আমাকে কোথাও নিয়ে যেও না, আমার বন্ধু তুহিন আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, আমাকে ওর কাছে পৌঁছে দাও। মেয়েটি মিনির কথা কিছুই বুঝতে পারল না। তাকে নিয়ে এলো বাসায়। খুব আদরযতœ করল। নিজ হাতে গোসল করাল, গরম গরম দুধ খাইয়ে দিলো, ঘুম পাড়িয়ে দিলো; কিন্তু মিনির এসব কিছুই ভালো লাগল না। সারাক্ষণ মিউ মিউ করে কাঁদতে থাকল। কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল বুঝতেই পারল না। ঘুম ভাঙল প্রচণ্ড শব্দে। মেয়েটির মা হইচই শুরু করে দিয়েছেন, তুমি আবারো বাইরে থেকে বিড়াল ধরে নিয়ে এসেছ, এক্ষনি ফেলে দিয়ে আসো। মেয়েটি মন খারাপ করে মিনিকে রাস্তায় রেখে এলো।
মিনি একা একা ঘুরতে লাগল আর খুঁজতে লাগল তার বন্ধু তুহিনকে। আচ্ছা, তুহিনদের বাসা যেন কোথায়, মিনি মনে করার চেষ্টা করল। কী যেন জায়গাটার নাম। মনে পড়ছে না কিছুতেই। এভাবে না খেয়ে রাস্তায় রাস্তায় কেটে গেল অনেক সময়। মিনি ক্লান্ত হয়ে একটু বসল। এমন সময় শুনতে পেলÑ ওই ধানমন্ডি যাইবেন, ধানমন্ডি। বাসের হেল্পারের মুখে ধানমন্ডি শোনার সাথে সাথে মিনির মনে পড়ে গেলÑ আরে তুহিনদের বাড়ি তো ধানমন্ডি। ততক্ষণে বাস ছেড়ে দিয়েছে। মিনি বাসের পেছন পেছন ছুটতে লাগল। ছুটতে ছুটতে বহু কষ্টে উঠে পড়ল বাসে। বাসের ভেতর প্রচণ্ড ভিড়। মিনি যে কোথাও দাঁড়াবে, সে উপায়ও নেই। হঠাৎ পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা দিলো কেউ। মিনি মিউ মিউ করে চেঁচিয়ে উঠল। এই বাসের মধ্যে বিলাই ঢুকছে, বিলাইটারে বাইর কইরা দাও। আমাকে বের করে দিও না, আমি তোমাদের কোনো ক্ষতি করব না, চুপচাপ বসে থাকব। কিন্তু কেউ বুঝল না মিনির মনের কথা, তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলো বাস থেকে।
মিনি দিশেহারার মতো মিউ মিউ করে উঠল। কত বড় রাস্তা, কত অলিগলি, আমি এখন কী করব? কোথায় যাবো? যা-ও একটা আশার আলো দেখতে পেয়েছিলাম, তা-ও এখন সব অন্ধকার। মিনি হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে একটু দাঁড়ালÑ আচ্ছা, কী নাম এ জায়গাটার।
এই রিকশা ধানমন্ডি যাবা? রিকশাওয়ালা বলল, যামু; কই নামবেন? আগে চলো তো। মিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল, ধানমন্ডি! সে আর দেরি না করে চট করে লাফিয়ে উঠল রিকশায়। চুপচাপ বসে পড়ল লোকটার পায়ের কাছে। লোকটা অবাক হয়ে বললÑ আরে কী সুন্দর বিড়াল! কোথা থেকে এলো? মিনি অসহায় দৃষ্টিতে লোকটার দিকে তাকাল। লোকটা মিনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, কোনো ভয় নেই। মিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। চলতে চলতে হঠাৎ থেমে গেল রিকশা। নিশ্চয়ই ধানমন্ডি চলে এসেছি। মিনি খুশিতে মিউ মিউ করে উঠল। লোকটা হাত বাড়িয়ে মিনিকে কোলে তুলে নিতে যাচ্ছিল। অমনি মিনি লাফ দিয়ে সরে গেল। তারপর ছুটতে শুরু করল, ছুটছে আর ছুটছেই। ওই মেয়েটার মতো লোকটাও যদি তাকে বাড়ি নিয়ে