২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

ফুলের কানাকানি

-

বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল ক’জন প্রিয়ার হাতে পৌঁছে দেন? আমার সৌভাগ্য পাঁচ তলার ছাদেও বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল এসে ধরা দেয়। একদিন প্রিয়াকে বললাম, তোমার হাতের নাগালের মধ্যেই প্রথম কদম ফুল। প্রিয়া অবাক বললেন : এত দিন দেখিনি তো। বললাম, তোমাকে যে রোজ রাতে গান শোনাই, তুমি কি তা শুনতে পাও? গাইছি : ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান, আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান’/ ‘মেঘের ছায়ায় অন্ধকারে এই যে আমার সুরের ক্ষেতের প্রথম সোনার ধান’। প্রত্যাহিকতায় ভেসে যায় সব গান, সব ফুল। এমনি ব্যস্ত জীবন প্রবাহ। সময় নেই ফুলের দিকে তাকানোর। তাই কি হয় ? আজ শুনতেই হবে।
গাইছি, শুনবে কে? কবি যে গানগুলো লিখে গেলেন সে গানগুলো মন দিয়ে শুনছে ক’জন? রবীন্দ্র সংগীতের আসরেও গানের গভীরে ক’জন? এই তো ক’দিন আগে অদিতির গানের আসর বসেছে ঢাকা ক্লাবে। আমিও শ্রোতা। অশ্রুসিক্ত ক’জন, হয়তো যে গানটি গেয়েছেন, আর আমি। গান শুনবে মন দিয়ে।
ফুল নেবে হৃদয় দিয়ে। কবি উপস্থিত ফুলের ডালি নিয়ে। অনুভবে এনেছেন ? গহন রাত্রিতে অশত্থপল্লবে বৃষ্টির ঝরে যাওয়ার মর্মর শব্দ শুনতে পেয়েছেন ? সঘন গহন রাত্রিতে এ গান নিজকে যে শুনিয়েছে সে পেয়েছে, কখন ‘নিশীথের অনিদ্রা দেয় যে ভরিয়া’/ ‘মায়া লোক হতে ছায়াতরণী’/ ‘ভাসায় স্বপ্ন পারাবারে নাহি তার কিনারা’। অশত্থপল্লব কবির মনে কি অনুুভূতি এনেছে, ভাবতে হবে।
শ্বেতশতদলের মুকুট পরেছে ক’জন? ওরা শ্বেতশতদল চেনে না, চেনে না মালতির ঝরে যাওয়া, তাই ওরা চেনে না যখন গাই : ‘আমরা এনেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালি মালা’। চেনে না ‘নবীন ধানের মঞ্জুরী’। ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে গিয়েছি গ্রাম দেখাতে। নদী দেখেনি, কাশফুল চেনেনি, চেনে নিশারদ লক্ষ্মীকে। ক্লাসরুমে এগুলো পাওয়া যায় না। শিউলি চেননি, বাংলাকে কতটুকু ভালোবেসেছ? রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন শান্তিনিকেতনকে বানাতে প্রকৃতির স্কুলে, যেখানে সবাই গাইবে ভোরবেলায় এক সঙ্গে : ‘শিউলি ফুল, শিউলি ফুল... ভোরবেলায় বারে বারে ফিরিবারে হলি ব্যাকুল। কেন রে তুই উন্মনা- নয়নে তোর হিম কণা’।
গত কাল সন্ধ্যোবেলায় হাঁটতে গেলাম, হঠাৎ শিউলির গন্ধ। কে যেন বলল, একটু দাঁড়াও। সুবাসটুকু মিশিয়ে নাও তোমার বুকের সঙ্গে, আমি ফুটেছি তোমার জন্যে। অনুভূতির প্রয়োজন তীক্ষè হওয়া। ফুলের সুঘ্রাণ তখনই পাবে, যখন দেবে ফুলের মূল্য। সে দিন হাসনুহেনার ডালের কাছে ওরা আমাকে অনেক কিছু বলে গেল। হেনার সুগন্ধের তীব্রতা সর্বাধিক, ডালের পাশেই হয়তো কোথাও সর্পদেব লুকিয়ে, ঘ্রাণশক্তি ওদের বেশি, হাসনুহেনা সুবাস ছড়ালে ওরা আসবে। আর আমি হাঁটা ভুলে ওখানেই দম নিলাম।
