২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ঈদ উৎসব

-

সুদীর্ঘ এক মাস সিয়াম-সাধনা ও সংযম পালন শেষে ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখার সাথে সাথে প্রতিটি মুসলমান ঈদ উৎসবে মেতে উঠেন। চৈত্রের তাপদাহ শেষে এক পসলা বৃষ্টির মতোই প্রশান্তি। আরবি ভাষায় ‘ঈদ’ অর্থ আনন্দ আর ফিতর শব্দের অর্থ হলোÑ উপবাস ভঙ্গকরণ। ঈদুল ফিতরের অন্তরালে যে সত্যটি লুকিয়ে আছে তা হচ্ছে এক কথায় অসামাজিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
৬২২ খ্রিষ্টাব্দে আমাদের প্রিয়নবী হজরত মোহাম্মদ সা: মদিনায় হিজরত করার সময় লক্ষ করলেন, বছর শেষে কয়েক দিন ধরে তারা ‘নওরোজ’ ও ‘মিহিরজান’ নামে যে উৎসব পালন করতে সেখানে সমাজের উচ্চপর্যায়ের লোকেরা মদ্যপান, কৌতুক, হাস্যরস ও সুন্দরী নারী ভোগে লিপ্ত থাকত। শুধু তাই নয়; জুয়া, খুন-খারাবি, দাঙ্গাসহ নানারকম অসামাজিক ক্রিয়াকলাপে ব্যস্ত থাকত তারা। এসব দেখে নবী সা: ব্যথিত হয়েছিলেন, ভেতরে ভেতরে রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলেন। এমন যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্য হজরত মোহাম্মদ সা: প্রবর্তন করলেন মানবিক উৎসব ‘ঈদুল ফিতর’।
যতদূর জানা যায়, ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ রমজান হজরত মোহাম্মদ সা: বদরপ্রান্তে কাফেরদের সাথে এক হাজার সৈন্যের বিরুদ্ধে মাত্র ৩১৩ জনের মুসলমান সৈন্য নিয়ে নবীজী যুদ্ধ ময়দানে নেতৃত্ব দিয়ে বিজয় নিশ্চিত করেন। যুদ্ধ শেষে রমজান মাসের ২৮ তারিখে রোজাদার মুসলিম সৈন্যদের উদ্দেশে প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মদ সা: ঘোষণা দেন, রমজান শেষে যে চাঁদ উঠবে তা খুশির চাঁদ। শাওয়ালের এই নতুন চাঁদ ঈদের বার্তা নিয়ে আসবে; পয়লা শাওয়াল পালিত হবে ‘ঈদুল ফিতর’। ‘ঈদুল ফিতরের’ চাঁদ দেখার পরপরই সমগ্র মুসলিম বিশ্বে বইতে থাকে আনন্দস্রোত ধারা। এখন তারা ধর্মীয় উৎসবে আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠে। মুসলিম বিশ্ব ঈদের চাঁদ দেখা মাত্রই বাঙালির কণ্ঠে উচ্চারিত হয় কাজী নজরুল ইসলামের লেখা আকাশচুম্বী জনপ্রিয় এ গানটিÑ
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে
এলো খুশির ঈদ
তুই আপনারে আজ বিলিয়ে দে
শোন আসমানি তাগিদ।
তোর সোনাদানা বালাখানা
সব রাহেলিল্লাহ
দে জাকাত মুর্দা মুসলিমে আজ
ভাঙাইতে নিদ।
মূলত সামাজিক মেলবন্ধন, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ এবং সমবণ্টনের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের উদার নীতিমালার বাণীই ধ্বনিত হয়েছে নজরুলের কণ্ঠে।
ঈদের দিন ভোরবেলা মহল্লার মসজিদে, খোলামাঠে এবং ঈদগাহে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। ঈদ জামাতে পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে ভ্রাতৃত্ববোধের বন্ধনে ধনী-গরিব সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ঈদের নামাজ আদায় করেন। মানব প্রীতি এবং সমতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ; ক্ষণিকের জন্য হলেও সবাইকে মনে করিয়ে দেয়Ñ সম্প্রীতি আর সাম্যের প্রতীক ঈদ।
