২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

উচ্চমূল্যের শিল্পবাজার

-

বর্তমান যুগে সভ্য মানুষের উদ্ভাবিত উন্নত প্রযুক্তির স্পর্শে সমৃদ্ধ শিল্পকলার প্রতি দৃষ্টি রেখে পেছনের দিকে যাত্রা করলে সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম শেষে গুহাযুগে গিয়ে উল্টো যাত্রার পরিসমাপ্তি ঘটবে। কারণ তারপরে আর শিল্পকর্মের সন্ধান পাওয়া যায় না। গুহায় বসবাসরত আদিম অশিক্ষিত মানুষেরা তখন বন্য জীবজন্তু শিকার করে সেই সব জন্তু জানোয়ারের মাংস খেয়ে জীবন ধারণ করত। এ সব অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে কেউ কেউ সহজে পশু শিকার কিভাবে করা যায় তার উপায় খুঁজতো। এভাবেই চিন্তাভাবনার একপর্যায়ে কেউ কেউ গুহার দেয়ালে জীবজন্তু চিত্র আঁকার পরিকল্পনা করে। শুরু হয় গুহার দেয়ালে ছবি আঁকা। বাইসন, হরিণসহ নানা ধরনের জীবজন্তুর ছবি দেয়ালে আঁকার পর সেগুলোর শরীরে তীর, বল্লম বিদ্ধ করার চিত্রও আঁকলো। যারা এ ধরনের চিত্র আঁকলো তারা অন্যদের বুঝাল যে, এ ধরনের চিত্র আঁকার ফলে বাস্তবে পশু শিকার সহজ হবে। সহজেই পশুকে কাবু করা যাবে। চিত্রকরদের এই প্রচারণায় অন্যরা বিশ্বাস স্থাপন করে। অনেকে একে জাদুবিদ্যার সাথে তুলনা করেছেন। অর্থাৎ তৎকালে যে চিত্র আঁকা হয়েছে তা তার সৌন্দর্য উপভোগের জন্য নয়, বরং সেগুলো আঁকা হয়েছে জাদুটোনা হিসেবে যাতে করে সেই জাদুটোনার প্রভাবে জীবজন্তু বা পশুরা দুর্বল হয়ে পড়ে আর সহজেই সেগুলোকে শিকার করা যায়। জাদুটোনা আসলে একধরনের ক্ষতিকর প্রক্রিয়া। যার মাধ্যমে মানুষের ক্ষতি করা কিংবা মানুষকে বশে আনা যায়। এমনকি হত্যা পর্যন্ত করা যায়। এমন ক্রিয়াকর্মে এখনো বিশ্বাস করে অনেক মানুষ। সুতরাং গুহাচিত্রগুলো তৎকালের মানুষের কাছে ছিল মারণাস্ত্র, শিল্প নয়। কারণ শিল্পের গুরুত্ব বিষয়ে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না যেমনটি সভ্য যুগের মানুষের মধ্যে রয়েছে। শিল্প হিসেবে গুরুত্ব না দেয়া কিংবা শিল্পের রূপমোহে আক্রান্ত না হলেও গুহাবাসীর আঁকা চিত্রগুলো শিল্পের ইতিহাসে অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে। কিছু কিছু চিত্রকর্ম মাস্টারপিস হিসেবেও অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে। কিছু কিছু চিত্রকর্ম মাস্টারপিস হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছে। গুহাবাসীর আঁকা সেই সব চিত্র থেকেই শিল্পকলার যাত্রা শুরু। এরপর সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে শিল্পের ক্ষেত্র যেমন বিস্তৃত হয়েছে তেমনি শিল্পের ঘটেছে উন্নয়ন, বৃদ্ধি পেয়েছে শিল্পের মর্যাদা। গড়ে উঠেছে শিল্প সংরক্ষণের জাদুঘর বা সংগ্রহশালা। গড়ে উঠেছে চিত্রশালা এবং বাণিজ্যিক আর্টগ্যালারি। ফলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যেমন সংগৃহীত হচ্ছে শিল্পকর্মে তেমনি সংগৃহীত হচ্ছে ব্যক্তি পর্যায়েও। