২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ঈদের আনন্দ আমাদের সমাজ

-

ঈদ একটি আরবি শব্দ। অর্থ খুশি বা আনন্দ। দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনার পর রোজাদার তার অন্তরে এবং সর্বত্র যে আত্মিক স্ফুর্তি আনন্দ অনুভব করেন তাকেই বলে ঈদ। মুসলিমদের জীবনে ঈদ আসে বছরে দুবারÑ একটা হলো ঈদুল ফিতর বা রোজার ঈদ আর অন্যটি হলোÑ ঈদুল আজহা বা কুরবানির ঈদ।
এই ঈদ আমাদের বাঙালি মুসলিম সমাজ ও সম্প্রদায়ের মধ্যে সুদীর্ঘকাল ধরে উদ্যাপিত হয়ে আসছে নিজস্ব একটি স্বতন্ত্র ব্যতিক্রমধর্মী ব্যঞ্জনা নিয়ে। বিশ্বের অন্য মুসলমানদের তুলনায় বাঙালি মুসলিম সমাজে এই ঈদ অন্য রকম এক উৎসবের আমেজে প্রতিপালিত হয়ে আসছে প্রতি বছর। ধনী-গরিব তথা সমাজের সব স্তরের মানুষ এই ঈদ উৎসব যার যা সামর্থ্য ও সঙ্গতি অনুসারে উদ্যাপন করে থাকে। মসজিদ বা খোলা ময়দানে গিয়ে সমবেত হয়ে ঈদের নামাজ আদায় করেÑ নামাজ শেষে পরস্পরে কুশল বিনিময় চলে খানিকটা।
সমাজ জীবনে আশরাফ-আতরাফের ভেদাভেদ অন্তত একদিনের জন্য হলে ও ঘুচে যায়। একে অপরের সাথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোলাকুলি ও করমর্দন করে ভাবের আদান প্রদান করে আসছে যুগের পর যুগ ধরে। তবে এই আনন্দ স্ফূর্তি বেশি সময়ে স্থায়ী হয় না। এটি একটি অতীব কষ্ট ও বেদনার ব্যাপার বৈকি। প্রতি বছরই এই ঈদ আসে এবং চলেও যায়। কিন্তু রেখে যায় কী? রেখে যায় এ দেশের কোটি কোটি মানুষের প্রতিদিনের নিরানন্দ জীবনের তথা বেদনাময় স্মৃতি জাগানিয়া অগণিত করুণ দৃশ্যাবলি শুধু। কেননা বেশির ভাগ মানুষের জীবনে প্রতিদিনই রোজা থাকে। অর্থাৎ অভাব-অনটন, উপস-কাবাসের মধ্যেই এদের জীবন অতিবাহিত হয় সীমাহীন কষ্টে। খেটে খাওয়া মানুষ, শ্রমজীবী মানুষের জীবন নিত্যই কাটে কায়-ক্লেশে। দুঃখ দুর্দশা এদের নিত্যদিনের সঙ্গী। মনে হয় ঈদ তো আসে এদের ব্যঙ্গবিদ্রƒপ করতে শুধু, বড় লোকদের কাছে করুণা প্রার্থী হওয়ার নিমিত্তে!
একদল সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষ-যারা বিত্ত প্রাচুর্যের মধ্যে লালিত-পালিত। তাদের ঈদ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে দেদীপ্যমান। এদের সঙ্গে দেশের বেশির ভাগ মানুষ যারা সুবিধা বঞ্চিত সমাজের নিম্নস্তরে যাদের জীবন যাপন তাদের ঈদ কোনো মতেই মিলে যাওয়ার নয়। তবুও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই ঈদ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। কারণ ইসলাম যে একতা-সাম্যের ব্যবস্থা দিয়েছে তা অনেকটা ফলপ্রসূ হওয়ার সুযোগ পায় সর্বত্র, নামাজ রোজা এবং ঈদে। অন্তত একদিনের ঈদে হলেও।
অন্যদিকে শহুরে জীবনে সেটা তেমন না ঘটলেও প্রাচুর্যের মধ্যে যাদের বসবাস তাদের ঈদের একটা স্বতন্ত্র আনন্দ ও বিনোদনের মাত্রা রয়েছে। কিন্তু সেটা এক তরফা, অর্থাৎ দেশের বেশির ভাগ মানুষ যেখানে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে প্রতিনিয়ত-তাদের জীবনে নিবিড় আনন্দ কোথায়? বুকভরে যদি তাদের আনন্দটা উপভোগ করতে সক্ষম হতো, তবে সবাই অপরিসীম স্বার্থকতার আনন্দ সলিলে অবগাহন করতে পারত। কিন্তু তার তো উপায় নেই বললেই চলে। সেটা তো হচ্ছে না। যতই ঢাকঢোল পিটিয়ে বলা হয়Ñ ঈদের আনন্দটা ভাগ করে নাওÑ বিলিয়ে দাও সব সবার মাঝে। আসলে এভাবে আনন্দ ভাগ হয় না, ভাগ করা যায় না। বরং বিয়োগ হয়ে যাচ্ছে আমাদের সবর জীবন থেকে ঈদের অনাবিল স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ আর সুখ।
