২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চলে যাওয়া দিন

-

আমাদের ছেলেবেলা কেটেছে প্রচুর হাসি-খুশি-আনন্দ আর হৈ-হুল্লোড়ের মাঝে। প্রকৃতি তখন স্বাভাবিক নিয়মেই ধরা দিতো। ষড়ঋতু আলাদা আলাদা বৈচিত্র্য নিয়েই আবির্ভূত হতো আমাদের মাঝে।
প্রায় ৬০-৬৫ বছর আগের কথা। বৈশাখ মাসে তখন নদী, খাল-বিল, পুকুর, ডোবা, নালা ও খানাখন্দ প্রায় যেত শুকিয়ে। আমরা সেই অল্প পানিতে বাঁধ বেঁধে পানি সেচে, ঠেলাজাল, পলো ও চালুনির সাহায্যে নানা প্রজাতির মাছ ধরতাম। বিলের মাঝে ছোট ছোট ডোবায় বর্ষাকালে ডাল-পালা দিয়ে ভরে রাখা হতো। একে বলা হতো পালা। পানি কমার সাথে সাথে বিলের মাছ সেই পালার মাঝে আসতো চলে। ডোবা থাকতো মাছে পরিপূর্ণ হয়ে। সেচের পর বড় বড় শৈল, টাকি, গজাড়, কৈ, শিং ও মাগুর মাছ ধরা হতো। সেই মাছ বহনের জন্য ব্যবহার হতো গরুর গাড়ি। বাড়িতে আনার পর মাটির পাত্র, বড় বড় জালুই, কোলা, নান্দায় পৃথকভাবে জিইয়ে রাখা হতো মাছ।
গ্রামের পাশে পদ্মবিল, মুচি বিলে কচুরিপানা টেনে তাতে আঁকড়ে থাকা বড় বড় বুক হলুদ রঙের কৈ মাছ ধরা, এড়োল বিলে ইঁদুরের গর্ত ( শোড়া) সামান্য পানিতে লুকিয়ে থাকত সে মাছ। শাবল, কোদাল দিয়ে খোঁড়ার পর নালাভরতি মাছ দেখে আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠতাম। সেই দৃশ্য আজো চোখের সামনে ভাসছে।
বৈশাখ মাসে কখনো অনাবৃষ্টি হলেই আমরা মসজিদে বৃষ্টির জন্য মানত করতাম। বাড়ি বাড়ি ঘুরে জোগাড় হতো চাল, দুধ, গুড় ও নারিকেল। মসজিদের এক পাশে রান্না হতো সেই শিন্নি। কাদা মাটি নিয়ে খেলার মাঝে সমস্বরে গেয়ে উঠতাম ‘আল্লাহ্ মেঘ দে পানি দে, বৃষ্টি দেরে তুই আল্লাহ্ মেঘ দে...’।
বৈশাখ মাসে আমের গুঁটি বড় হলেই আমরা দল বেঁধে যেতাম আম বাগানে। কাঁচা আমের প্রতি ছিল খুবই লোভ। কোমরে বেঁধে রাখতাম ছোট কাপড়ের মাঝে ছুরি আর চাকু। আম কাটার জন্য ঘসা ঝিনুক। কৌটায় ভরতি থাকত লবণ ও মরিচের গুঁড়া। কাঁচা আম ছিলে মেখে খেতাম খুব মজা করে। ওই সময়ে আমরা একটা ছড়া কাটতাম :
পোষে কুশি মাঘে বোল,
ফাগুনে গুটি, চৈত্রে আঁটি
বৈশাখে কাটি কুটি,
জ্যৈষ্ঠে দুধের বাটি,
আষাঢ়ে বাজায় বাঁশি।
অর্থাৎ আষাঢ় মাসে ফেলে রাখা সেই আঁটি ঘষে আমরা বাজাতাম ভেপুবাঁশি। জ্যৈষ্ঠ মাসে আমরা বেশি দুরন্ত হতাম। ঝড় উঠলেই মুরব্বিদের বাঁধা নিষেধ অমান্য করেই ছুটে যেতাম আমগাছ তলায়। পাকা আম কুড়ানোর কী মজা; কী আনন্দ। ঝড়ে কুড়ানো পাকা আম আর আমসত্ত্বা দুধভাতের সাথে মিশ্রিত সেই অমৃতের স্বাদ এখনো আমার মুখে লেগে আছে।
এ ছাড়া, গাছে উঠে পাকা জাম পেড়ে খেয়ে মুখ রঙিন করার স্মৃতি, খেজুর গাছে কাদি হতে পাকা খেজুর পাড়া, পাকা কাঁঠাল পেড়ে গাছ তলায় বসে টপাটপ করে খাওয়ার প্রতিযোগিতা। এমনি ছিল আমাদের ছোট ছোট দুষ্টমি আর মহা উপভোগ। আষাঢ় মাসে বর্ষাকালে বৃষ্টির পানিতে মাঠ-ঘাট খাল বিল নদীনালা থৈ থৈ করত পানিতে। ওই সময় একটা প্রবাদ ছিল শনি সাত, মঙ্গল তিন, আর যা হবে তা দিন দিন। এই প্রবাদগুলো আমরা অক্ষরে অক্ষরে এর প্রতিফলন দেখেছি।
বৃষ্টি শুরু হলেই বৃষ্টির মাঝেই চলত ফুটবল খেলা। পুকরে দল বেঁধে পানিতে নেমে ঝাঁপা ঝাঁপি, সাঁতার কাটায় মেতে উঠতাম। বিভিন্ন বিল, পুকুর হতে শাপলা তোলা। আমাদের ছিল বড় বিলে বাঁধাল। পাটা দিয়ে ঘিরে রাখা সেই বাঁধালে সারারাত জেগে বড়রা ঝাঁকি জাল দিয়ে মাছ ধরতেন। আমরা খুব সকালে ছুটে যেতাম সেই বাঁধালে। এত বেশি মাছ পাওয়া যেতো তা কুটবার মতো পাড়ায় মানুষ পাওয়া যেত না। ফলে প্রতিবেশির বাড়িতে অনেক সময় মাছ বিলিয়ে দেয়া হতো। এ ছাড়া দোড়, ঘুনি, চারো, আরিন্দা প্রভৃতি জাল পেতেও বাঁধালে ধরা হতো মাছ। সন্ধ্যায় আবার অনেক দিন কোচ দিয়ে আলো কাটায় (আলো জ্বেলে মাছ ধরা) অনেক মাছ ধরেছি। চারিদিকে শুধু মাছ আর মাছ। যেখানেই পানি সেখানেই মাছ। শ্রাবণ মাস ধরেই ঝরতো অবিরাম বৃষ্টি। একবার বৃষ্টি শুরু হলে থামার আর কোনো লক্ষণ ছিল না। বাজারে দু’চারটি দোকান পাট যা ছিল তাও থাকত বন্ধ। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অভাবে মানুষের কষ্টের সীমা ছিল না। বিশেষ করে কেরোসিন তেলের অভাবে বাড়িতে অনেক দিন রাতে আলোই জ্বলতো না। রোদ না থাকায় ধান সিদ্ধ-শুকানোর অভাবে তা চুলার ধারে শুকানো হতো। পরে ঢেঁকিতে কুটে সেই চালের ভাত রান্না হতো। এ ছাড়া ঘরে থাকা ভুরোর চাল, চিঁড়ে, খৈ, মুড়ি দিয়েও অনেক সময় খেতাম। খাদ্যাভাবে অনেকেই তখন গাছের কাঁঠাল পেড়ে তা সিদ্ধ করেও খেতে দেখা গেছে।
ভাদ্র আশ্বিন মাসজুড়েই থাকতো বর্ষা। এ সময় আমরা বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে যেতাম নদী বিলে পুকুরে। বড়শিতে মাছের খাদ্য (টোপ) হিসেবে ব্যবহার করতাম কেঁচো, বল্লার টোপ, নালিশার টোপ, ভাত ইত্যাদি। বড়শি দিয়ে মাছ ধরার যে কী মজা, কী আনন্দ সেই অনুভূতি প্রকাশের নয়, উপলব্ধির ব্যাপার।
ওই সময়ে শীতকালে এক মাসব্যাপী স্কুল বন্ধ হতো। পূজার ছুটিতে ওই সময় ঘুরে বেড়াতাম কুটুমবাড়িতে। সেখানেও ছিল এক অনাবিল আনন্দময় পরিবেশ।
কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে শুরু হতো মাঠের পাকা ধান কাটা ও ফসল উঠানোর মওসুম। গরুর গাড়িতে করে মাঠের ধান আনা হতো বাড়ির খলেনে। ধান পালা দেয়া রাখা হতো সরাসরি সেই ধানের স্তূপ (গাদা) মাঝে চলতো আমাদের লুকোচুরি খেলা। নবান্নের নতুন ধানের চালে, ঘনদুধ, খেজুরের গুড় দিয়ে রান্না ক্ষির-পায়েস পাঠানো হতো মসজিদে। আমরা সারিবদ্ধভাবে বসে খেতাম, সেই ক্ষিরের স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে আমার।
পৌষ-মাঘ এলেই আমরা খুব বেশি চঞ্চল হয়ে উঠতাম। শীতে ব্যবহার করতাম সোয়েটার, চাদর ও মাফলার। বেশি শীত পড়লে গ্রামের মানুষেরা শীত নিবারণের জন্য আগুন জ্বালানো হতো। আগুনের চারিপাশে ঘিরে বসে আগুনে হাত-পা শরীরে তাপ নিতাম। গ্রামের মানুষেরা একে বলতেন আগুন তোয়ানো।
সন্ধ্যা নামার সাথে পাট কাঠির নল দিয়ে ছুটতাম খেজুর বাগানে। বড় খেজুর গাছে ভাড়ে সেই নল ঢুকিয়ে মিষ্টি রস পান করার কথা সহজে ভোলা যায়? এরপর মাঠ থেকে ছোলা উঠিয়ে ছোলা পোড়া (হুড়া) খেয়ে ফিরতাম বাড়িতে। এর মাঝেও ছিল এক নির্মল আনন্দ।
শীতের সকালে সেই রস বাড়িতে আনার পর ভাড়ের সবচেয়ে লাল টকটকে রস খেতাম কাঁসার বাটি ও গ্লাসে। আর জ্বালুয়ে রস জ্বাল দেয়ার সময় বারবার খোঁজ নিতাম চূলা হতে কখন জ্বালুই নামবে। গুড় ঢালার পর জ্বালুয়ের ধারে পড়তাম হুমড়ি খেয়ে। বাঁশের চোচ দিয়ে খেতাম সেই গুড়। সে এক আনন্দ।
শীত মৌসুমে বাড়িতে চলত পিঠা তৈরির ধুম। চিতই পিঠা তৈরি শেষে সন্ধ্যায় তাত রসের হাঁড়িতে ভিজিয়ে রাখা হতো সেই পিঠা। সকালে উঠেই থালা নিয়ে বসতাম রোদ পিঠ করে। খেতাম পেট পুরে, যত খুশি তত পিঠা খাও। আবার শীতের সকালে পানিবিহীন কড়কড়ে ভাত খেতাম ঘন দুধ, গুড় অথবা কলা দিয়ে। মাঝে মাঝে আবার রসের ক্ষির তৈরি হতো। সকালে তখন রুটি খাওয়ার প্রচলন ছিল না। যারা খুবই গরিব একমাত্র তারাই খেতেন রুটি।
ফাল্লুন, চৈত্র মাসে শুকনা মৌসুমে বিভিন্ন খেলায় উঠতাম মেতে। ডাঙ্গুলি, মার্বেল, কাচের মার্বেলে হার-জিত খেলা, দাড়িচা, হা-ডু-ডু, গোল্লাছুট, কানামাছি, ঘুড়ি উড়ানো ইত্যাদি। এসব খেলার মাঝে পেতাম নির্মল এক আনন্দ।
এভাবেই আমাদের ছেলেবেলার বারো মাস কেটেছে হাসি-খুশির মাঝে, নির্মল আনন্দময় ভূবনে। সত্যিকার অর্থে, সে সময়ে মহান আল্লাহ পাকের অসিম রহমত ও নেয়ামত আমরা যে পেয়েছি যা দেখেছি যা ভোগ করেছি তাকি আর সহজে ভোলা যায়?
পরিশেষে ষাটের দশকের দু’জন প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী গানের কলি মনে পড়ছে-
‘যে দিন গেছে সেদিন কি আর ফিরে পাওয়া যায়...’
‘ছেলেবেলার গল্প শোনার দিনগুলো আজ এখন কত দূরে...’ হ


আরো সংবাদ



premium cement