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আর্ট গ্যালারিগুলো নিয়মিত শিল্পকর্মের প্রদর্শনী এবং বিক্রি করে থাকে। তবে ঠিক কবে থেকে যে শিল্পকর্ম বিক্রি শুরু হয়েছে কিংবা কে বা কারা কিংবা কোন প্রতিষ্ঠান প্রথম শিল্পকর্ম ক্রয় করেছে তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না।
শিল্পকর্ম সাধারণত ক্রেতাসাধারণ আর্ট গ্যালারি থেকেই ক্রয় করে থাকেন। আর্ট গ্যালারি শিল্পীদের শিল্পকর্মের প্রদর্শনীর আয়োজন করার মাধ্যমে এবং গ্যালারির নিজস্ব সংরক্ষণ থেকেও বিক্রি করে। কখনো কখনো সরাসরি শিল্পীর কাছ থেকেও ক্রয় করে থাকেন ক্রেতারা। এটিই শিল্পকর্ম বিক্রির স্বাভাবিক নিয়ম। তবে নিলামকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও অনেক ক্রেতা এবং প্রতিষ্ঠান শিল্পকর্ম ক্রয় করে। নিলামকারী প্রতিষ্ঠান থেকে যারা ক্রয় করেন তাদের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অস্বাভাবিক উচ্চমূল্যে ক্রয় করতে হয়। এ ধরনের নিলামকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আন্তর্জাতিক নিলামকারী প্রতিষ্ঠান সোথবি, লটস রোড, অকশন এবং বোনহ্যামসের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে সর্বাধিক জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান হচ্ছে সোথবি। সোথবি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন শাখা রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে। ২০১১ সালে রেকর্ড পরিমাণ শিল্পকর্ম বিক্রি করেছে সোথবি। সোথবির চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার কেভিন চিং বলেছেন যে, ‘২০১১ সাল ছিল প্রকৃত অর্থে উল্লেখ করার মতো বছর। কারণ এ বছর শত কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে শিল্প বিক্রির অর্থ। সোথবির ইতিহাসে এটি মাইলস্টোন হিসেবে বিবেচিত হয়েছে’ Leading Asia, the US $ one Billion Milestone, 2011, sothby's]. শত কোটি ডলার বাংলাদেশী টাকায় আট হাজার কোটি। ২০১১ সালের বিক্রি হওয়া চিত্রের মধ্যে চীনা শিল্পী চ্যাং ডাই-ছিন-এর ‘পদ্ম এবং ম্যান্ডারিং হাঁস; শিল্পী জাও উ-কী’র ‘বিমূর্ত চিত্র, শিল্পী চু তে চুন-এর ‘ইনস্পিরেশন হিভারনাল, শিল্পী উ গুয়ানঝং-এর ‘লিজিং নদী; শিল্পী জুমিং-এর ‘তাইসি সিরিজ সিংগেল হুইপ’; শিল্পী ঝাং ডাকিয়ান-এর ‘অ্যানসিয়েন্ট টেম্পল অ্যামিহস্ট ক্লাউড’ একই শিল্পীর ‘সেল্প পোট্রেইট ইন দি ইয়েলো মাউন্টেইন’; শিল্পী ফু বাওসি’র ‘বোটিং আন্ডার দি উইলোজ’, শিল্পী উ গুয়ানঝং-এর ‘দি লায়ন গ্রোভ গার্ডেন’- শিল্পী ঝাং জিয়াংওগ্যাং-এর ‘ফর এভার লাস্টিং লাভ’; একই শিল্পীর চিত্র ‘ব্লাডলাইন : বিগ ফ্যামিলি নং-১’; শিল্পী জেং ফাঞ্জির ‘মাস্ক সিরিজ ১৯৯৮ নং-৫’, শিল্পী লিউ ইয়ের ‘পোট্রেইট অব কুইবাইশি এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শিল্পী রোনাল্ড ভেনচুরার ‘গ্রেগ্রাউন্ড’; শিল্পী এস সুদজজনো’র ‘গার্ড ফর মাদারল্যান্ড’; শিল্পী চিওং সু পিং-এর ‘বেলিনিজ গার্ল’; এবং শিল্পী হেন্ড্রা গুনাওয়ান-এর ‘পেনারি উলার (স্নেক ড্যান্সার)’ চিত্রগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
২০১১ সালের অকশন বা নিলামে যেসব চিত্রকর্ম বিক্রি হয়েছে তার প্রায় সবই চীনা শিল্পীদের অঙ্কিত চিত্র। এসব চিত্র প্রাচীন আমল থেকে সাম্প্রতিক সময়ে আঁকা। দি সেই ইউন ট্যাং সংগ্রহের চ্যাং ডাই-চিন-এর আঁকা চিত্র পদ্ম এবং ম্যান্ডারিন ডাক নামক চিত্রটি বিক্রি হয়েছে ২৪,৪,৯৪,৮৭২ আমেরিকান ডলারে। অর্থাৎ বাংলাদেশী ১৯৬,৯৫,৮৯,৭৬০/- (এক শ’ নব্বই কোটি পঁচানব্বই লাখ ঊননব্বই হাজার সাত শ’ ষাট টাকা)! আশ্চর্য হওয়ার মতো মূল্য। এত উচ্চমূল্যে কোনো শিল্পী নিজ উদ্যোগে চিত্র বিক্রি করেছেন এমন খবর পাওয়া যায় না। এটি নিলামকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষেই সম্ভব। নিলামে চিত্রকর্ম বিক্রির ক্ষেত্রে শিল্পী জাওউ-কীর চিত্র (বিমূর্ত) বিশ্বরেকর্ড সৃষ্টি করেছে। শিল্পীর এ চিত্র বিক্রি হয়েছে ৮৮,৪৩,৫৯০ ডলারে। অর্থাৎ এই শিল্পীর চিত্রকর্ম ইতঃপূর্বে এর চেয়ে অধিক মূল্যে বিক্রি হয়নি। শিল্পী উ গোয়ানঝং-এর সিনারি অব দ্য লিজিং রিভার নামক চিত্রটি একেবারেই বাস্তবধর্মী। ক্যামেরার সাহায্যে কোনো প্রাকৃতিক দৃশ্যের চিত্র তোলা হয়েছে এমন অনুভূতি জাগ্রত করা এই চিত্রের বিক্রয়মূল্য ৩৩,৮৭,১৭৯ ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশী ২৭,০৯,৭৫,০২০/- (সাত শ’ কোটি নয় লাখ পঁচাত্তর হাজার বিশ টাকা। কিছু কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রবন্ধে উল্লিখিত প্রায় সব শিল্পীর চিত্রের মূল্য এ চিত্রের অনুরূপ। ব্যতিক্রমী উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়েছে শিল্পী ঝাং জিয়াওগ্যাং-এর ‘ফরএভার লাস্টিং লাভ’ নামক চিত্র (১০,১৩৫,৮৯৭ ডলার), শিল্পী হেন্ড্রা গুনাওয়ান-এর পেনারি উলার নামক চিত্র ২,০৯৪,৮৭২ ডলার মূল্যে বিক্রি হয়েছে। সম্প্রতি নিলামে চিত্রকর্ম বিক্রির ক্ষেত্রে আরো আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটেছে। ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর নিউ ইয়র্ক বেজড ক্রিস্টিজ নিলাম হাউজ (Christies auction house) আবুধাবির সংস্কৃতি ও টুরিজম বিভাগের কাছে বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা ‘সালভাটর মুন্ডি’ নামক যীশুখ্রিষ্টের প্রতিকৃতি ৪৫০ মিলিয়নেরও অধিক মূল্যে (আমেরিকান ডলার) বিক্রি করেছে। যার মূল্য বাংলাদেশী টাকায় তিন হাজার ছয় শ’ কোটি টাকারও অধিক (৩৬০০,০০,০০,০০০/-) চিত্রটি প্রিন্স বদর বিন আব্দুল্লাহ আল সউদ আবুধাবির জন্য নিলাম থেকে ক্রয় করেছেন বলে জানা গেছে। এও জানা গেছে যে, প্রিন্সকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ডাকার অনুমোদন দেয়া হয়েছিল চিত্র ক্রয়ের জন্য। এ ইউএই (A uae) সরকারের অফিস মারফত জানা গেছে যে, চিত্রটি আবুধাবি সরকারের সম্পদ হিসাবে আবুধাবি লুভর মিউজিয়ামে সংরক্ষিত থাকবে। যাতে জনগণ চিত্রটি উপভোগ করতে পারেন। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি চিত্রটি ১৫০০ সালে এঁকেছিলেন বলে জানা গেছে। অর্থাৎ তার মৃত্যুর ১৯ বছর আগে আঁকা এ চিত্র।
উচ্চমূল্যের শিল্পবাজারে বাংলাদেশের শিল্পীদের শিল্পকর্ম উচ্চমূল্যে বিক্রির ঘটনা সাম্প্রতিককালের। সম্ভবত শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের চিত্রকর্ম বিক্রির মাধ্যমে এ শুভ সূচনার শুরু। শিল্পীর বেশ কিছু চিত্র বিক্রি হয়েছে। ১৯৯৯ সালে সোথবি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের দু’টি ছবি নিলামে বিক্রি করেছে ৩৫,০০০ আমেরিকা ডলারে। অর্থাৎ বাংলাদেশী প্রায় ২৮ লাখ টাকায়। এর পর ক্রমান্বয়ে আরো কয়েকজন শিল্পীর চিত্রকর্ম নিলামে বিক্রির খবর পাওয়া গেছে। অর্থাৎ ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশের শিল্পীদের চিত্রকর্মও বিদেশে জনপ্রিয় যে হচ্ছে এ খবর তারই প্রমাণ বহন করছে। শিল্পী আব্দুস সাত্তার, অর্থাৎ আমার একটি ‘স্টিল লাইফ উইথ ফ্লাওয়ার ভ্যাস’ নামক চিত্রও নিলামে বিক্রি হয়েছে বলে জানা গেছে। ভবিষ্যতে হয়ত বাংলাদেশের শিল্পীদের চিত্রকর্মও উল্লেখ করবার মতো উচ্চমূল্যে বিক্রি হবে উচ্চমূল্যের শিল্পবাজারে। এ প্রত্যাশা নিশ্চয়ই অমূলক নয়। কারণ বাংলাদেশেও খ্যাতিমান শিল্পীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement
গণকবরে প্রিয়জনদের খোঁজ কক্সবাজারে ভুল চিকিৎসায় প্রসূতির মৃত্যু, স্বজনদের হাসপাতাল ঘেরাও বঙ্গোপসাগরে ১২ নাবিকসহ কার্গো জাহাজডুবি ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশকে ‘নেট সিকিউরিটি প্রোভাইডার’ হিসেবে দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র রাজশাহীতে তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৮ ডিগ্রি রাজশাহীতে টানা তাপদাহ থেকে বাঁচতে বৃষ্টির জন্য কাঁদলেন মুসল্লিরা শরীয়তপুরে তৃষ্ণার্ত মানুষের মাঝে পানি ও খাবার স্যালাইন বিতরণ জামায়াতের এক শ্রেণিতে ৫৫ জনের বেশি শিক্ষার্থী নয় : শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী নজিরবিহীন দুর্নীতির মহারাজার আত্মকথা ফতুল্লায় ১০ লাখ টাকা চাঁদার দাবিতে নির্মাণকাজ বন্ধ, মারধরে আহত ২, মামলা পার্বত্যাঞ্চলে সেনাবাহিনী: সাম্প্রতিক ভাবনা

সকল