রাসূলে আকরাম সা: একটি বর্বর ও অন্ধকারময় যুগে একটি নিকৃষ্ট মানব গোষ্ঠীর মধ্যে ঐশী আদর্শের মাধ্যমে সব ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে পেরেছিলেন বলেইÑ জাকাত দেয়ার লোকের সংখ্যা ব্যাপকতর হয়ে জাকাত নেয়ার লোকের অভাব হয়ে যায়। এভাবে জাকাতভিত্তিক একটি অর্থনৈতিক সুচারু ব্যবস্থা প্রবর্তন করে সমাজের সর্বত্র অর্থ সম্পদের বৈষম্য ও ভেদাভেদ দূর করেন এবং সমাজের সব স্তরে ঈদের অনাবিল আনন্দ ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। অথচ আমাদের দেশের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। অধিকাংশ ধনাঢ্য ব্যক্তি জাকাতভিত্তিক অর্থনীতির কিছুই না বুঝে জাকাত দানে বিরত থাকেন আজীবন। জাকাতকে কেউ কেউ ট্যাক্স (ঞধী) এর সাথেও তুলনা করেন। অথচ নামাজ কায়েম করা যেমন ফরজ, জাকাত আদায় করাও তেমন ফরজ। এটা না বোঝার ব্যাপার নয় মোটেই। তবুও ধনাঢ্য মানুষদের কেউ কেউ কিছুটা জাকাত দিতে গিয়ে পায়ের তলায় মানুষ পিষ্ট হয়ে লাশ হলেও অধিকাংশ ধনী মানুষেরা জাকাত দানে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। মনে হয় মানুষ মেরে দোষী হওয়ার ভয়ে।
অন্য দিকে শুধু নামাজ পড়ে কপালে মস্তদাগ তৈরি করে মনের আনন্দে বেহেশতের আশা করেন অনেকে। অথচ নামাজ কায়েমের নির্দেশের সাথে জাকাত আদায় করার আদেশও যে করা হয়েছে পবিত্র কুরআনুল কারিমে অসংখ্যবার। তার খবর নিতে চান না অনেকেই। যদি খবর নিতেন বা যাকাত সঠিকভাবে আদায় করা যেত তাহলে বাংলাদেশ দরিদ্রতম দেশের বদনাম অনেক পূর্বেই ঘুচাতে সক্ষম হতো। দরিদ্র মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল হতো।
রাসূলে আকরাম সা: একটি কুরআনিক সমাজ, বিশাল একদল খোদাভীরু মানুষ গড়ে তুলেছিলেন বলেই ঈদের অনাবিল আনন্দ সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। ধনী গরিবের ব্যবধান কমে প্রায় শূন্যের কোটায় পৌঁছে ছিল বলেই আশরাফ আতরাফের কৃত্রিম বৈষম্য ও পার্থক্য দূরীভূত হয়েছিল। আজ কোটি কোটি মানুষ এক আল্লাহ বিশ্বাসী, এক রাসূলে বিশ্বাসী, এক কুরআনের গর্বিত বাহক বিশাল জাতি কিন্তু কোথায় শান্তি এবং সৌহার্দ্যরে প্রকাশ? কোথায় সব মানুষকে আপন করে নিবার অপরিসীম আকুলতা? ধনাঢ্য শ্রেণীর এক মাসের সিয়াম সাধনার কষ্টের কোনো প্রতিফলন সমাজে পরিলক্ষিত হয় না, দেশের দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ যে সারা বছরেই অভুক্ত থাকেন এবং কোটি কষ্টের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করেন তার মর্ম ও তাৎপর্যের চিহ্ন ধনী শ্রেণীর মধ্যে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, সহমর্মিতার কোনো প্রকাশ প্রত্যক্ষ করা যায় না। বরং সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে যেখানে পচন ধরেছে আল কুরআনের শুধু প্রধান বিধিবিধানের ন্যূনতম প্রয়োগ ও ফলিত ব্যবহার যেখানে দুর্লভ সেখানে কেবল কুরআন আবৃতির মাধ্যমে সমাজের কলুষ কালিমা দূরীভূত করা, সব সমস্যার সমাধান পাওয়া এবং অপসংস্কৃতির প্রচণ্ড আগ্রাসন রোধ করা কি সম্ভব? সম্ভব নয়। আর সম্ভব হচ্ছে না বলেই ঈদের আনন্দ ও আমাদের জীবনে দুর্লভই রয়ে যাচ্ছে। এই বস্তুর দেখা পাওয়া কোনো দিন সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ ওইসব ভাবনাচিন্তার অবসর আমাদের কোথায়?
আমরা তো সব নগদ নারায়ণে বিশ্বাসী, আমরা তো সব অন্য কাজে রয়েছি মজে। তবে আন্তরিক প্রয়াস প্রচেষ্টা যদি চালানো যায় তবে অন্য কথা। সর্বোপরি একটি কুরআনিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শান্তিময় সমাজ গড়ে মানুষের দুঃখ দুর্দশা দূর করা সহজ। ঈদের আনন্দও সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব।