ঈদ জামাত শেষে একে অপরের গায়ে বুক মিলিয়ে পরস্পর ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করে; কণ্ঠে ধ্বনিত হয় ঈদ মোবারক। এক মাসের সিয়াম-সাধনা তথা আত্মশুদ্ধি শেষে ঈদ আসে আনন্দ-উল্লাসের বার্তা নিয়ে।
ঈদের নামাজ শেষে বড়দের সালাম ও মিষ্টিমুখ করা উৎসবেরই অলিখিত শর্ত। বিভিন্ন ধরনের রান্না করা সেমাই, পায়েসের পাশাপাশি মুখরোচক ঝাল খাবারের ব্যবস্থাও থাকে। প্রায় সব ঘরেই দুপুরে পোলাও গোসত, কোর্মা-কালিয়াসহ খাবার ঈদ উৎসবের মাত্রা বাগিয়ে দেয়। যে যার সাধ্যানুযায়ী খাবার তৈরি করে।
খাবারের সাথে শিশু কিশোর কিশোরীদের মধ্যে নতুন জামা কাপড় পরিধানের রেওয়াজ রয়েছে সেই ঈদ উৎসবের শুরু থেকেই। বাবা-মা তাদের সামর্থ অনুযায়ী তার সন্তানের জন্য পোষাক পরিচ্ছদ কেনা কাটা করেন, মেয়েদের জন্য প্রসাধনী তবে থাকবেই। তবে শিশু কিশোরদের মধ্যে ঈদের নতুন জামা কাপড় লুকিয়ে রাখার প্রবণতা লক্ষ করা যায়; তাদের মতে ঈদের নতুন জামা কাপড় আগেভাগে দেখে ফেললে ঈদ পুরনো হয়ে যায়। আজকাল সালামি দেয়ার প্রথাটা শিশুদের জন্য অনেক বড় পাওয়া। বড়দের সালাম করে সালামি আদায় অনেকটা বাড়তি পাওনা।
ঈদের সালামি এবং জামা কাপড়ের প্রসঙ্গ এলেই কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কবিতার চরণ মনে পড়াটাই স্বাভাবিক। ‘জীবন যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসেনি নিদ, দরিদ্র সে কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?’ মূলত ঈদ এসেছে সবার জন্য; ঈদে সবাই যেন আনন্দ-উৎসবে মেতে উঠতে পারে তার বিধানও কিন্তু আমরা ইসলামের দিকনির্দেশনাতে দেখতে পাই। দুস্থ, অসহায় মানুসের দুঃখ লাঘবের জন্য ইসলাম ধর্মে ফিতরা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। ঈদের দিনের আগের রাত পর্যন্ত যত লোক সংসার থাকবে তাদের প্রত্যেকের জন্য ফিতরা দেয়া আবশ্যক। একটি ফিতরা ১ কিলো ৬৩৩ গ্রাম গম অথবা এর বাজার মূল্য অনুযায়ী সমপরিমাণ অর্থ। সমাজের অসহায়, গরিব-দুঃখী, ফকির-মিসকিন এরাই ফিতরা পাওয়ার যোগ্য। সমাজের এই শ্রেণীর মানুষগুলোই প্রকৃত ফিতরার দাবিদার এবং ফিতরা এদের হক। সমাজের বিত্তবানেরা যদি তাদের ফিতরার অর্থ গরিব, দুঃখী, এবং অসহায় মানুষের মধ্যে বিতরণ করেন তাহলে ঈদ প্রকৃত অর্থে উৎসবে পরিণত হবে। ক্ষুধায় যাদের ঘুম আসেনি তারাও সমভাবে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নিতে পারবেন।
কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার মর্মবাণী আর ঈদের আনন্দ এক ও অভিন্ন। আমাদের সাহিত্য ভাণ্ডারে ‘ঈদ’ যেন গোলাভরা ফসলের মতোই আনন্দে পরিপূর্ণ। ঈদ নিয়ে কবিরা ইতঃপূর্বেও কবিতা লিখেছেন এখনো লিখছেন। পরিপূর্ণ হচ্ছে সাহিত্য ভাণ্ডার। বিভিন্ন কবির বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকাটাই স্বাভাবিক। ধর্মীয় মূল্যবোধ, ইতিহাস সচেতনতা, নীতিকথা সমাজ সচেতনতা, সমাজের অসহায় মানুষের কথা দিয়েই নির্মিত হয়েছে কবিতার শরীর।
কবি মোজাম্মেল হক (১৮৬০-১৯৩৩) ঈদ শিরোনামে যে কবিতাটি লিখেছেন তার উদ্ধৃতাংশ দেখে নেয়া যাকÑ
মুসলেমের আজ ঈদ শুভময়
আজ মিলনের দিন
গলায় গলায় মাখামাখি
আমরা ফকির হীন
আজ সবারি হস্ত পূত
ধোওয়া স্মরণ নীড়ে?
