১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শহীদ নবাব সিরাজউদ্দৌলা

-

শহীদ নবাব সিরাজউদ্দৌলার ইতিহাস অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে বিবৃত করা হয়েছিল। তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠাকল্পে এবং স্বদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের অবস্থানকে বিপদমুক্ত করার জন্য। শহীদ নবাব সিরাজের সামগ্রিক চরিত্রকে এমনভাবে কলঙ্কিত করা হয়েছে যে, বিগত ২৩২ বছরেও প্রকৃত ইতিহাস নির্মাণ সম্ভব হয়নি। তবে, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় ব্রিটিশ শাসন শেষে আমরা দুবার স্বাধীনতা অর্জন করেছি, অথচ সঠিক ইতিহাস নির্মাণ ও শহীদ নবাবের আসল মূল্যায়নের প্রচেষ্টা এ পর্যন্ত হয়নি বললেই চলে। আমাদের দেশে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে, বর্তমানে শত শত ডিগ্রি কলেজ আছে। হাজার হাজার ইতিহাসের অধ্যাপক ও গবেষক নিয়মিতভাবে কাজ করে চলছেন অথচ কারো এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়ার খবর আমরা আজো জানতে পারিনি। আমার মনে হয়, আমরা আমাদের প্রকৃত ইতিহাস উদঘাটন করতে পারলে জাতি গর্বিত হতো, এ জাতি স্বাধীনতার মূল্য বুঝতে পারত এবং শহীদ নবাবের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে অনুপ্রেরণা লাভ করতে পারত।
মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে সিরাজউদ্দৌলা বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। আলীবর্দী খাঁর জীবিতাবস্থায় তরুণ সিরাজকে বহু যুদ্ধ বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিতে হয়েছিল। সিরাজের সাহস, রণকৌশল ও বীরত্বে অগাধ বিশ্বাস ছিল বলেই নবাব আলীবর্দী খাঁ তরুণ সিরাজকে বহুবার কঠিন দায়িত্ব দিতে ভরসা পেয়েছিলেন।
নবাব আলীবর্দী খাঁ বিদেশী ও দেশী ষড়যন্ত্রকারীদের সম্বন্ধে অত্যন্ত সজাগ ছিলেন এবং সিরাজকে ওইসব শত্রুদের ব্যাপারে বারবার অবহিত করে গিয়েছিলেন। এখানে স্মর্তব্য যে, ব্রিটিশ, ফরাসি, ডাচ ও পর্তুগিজ নাবিকেরা এ দেশে ব্যবসার অজুহাতে এসে এখানে দুর্গ নির্মাণ, সৈন্য সংগ্রহ, ষড়যন্ত্র ও অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্যে লিপ্ত হয়ে এ দেশকে শোষণ করার জন্য রাজনৈতিক শক্তি ও দেশ পরিচালনার ক্ষমতা অর্জনের জন্য নানা অপকৌশল ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। ঠিক ওই সময়ে রাজ্যের ওই দুর্দিনের সন্ধিক্ষণে সিরাজউদ্দৌলা নবাবের মসনদে আরওহণ করেই সম্ভাব্য সর্বদিক থেকেই ষড়যন্ত্র ও শত্রুতার মুখোমুখি হন। প্রথমত, সিরাজের খালা ঘষেটি বেগম সিরাজের নবাবিত্ব সহ্য করতে না পেরে নবাবকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন।
দ্বিতীয়ত, বেশ কয়েকজন অমুসলমান ও মুসলমান উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, সিরাজের মতো সাহসী ও বলিষ্ঠ শাসনকর্তার পরিবর্তে একজন দুর্বল নবাবকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করার মানসে নানা রকম দুরভিসন্ধির আশ্রয় গ্রহণ করে।
তৃতীয়ত, ব্রিটিশ ও ফরাসি তথাকথিত নাবিক ও ব্যবসায়ীরা অর্থনৈতিক শোষণ ও রাজনৈতিক শক্তি হাসিলের জন্য দেশীয় বিশ্বাসঘাতকদের সাথে নানাভাবে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। চতুর্থত, আহাম্মদ শাহ আবদালির হুমকি তরুণ নবাব সিরাজকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে রেখেছিল। নবাব আলীবর্দী খাঁ আশি বছর বয়সে ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১০ এপ্রিল পরলোক গমন করেন। তার চার দিন পর অর্থাৎ ১৫ এপ্রিল মীর্জা মোহাম্মদ সিরাজউদ্দৌলা বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সিংহাসনে আরওহণ করেন।