আজ আমরা শিক্ষা দীক্ষায় অনেক অগ্রসর। অনেক আধুনিক ও প্রগতিশীল- বিজ্ঞানমনস্ক হয়েও কেনো দুঃখ যাতনার শিকার হচ্ছি, পাহাড়সম সমস্যার সমাধান হচ্ছে না কেনো? আমরা কি অব্যবস্থার অবসান করতে পেরেছি? পারিনি। এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে আমাদের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটল না। ডাটফাটের প্রচলন ঘটেছে ব্যাপক, গাড়ি বাড়ির চমক সীমাহীন কিন্তু আসল সমস্যার সমাধান ঘটছে না। কারণ মানবজাতির যিনি সৃষ্টিকর্তা তার ব্যবস্থাপত্র ব্যতীত কোনো সমস্যার সমাধান, সমূহ জটিলতার তিরোধান সম্ভব হচ্ছে না। মানুষের ‘ব্যবস্থাপত্র’ দ্বারা যতই প্রচেষ্টা চালানো হোক না কেনো কাজ হবে না। বিশ্বের কোথায়ও আজ শান্তি স্বস্তির চিহ্ন মাত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে না কেনো? পৃথিবীর এক ইঞ্চি জায়গাতেও শান্তি তার স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত নেই। পক্ষান্তরে প্রত্যেকেই মারণাস্ত্র তৈরিতে উঠে পড়ে লেগে গেছেÑ কেবল মানুষ মারার জন্য, পশু-পাখি মারার জন্য নয়। জ্ঞান বিজ্ঞানের অপরিসীম অগ্রগতি-উৎকর্ষতার পরেও কেন যুদ্ধ বিগ্রহের অবসান ঘটছে না। যেখানে এসব সমাপ্তির ঘোষণা হবে উচ্চ কণ্ঠেÑ সেখানে আরো যেন মহাযুদ্ধের পরিস্থিতি সর্বাত্মক রূপ পরিগ্রহ হচ্চে। কারণ কী? কারণ তো দেখছি একটাই, আধুনিক সভ্যতা, এই বিশ্ব ব্যবস্থার গোড়ায় গলদ। এই সভ্যতা ও বিশ্বব্যবস্থার কারিগর যারা, তারা নিজেদের মনগড়া ‘প্রেসক্রিপশন’ দিয়ে বিশ্বটাকে চালাতে গিয়ে যত তালগোল পাকিয়ে ফেলছেন। লেজে গোবরে অবস্থার দিকে তারা এগিয়ে যাচ্ছেন। হায় মানবতা! হায় আধুনিক শিক্ষা সভ্যতা! সব অর্জন সব অগ্রগতিই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে যাচ্ছে বলে মনে হয়। হাজার হাজার বছরের গর্বিত সভ্যতা-সংস্কৃতি, শত শত বছরের বৈজ্ঞানিক সফলতা সবই কি ভণ্ডুল হয়ে যাবে? শুধু ক’টি বোটাম টিপেই কি মানব সভ্যতার সমাধি রচিত হতে যাচ্ছে? দেখে শুনে প্রতীয়মান হচ্ছে আধুনিক বিশ্বসভ্যতা সেদিকেই অগ্রসর হচ্ছে ক্রমান্বয়ে শনৈঃ শনৈঃ। আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ এর আওতাবহির্ভূত নয় মোটেই। তবে কি ভয়াল এই পরিণতির হাত হতে মানব সভ্যতার নিষ্কৃতিÑ পরিত্রাণ নেই? আছে এবং তা ‘হেরার রাজ তোরণের’ মধ্যেই লুকায়িত এবং নিহিত।

 


আরো সংবাদ



premium cement
মাটির নিচে পাওয়া গ্রেনেড মাইন মর্টার শেল নিষ্ক্রিয় করল সেনাবাহিনী অনির্দিষ্টকালের জন্য অনলাইন ক্লাসে যাচ্ছে জবি, বন্ধ থাকবে পরীক্ষা কুড়িগ্রামে রেলের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদ ক্রিকেট খেলতে অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে দেওয়ানগঞ্জের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী শিহাব কিশোরগঞ্জে বৃষ্টির জন্য বিশেষ নামাজ সাতক্ষীরা বৈদ্যুতিক খুটিতে ধাক্কা লেগে মোটরসাইকেলআরোহী নিহত বার্সেলোনাতেই থাকছেন জাভি চতুর্থ দফা ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি : এবারের তাপদাহ শেষেই বৃষ্টিপাতের আশা ফরিদপুরে বৃষ্টির জন্য নামাজে হাজারো মুসুল্লির কান্না পোরশার নোচনাহারে আগুনে ৩টি দোকান পুড়ে গেছে খুলনা বিভাগ ও ৬ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপপ্রবাহ

সকল