যায়, তখন? মিনি পিছু ফিরে তাকাল না একটুও। ছুটতে ছুটতে হাঁপিয়ে উঠল। ধপাস করে বসে পড়ল মিনি। অসহায় দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকাল। মাথার ভেতর ঘুরছে নানান রকম ভাবনা। এমন সময় দেখতে পেল বেশ বড়সড় একটা হুলোবিড়াল তার দিকেই এগিয়ে আসছে। মিনি কিছুটা ভয় পেল। তার পরও সাহস করে এগিয়ে গেল, জিজ্ঞেস করলÑ তুমি কি আমার বন্ধু তুহিনকে চেনো। হুলোবিড়ালটি অবাক হয়ে বললÑ আমি তো কত বাচ্চাকেই চিনি, কিন্তু সবার নাম জানি না। মিনি কী বলবে বুঝতে পাড়ল না। মিনিকে দেখে হুলোবিড়ালের খুব মায়া হলো। সে বলল, তোমাকে খুব দুর্বল দেখাচ্ছে, নিশ্চয়ই তুমি না খেয়ে আছো। আমার সাথে আসো, আমি তোমাকে এমন একজনের কাছে নিয়ে যাবো যিনি তোমাকে আদরযতœ করে সুস্থ করে তুলবেন। হুলোবিড়ালটি এই বলে মিনিকে তার পিঠে তুলে নিলো। তারপর দৌড়াতে শুরু করল। দৌড়াতে দৌড়াতে এসে দাঁড়াল সুন্দর একটি বাড়ির সামনে। মিনির কাছে মনে হলো সে স্বপ্ন দেখছে, কেমন একটা ঘোরের মধ্যে হারিয়ে গেছে। হুলোবিড়ালটি মিনিকে পিঠে নিয়েই লাফ দিয়ে উঠে গেল একতলা জানালায়, সেখান থেকে কার্নিশে, তারপর ইয়া বড় একটা লাফ দিয়ে দোতলার জানালায়। ঢুকে পড়ল রুমের ভেতরÑ মিউ মিউ দেখো আজ একজন নতুন মেহমানকে নিয়ে এসেছি, ও খুব দুর্বল, দীর্ঘ সময় না খেয়ে আছে, তুমি আমার ভাগের দুধটুকু ওকে খেতে দিয়ে দাও। মিনি চমকে উঠল পরিচিত একটি মুখ দেখে। সে যেন তার হারানো শক্তি ফিরে পেল, জোরে একটা লাফ দিলো, মিউ মিউ আমার দাদীমণি। দাদী মিনিকে দেখে অবাক হলেন, তাড়াতাড়ি আদর করে কোলে তুলে নিলেন।
দাদী দুই বাটি দুধ এনে হুলোবিড়াল আর মিনি বিড়ালকে খেতে দিলেন। মিনি বিড়াল সে দুধ পেয়ে চুক চুক করে পুরোটা খেয়ে নিলো। দাদী বললেন, আজ ঈদের দিন, অফুরন্ত খুশি, অফুরন্ত আনন্দ। আমার ভাবতেই ভালো লাগছে, তুহিন মিনিকে দেখে যে কত্ত খুশি হবে। তারপর দাদী ড্রয়ার থেকে দুটো জামা বের করে আনলেন, একটি নীল আর একটি লাল। ওরা আনন্দে হই হই করে উঠল। দাদী নীল জামা পরিয়ে দিলেন হুলোবিড়ালকে আর লালটা পরিয়ে দিলেন ছোট্ট বিড়াল মিনিকে। মিনি আর কোনো দিকে না তাকিয়ে এক দৌড়ে ছুটে গেল তুহিনের ঘরেÑ মিউ মিউ আমার বন্ধু তুহিন কোথায়? এখানে তো নেই। মিনি ছুটে গেল বারান্দায়Ñ আরে এই তো তুহিন, আনমনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে একটু চমকে দেই, মিনি আস্তে করে মুখ ঘষে দিলো তুহিনের পায়ে।
মিনি বিড়ালকে খুঁজে পেয়ে তুহিনের আনন্দ আর ধরে না। সে মিনিকে বুকে জড়িয়ে অনেক আদর করতে লাগল। আব্বু, আম্মু, দাদু অপলক দৃষ্টিতে তুহিন আর মিনি বিড়ালের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ঈদের এই আনন্দময় সকালে একটি ছোট্ট ছেলে তার হারিয়ে যাওয়া মিনি বিড়ালকে খুঁজে পেয়ে কি গভীর মমতায় জড়িয়ে ধরে আছে। এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কী হতে পারে!


আরো সংবাদ



premium cement