যে জেড হলওয়েলরে বিবরণ থেকে জানা যায়, নবাব আলীবর্দী খাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে সিরাজকে উপদেশ দেন, ইউরোপের বণিকদের শক্তি ও প্রতিপত্তি সম্পর্কে সর্বদা সতর্ক দৃষ্টি রাখবে। আল্লাহ আমাকে আরও কিছু দিন বেঁচে থাকার সুযোগ দিলে আমি এই ভয় থেকে তোমাকে মুক্ত করে যেতে পারতাম। এখন এই দায়িত্ব তোমার।
সিংহাসনে আরওহণের পর অল্প দিনের মধ্যেই নবাব সিরাজ কঠোর হস্তে ঘরের শত্রু দমন করেন এবং শাসনব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধন করেন। অতঃপর দেশপ্রেমিক সিরাজ বিদেশী শত্রু দমনের জন্য অস্থির হয়ে উঠেন। এ পর্যায়ে তিনি ফরাসি বণিকদের সাহায্যে ইংরেজ শত্রুদের সমূলে ধ্বংস করার প্রস্তুতি নেন। পর পর কয়েকবার নিজে যুদ্ধ পরিচালনা করে কাশিম বাজার কুঠি, চন্দন নগর কুঠি, এমনকি কলকাতাকে ইংরেজদের হাত থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করেন।
১৭৫৬ সালে ১৫ এপ্রিল থেকে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত অর্থাৎ সিরাজ শাসনের এই চৌদ্দ মাস সাত দিনের দিনপঞ্জি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নবাব সিরাজ প্রতিটি দিন শাসনকার্য সুসংগঠন, শত্রু ও ষড়যন্ত্র দমন, ফরাসি বণিকদের সাথে সমঝোতা রক্ষণ ও ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদি অতিব্যস্ত ও চিন্তিত সময় কাটিয়েছেন।
এ ধরনের রাজকীয় ব্যস্ততা ও দুশ্চিন্তার মধ্যে তার ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য কিংবা বিলাসিতার সময় আসলো কোত্থেকে? অথচ, ব্রিটিশ আমলের ঐতিহাসিকরা সিরাজের ব্যক্তিগত চরিত্রকে ঘৃণ্য ও জঘন্য হিসেবে চিত্রায়িত করতে দ্বিধাবোধ করেনি।
শুধু ব্রিটিশ নয়, হিন্দু ও মুসলমান অল্প শিক্ষিত তথাকথিত ঐতিহাসিকরাও দুই শ’ বছর ধরে নবাব সিরাজকে অন্যায়, অত্যাচার, বিলাসী ও লোভী এমনকি দুশ্চরিত্র দুর্বল নবাব হিসেবে প্রমাণিত করার প্রয়াস পেয়েছে। অথচ কিছু কিছু ফরাসি পর্যটক, বণিক, গভর্নর ও ঐতিহাসিকদের বর্ণনায় সিরাজ চরিত্রের প্রকৃত রূপের বর্ণনা আছে। তাদের বর্ণনা একত্র করে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে সিরাজ রাজনৈতিক চরিত্রে অত্যন্ত সাহসী ও সূক্ষ্ম, কূটনীতিবিদ এবং ব্যক্তি চরিত্রে সহজ-সরল ও বলিষ্ঠ নবাব ছিলেন।
তিনি স্ত্রী বেগম লুৎফুন্নেসাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। আবার শত্রুপক্ষের সাথে মোকাবেলায় অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। তিনি শাসনকার্য পরিচালনায় দক্ষতার বহু স্বাক্ষরও রেখে গিয়েছেন। সিরাজ মাতা আমিনা বেগম ও স্ত্রী লুৎফুন্নেসা বেগম উভয়েই দানশীলতা, ক্ষমতা প্রদর্শন ও দরিদ্র সেবার জন্য সুখ্যাতি অর্জন করেন।
দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য নবাব সিরাজকে জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছে। ইচ্ছা করলে তরুণ নবাব ব্রিটিশ বণিকদের বাণিজ্য সুবিধা কিছুটা বাড়িয়ে এবং তাদের ঔদ্ধত্য সহ্য করে বহু যুগ শান্তিতে নবাবী করে যেতে পারতেন।