তাই যে চুমুর ভিড় লেগেছে
নম্র নত শিরে
[ঈদ/মোজাম্মেল হক/মোসলেম ভারত, জৈষ্ঠ্য ১৩২৭]
১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে নবনূর পত্রিকার ঈদ সংখ্যাতে ‘ডালি’ নামে সৈয়দ এমদাদ আলীর কবিতাটি ছাপা হয়। ১১৫ বছর আগে প্রকাশিত ঈদ কবিতাটি সম্ভবত ঈদবিষয়ক প্রথম কবিতা।
কুহেলি তিমির সরায়ে দূরে
তরুণ অরুণ উঠিছে ধীরে
রাঙিয়া প্রতি তরুর শিরে
আজ কি হর্ষ ভরে!
আজি প্রভাতের মাদল বায়
রঙে নাচিয়া যেন কয়ে যায়
মুসলিম জাহান আজি একতায়
দেখ কত বল ধরে?
[ঈদ/ডালি]
এখানে উল্লেখ থাকে যে, সৈয়দ এমদাদ আলী সম্পাদিত নবনূর পত্রিকার ঈদসংখ্যায় কবিতাটি প্রথম ছাপা হয়। পরে এই কবিতাটি তার ডালি নামক কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণে অন্তর্ভুক্ত হয়।
ঈদবিষয়ক কবিতা প্রসঙ্গ শেষে হাল আমলের ঈদ উৎসবের কথা না বললেই নয়, উৎসব সর্বজনীন। কিভাবে উৎসবের আনন্দ ভাগ করে নেবেন এটা একান্তই তার নিজস্ব। ঈদ উৎসবের আনন্দ সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার জন্য প্রিন্ট মিডিয়া এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে। দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক পত্রিকার পাশাপাশি বিনোদনমূলক পত্রিকাগুলো ঈদ এলেই ঢাউস সাইজের ঈদ সংখ্যা প্রকাশ করে। ঈদবিষয়ক প্রবন্ধ নিবন্ধ, শিল্পকলা, ভ্রমণ কাহিনী-উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা, ছড়াসহ বিনোদনমূলক ফিল্মি পাড়ার হালনাগাদ খবরসহ ঈদসংখ্যা সাজাতেই ব্যস্ত, কেননা ঈদ মানেই ঈদ ম্যাগাজিন।
কেবলি প্রিন্ট মিডিয়া, ঈদ উপলক্ষে সব বয়সের শ্রোতা ও দর্শকদের বিনোদনের কথা ভেবে চ্যানেলগুলো একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতায় নামে, কে কত বেশি বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান দর্শকদের উপহার দেবে। ঈদের দিন থেকে লাগাতার সাত দিন কোনো কোনো চ্যানেল আরো বেশি দিন ধরে ঈদ উৎসবের অনুষ্ঠানমালা প্রচার করে। নাটক, টেলিফিল্ম, রকমারি, রান্না, উঠতি মডেল তারকাদের নিয়ে আড্ডা, টকশো ঈদ একাল সেকাল, ছায়াছবির গান, কৌতুক, নাচসহ নানাবিধ বিষয়ে সাজানো অনুষ্ঠান।
ঈদের ছুটি মাথায় রেখে শহরের আধুনিক বিনোদনকেন্দ্রগুলো শিশুদের মনোরঞ্জনের বিশেষ ব্যবস্থা করে থাকেন। বিভিন্ন রাইডে হ্রাসকৃত মূল্যের ব্যবস্থা করা নানা ধরনের উপহার।