হাসনুহেনা পিতার প্রিয় ফুল। আর জুঁই, যেমন শুভ্র তেমনি এর সুবাস। জুঁই ফুল আমার কৈশোর ও যৌবনকে ঘিরে। পুরানা পল্টনের হিরামন মনজিল মানে জুঁই, আর গন্ধরাজ। সমগ্র বাড়ি যেন সুবাসে মৌ মৌ। আর বর্ষায় এল ঝম ঝম বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে কেয়া। পঞ্চাশ কেয়া গাছ। কে নিবি ফুল, কে নিবি ফুল? কে বলবে এটি একটি শিল্পীর বাগান নয়, যে জানে এই সুরভির মূল্য? জানতেন পিতা। জন্মলগ্নেই তাই চিনেছি চামেলি, কদম্ব ফুল, তাদের বারতা নানা ঋতুর বিন্যাসে। কোথাও বেড়াতে গেলে যখন ভেসে আসে বেলি ফুলের গন্ধ, স্মৃতিকে তা করে উতলা। তা হলে এগুলো সৃষ্টিকর্তারই নানা ছল। মনের মাধুরীকোষ্ঠে যখনই এই ফুলের প্রবেশ, তখনই স্মৃতিরা এসে জানান দেয় অন্য কথা, এই ফুলের সুরভি কার জানো কি? তোমরা জান না, সব সেই শ্রেষ্ঠ প্রেমিকের। তোমার আমার স্র্রষ্টার। অনেক ফুলের বাগানে গিয়ে ব্যাপারটি বুঝতে পেরেছি। গিয়েছি লন্ডনের কিউ গার্ডেনেও, সারাদিন আসমাসহ সেখানে ছিলাম। এ ছাড়াও প্যারিসের তিনটি দুষ্প্রাপ্য ফুলের বাগানে। এই বাগানগুলোর কথা খুব কম লোকই জানে। গিয়েছি আসমা ও তার বন্ধু ফাতেমাকে সঙ্গে নিয়ে। একেক ফুলের একেক গন্ধ। মিল নেই কারও সাথে কারও। তারা একক।
নামাজ পড়তে যাই। একজন আমার জন্যে দু’টি গন্ধরাজ নিয়ে আসেন। একটি আমার জন্যে, একটি আমার স্ত্রীর জন্যে। বললেন, এই ফুল দু’টি শুধু আপনাদের জন্যে ফুটেছে, আর কারও জন্যে নয়। আমার স্ত্রী উল্লসিত। রোজ এই গন্ধরাজের দস্তা। ভদ্রলোকের পরিচয় জানলাম, উনি একটি দৈনিকের সম্পাদক, অথচ তার মনটি কত পবিত্রতা দিয়ে মাখা। প্রতি ফজরে তিনি মুসল্লিদের জন্যে নিয়ে আসেন তার পত্রিকাটি। নাম ‘খবর’। তার এই অনন্য ভালবাসা আমি কোনো দিনও ভুলতে পারব না। একটি ফুলের সুবাস আমাদেরকে কত কাছে টানতে পারে।
যখন কোনো গান গাওয়া হয় তখন গানে বর্ণিত ফুলটির নাম স্মৃতিপটে উপস্থিত হয় কি, তখন ফুলটির সুবাসও ওই গানটির সঙ্গে মেলাতে সক্ষম হন কি? তখন বুঝব ওই সংগীতের মর্মস্থলে প্রবেশাধিকার পেয়েছেন আপনি। ধরাযাক : ‘বকুল ডালের আগায় জ্যোৎস্না / যেন ফুলের স্বপ্ন জাগায় জ্যোৎস্না / কার গোপন কানাকানি পূর্ণশশী, ঐ ঐ ঐ দিল আনি’। গুলশানের বারান্দায় দু’জন মুখোমুখি। পাশের বাড়ির ঝাঁকড়া বকুল গাছের একটি আগা আমার পাঁচতলার বারান্দা স্পর্শ করেছে। গাইছি আমার প্রিয়ার কানে। আকাশে পূর্ণ শশী। বিয়ে বেশি দিন হয় নি, তবে জানুয়ারি মাসের ২০ তারিখে পঞ্চান্ন বছর পূর্তি হবে ইনশা আল্লাহ্। বকুল ডালের আগায় জ্যোৎস্না কয়েকবার গাইলাম। স্ত্রী হতচকিত। তাকে যে বকুল ডালের আগায় জ্যোৎস্নœায় নিয়ে গিয়েছি, মুহূর্তে বুঝতে পারলেন। ফুল মানে ভালোবাসা, ফুল মানে প্রিয় কথার সান্নিধ্য, সুবাস মানে তার মধ্যে নিজকে সম্পূর্ণ করা। প্রতিটি গানই প্রকৃতির প্রতি সমর্পণ, স্র্রষ্টার দিকে দিকে ফিরে যাওয়া। হ্যাঁ, তাই।
বনফুলের কথা বলিনি। নাই বা বলি কেমন করে, আমার অনেক কবিতায় বনফুলের কথা আছে, যাদের কথা কবিরাও প্রায়শঃই ভুলে যান। নিভৃতে ফোঁটে ওরা, কারও চোখের সামনে নয়, আবার নিভৃতে ওদের চলে যাওয়া। যারা আমার কবিতার সমর্থক [মাত্র কয়েকটি লিখেছি] পড়ে নেবেন।