কিন্তু তিনি তা করেননি। দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য তার অকৃত্রিম ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ তিনি সব শত্রুকে চিহ্নিত করে তাদের চিতরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেশের স্বাধীনতাকে মজবুত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা পারেননি। আমদের ইতিহাস বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস এবং আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি না। আমরা আজো আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম শহীদ নবাব সিরাজকে তার উপযুক্ত মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। আজো আমরা আমাদের সঠিক ইতিহাস জানার চেষ্টা করি না। তৎকালীন ফরাসি, বণিক ও পর্যটক এবং ঐতিহাসিকদের বর্ণনা জোগাড় করিনি। এমনকি, তেমন কোনো ঐতিহাসিক গবেষণার উদ্যোগ গ্রহণ করিনি। জাতি হিসেবে আমাদের জাতীয় ইতিহাস উদ্ধারের এই ব্যর্থতা আমাদের পরনির্ভর করে তুলেছে। অসহায় জাতির আত্মা এ জন্য ছটফট করে উঠে অহরহ। অথচ আমরা যারা তথাকথিত শিক্ষিত, জাতির এ নৈতিক চাহিদা পূরণে তাদের যেন কোনো চিন্তা নেই, বিকার নেই, অবসর নেই। আমরা যেন ভুলেই গেছে যে, নবাব সিরাজউদ্দৌলা প্রাণপ্রিয় স্ত্রী বেগম লুৎফুন্নেছা পরিবারের অন্যান্যের সাথে প্রায় পাঁচ বছরকাল ঢাকায় বুড়িগঙ্গার অপর তীরে, জিঞ্জিরায় বসবাস করছেন। সে বাড়িটি এখনো বিদ্যমান। ১৭৬২ সালে ইংরেজদের হাতে ধরা পড়লে তাকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত করা হয়। তাকে সেখানে একটা বাড়ি এবং মাসিক মাসোহারা দেয়া হয়।
বেগম লুৎফুন্নেছা খোশবাগে সিরাজের কবরের কাছে একখানি কুঁড়ে ঘর তৈরি করে বাকি জীবনটা সেখানেই কাটিয়ে দেন। কতবড় বিদুষী ও মহিয়সী নারী হলে জীবনের সব লোভ ও আয়েশ ছেড়ে তিনি জীবনের বেশির ভাগ সময়টি প্রাণধিক প্রিয় স্বামী সিরাজের ধ্যান করেই কাটিয়ে দেন।
তিনি প্রতিদিন নিয়মিত কবরের পাশে বসে কুরআন শরিফ পড়তেন এবং মাসিক যে মাসোহারা পেতেন তা দিয়ে প্রতিদিন কাঙালি ভোজের ব্যবস্থা করতেন। বেগম লুৎফুন্নেছা সুদীর্ঘ আটাশ বছর ধরে এভাবে স্বামীর সেবা করে ১৭৯০ সালের নভেম্বর মাসে পরলোক গমন করেন এবং সিরাজের পদতলে সমাধিস্থ হন। বেগম লুৎফুন্নেছার এই একনিষ্ঠ প্রেম-ভালোবাসা ও ত্যাগ বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বকালে সমুজ্জ্বল হয়ে থাকবে। আর এ ইতিহাস কি সিরাজ চরিত্রের পবিত্র গুণাবলির স্বাক্ষর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে না? হ

 


আরো সংবাদ



premium cement
চকরিয়ায় ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ৩ গাজা মানবিক নরকে পরিণত হয়েছে : জাতিসঙ্ঘ প্রধান রাফা হামলার পরিকল্পনা ইসরাইলের ত্যাগ করা উচিত : চীন গাজা যুদ্ধে নতুন যে কৌশল অবলম্বন করল ইসরাইল হাসপাতালের শৌচাগারে মিলল নবজাতক শিশু ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রার ঢাকা সফর স্থগিত জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিসিডিপি গঠন করা হবে : পরিবেশমন্ত্রী অননুমোদিত জমি ভরাট কার্যক্রমের সন্ধান পেলে দ্রুত ব্যবস্থার নির্দেশ ভূমিমন্ত্রীর ভাসানচর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এক ব্যক্তিকে গলা কেটে হত্যা ইসরাইলকে পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাতের ব্যাপারে সতর্ক করলো আইআরজিসি সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের ১২৮তম প্রয়াণ দিবসে স্মরণ সভা

সকল