ঢাউস ঢাউস ঈদ ম্যাগাজিন প্রকাশিত লেখার সাহিত্য বিচারে নানা মুনির নানা মত থাকলেও এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচারিত অনুষ্ঠানমালার মান নির্ণয়ে নানা মনির নানা মত থাকলেও একথা মানতেই হবে যে ঈদ ম্যাগাজিন এবং চ্যানেল প্রচারিত অনুষ্ঠানমালার অবদান স্বীকার করতেই হবে। ঈদ আনন্দ উৎসবে ঈদ ম্যাগাজিন ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান, পাঠক, দর্শক এবং সাধারণের কাছে উৎসবের বাড়তি পাওনা। উৎসবপ্রিয় জাতি আনন্দস্নানে অবগাহন করলে ক্ষতি কী!
ঈদ উৎসব এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ লিখতে গিয়ে নজরুল ইসলামের ঈদ নাটিকায় মাহতাবের কণ্ঠে উচ্চারিত সংলাপ যে আমাদেরও। মাহতাবের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরাও বলিÑ আমি আল্লাহকে পেলাম। অর্থাৎ তারই অস্তিত্ব তারই ইচ্ছার সৃষ্টি তোমাদের সকলকে পেলাম, তাই আমার ঈদ ফুরায় না, আমার ঈদ ফুরায় আবার আসে।’
ঈদ উৎসব হোক সবার জন্য। অনন্তপক্ষে ঈদের দিনে আমরা সবাই মনের কালিমা দূর করে, হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে, একে অপরের সাথে বুক মিলিয়ে ঈদ উৎসব ভাগাভাগি করে নেব। বিলিবণ্টন করে নেব সৌহার্দ আর সম্প্রীতি। তাহলে আমাদের জীবনে ঈদ তার পূর্ণতা পাবে। ঈদ আনন্দ সর্বত্র ছড়িয়ে যাক; প্রশান্তির সুবাতাস বয়ে যাক, ঈদ সবার জন্য হোক নির্মল উৎসবের নাম, এ প্রত্যাশায় কবির কণ্ঠে কণ্ঠে মিলিয়ে বলিÑ
ঈদ মোবারক হোক আজি ঈদ মোবারক হোক
সবঘরে পহুচুক এ ঈদের চাঁদের আলোক।


আরো সংবাদ



premium cement
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ২৮ এপ্রিল খুলে দেয়ার প্রস্তুতি, ক্লাস চলবে শনিবারও মিরসরাইয়ে জুস খাইয়ে অজ্ঞান করে লুট, মূল হোতা গ্রেফতার বৃষ্টি কামনায় ঈশ্বরগঞ্জে জামায়াতে ইসলামীর ইসতিসকার নামাজ আদায় কুবিতে আল্টিমেটামের পর ভিসির কার্যালয়ে তালা ঝুলাল শিক্ষক সমিতি সাজেকে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ শ্রমিক নিহতের খবরে ঈশ্বরগঞ্জে শোক দুর্যোগে এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যু কেন বাংলাদেশে? জবিতে ভর্তি পরীক্ষায় আসন বেড়েছে ৫০টি বিএনপি ক্ষমতায় আসতে মরিয়া হয়ে উঠেছে : ওবায়দুল কাদের মাটির নিচে পাওয়া গ্রেনেড মাইন মর্টার শেল নিষ্ক্রিয় করল সেনাবাহিনী অনির্দিষ্টকালের জন্য অনলাইন ক্লাসে যাচ্ছে জবি, বন্ধ থাকবে পরীক্ষা কুড়িগ্রামে রেলের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদ

সকল