প্রাণের কবি লিখছেন : ‘ওগো শোনো কে বাজায় / বনফুলের মালার গন্ধ বাঁশির তানে মিশে যায়’ গানটি আমার প্রিয়। রোজই গাই। ফুল কানন নিয়ে কবি সারা পাতা ভরেছেন। পড়েছেন ক’জন। লিখছেন : ‘যদি শুধায় কে দিল ফুল কাননে/ মোর শপথ আমার নামটি বলি নে’। আমি রইবো চিরদিন তোমার দৃষ্টির আড়ালে। আমাকে খুঁজতে চেষ্টা কর না। ফুলের গন্ধে আমাকে পাবে। নিশীথিনি হয়ে, সে যে আসে ফুল গন্ধের আবরণে তা কি বোঝ নি? শস্যক্ষেতের গন্ধ নিয়েছ? অপূর্ব মাদকতাময়। কবি লিখছেন : ‘শস্যক্ষেতের গন্ধখানি একলা ঘরে দিক সে আনি, ক্লান্তগমন পান্থ হাওয়া লাগুক আমার মুক্ত কেশে’। ‘ফুলের বনে যার কাছেই যাই তারেই লাগে ভালো’, এ তো জানা কথা। আবার ‘ফুল তুলিতে ভুল করেছি’, সেও জানা কথা। বিকশিত বেদনামঞ্জুরী কি তা জানতে পেরেছি। তা একটি ফুলের গন্ধ, চৈত্রপবনে যা চিত্তবনে আনে রিনিঝিনি। সে রিনিঝিনি কামিনি ফুলের। আর কোনো ফুলের নয়। আমার প্রাণের মাঝে যে সুধা লুকিয়ে আছে তা কি জান, তার খবর কি আছে তোমার কাছে? তা হলো পারিজাতের মধুর গন্ধ। তুমি আমার গান শুনতে চাও না, কবি বলছেন : তা হলে আমি তোমার ফুলবনে আসব না। সব সময় কুসুম ভালো লাগে না, তাই কোনদিন প্রভাতে এস অলকে কুসুম না দিয়ে। কুসুম দিয়ে পরিপূর্ণ কবিতার বাগান। যে কুসুম চেনে না, কবিতা থেকে সে অনেক দূরে। হৃদয়ে ভালোবাসার প্রবেশাধিকার নেই তার জন্যে।
অপরাজিতা ফুটে আছে আমার টবে। নতুন ফুল এলে গিন্নির কাজ হলো ওটি আমাকে দেখান। গ্রামে গেলে তাকে দেখাই শিমুল আর কৃষ্ণচূড়া। কুচবিহারের স্মৃতি কৃষ্ণচূড়া ও রাধাচূড়া। মহারাণীর বাগানে কয়েক হাজার গোলাপ। স্মৃতিতে আছে কোনিয়ায় মওলানার বাগানে সহস্র্র গোলাপের নৃত্য। অনন্তলতা চিনতাম না, এখন চিনি। বেলিফুলের জেগে ওঠা এবং পাঁপড়িগুলো কিভাবে মেলে ধরে তা দেখার মতো যদি আপনার সময় থাকে তা হলে কম্পিউটারে banglar.phool-এ তা দেখতে পাবেন। সন্ধ্যামালতি নজরুলের গানে কতবার ফুটেছে। বেলিফুলের কতগুলো নাম হয় জানেন? বেলি, মল্লিকা, বার্ষিকী, মতিয়া, মোগড়া, বনমল্লিকা, চামবা। হাসনুহানার তিনটি নাম : হাসনাহেনা, হাসনুহেনা, রাতের রাণী। ইংরেজিতে Lady of the night
রবীন্দ্রনাথের গানে কুঞ্জবনের বিবরণ যেমন পাওয়া যায়, তেমনি পাওয়া যাবে আমাদের হাজার বিচ্ছেদি গানে। এগুলো আমার সংগ্রহ। আছে কুঞ্জবনের শত নাম। কয়েকটি : কৃষ্ণলতা, কামলতা, তারালতা, তরুলতা, সূর্যকান্তি, জয়ন্তী।
নজরুলের গানে পাঁচ শ’ ফুলের কথা। সে কথা আরেকদিন।

 


আরো সংবাদ



premium cement
বস্ত্র-পাট খাতে চীনের বিনিয়োগ চায় বাংলাদেশ জামালপুরে সাব রেজিস্ট্রারকে হত্যার হুমকি মামলায় আ’লীগ নেতা গ্রেফতার গাজায় অনাহার যুদ্ধাপরাধ হতে পারে : জাতিসঙ্ঘ ‘প্রত্যেককে কোরআনের অনুশাসন যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে’ মতলব উত্তরে পানিতে ডুবে ভাই-বোনের মৃত্যু প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের শেষ ধাপের পরীক্ষা শুক্রবার লম্বা ঈদের ছুটিতে কতজন ঢাকা ছাড়তে চান, কতজন পারবেন? সোনাহাট স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করলেন ভুটানের রাজা জাতীয় দলে যোগ দিয়েছেন সাকিব, বললেন কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই কারওয়ান বাজার থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে ডিএনসিসির আঞ্চলিক কার্যালয় এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে কার্যকর পদক্ষেপ নিন : প্রধানমন্ত্রী

সকল