২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণায় সাফল্য

আর হারাবেনা বিলুপ্তপ্রায় সুস্বাদু বালাচাটা

আর হারাবেনা বিলুপ্তপ্রায় সুস্বাদু বালাচাটা - সংগৃহীত

দুই দশক আগেও অনেক দেশী মাছে ভরপুর ছিল আমাদের প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো। সেজন্যই আমাদের বলা হতো মাছে ভাতে বাঙালী। কিন্তু নানা দূষণ, দখল, অপরিকল্পিত আহরণের ফলে আজ আর দেখা মিলে না অনেক স্বসাদু দেশী মাছ। হারিয়েই যাচ্ছিল এমন একটি সুস্বাদু মাছ বালাচাটা। তবে সুখবর হলো, আবার ফিরবে এ মাছটি। আবার বাঙালীরা সুস্বাদু বালাচাটা মাছের স্বাদ নিতে পারবে। আর হারাবে না মাছটি। বিলুপ্তির পথে হাঁটতে থাকা মিঠাপানির এই মাছ বাঁচিয়ে রাখার কৌশল উদ্ভাবনে সফলতা পেয়েছেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) বিজ্ঞানীরা। কৃত্রিম প্রজননে পোনা উৎপাদনের মাধ্যমে এখন বালাচাটা বেঁচে থাকবে জলাশয়ে। বিএফআরআইয়ের নীলফামারীর সৈয়দপুর গবেষণা উপকেন্দ্রের মৎস্যবিজ্ঞানীরা এ সফলতা এনে দিয়েছেন। ওই গবেষকদলে ছিলেন ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. রাশিদুল হাসান ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শওকত আহমেদ।

সংশ্লিষ্ট গবেষকরা জানান, বালাচাটার বৈজ্ঞানিক নাম Somileptes gongota, যা অঞ্চলভেদে বালাচাটা, মুখরোচ, পাহাড়ি গুতুম, গঙ্গা সাগর, ঘর পইয়া, পুইয়া, বাঘা, বাঘা গুতুম, তেলকুপি ইত্যাদি নামে পরিচিত। তবে উত্তর জনপদে মাছটি বালাচাটা, পুইয়া ও পাহাড়ি গুতুম নামে বেশি পরিচিত। মিঠাপানির জলাশয়ে বিশেষ করে নদী-নালা, খাল-বিলে মাছটি পাওয়া যায়। তবে পাহাড়ি ঝর্না ও অগভীর স্বচ্ছ জলাশয় এদের বেশি প্রিয়। এরা প্রাণিকলা ও ছোট ছোট শুককীটজাতীয় খাবার খেয়ে বেঁচে থাকে। মাছটি মানবদেহের জন্য উপকারী অণুপুষ্টি উপাদানসমৃদ্ধ। উত্তরাঞ্চলে মাছটি একসময় প্রচুর পাওয়া যেত, কিন্তু জমিতে কীটনাশক প্রয়োগ, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, জলাশয় শুকিয়ে মাছ ধরাসহ নানা কারণে বাসস্থান ও প্রজননক্ষেত্র বিনষ্ট হওয়ায় এ মাছের প্রাচুর্যতা অনেকটাই কমে গেছে। ২০১৫ সালে আইইউসিএন মাছটিকে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। এরপর বালাচাটাকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে বিএফআরআইয়ের নীলফামারীর সৈয়দপুর গবেষণা উপকেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা কাজ শুরু করেন। দীর্ঘ গবেষণার পর মাৎস্যবিজ্ঞানীরা দেশে প্রথমবারের মতো মাছটির কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন কলাকৌশল উদ্ভাবনে সফলতা পেলেন। গবেষণা ফলাফলে জানা যায়, একটি পরিপক্ব (৯-১৪ গ্রাম) বালাচাটা স্ত্রী মাছের ডিম ধারণক্ষমতা চার থেকে আট হাজার এবং এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত মাছটির প্রজননকাল।

বিজ্ঞানীরা জানান, বৃহত্তর রংপুরের চিকলী, বারাতি ও বুড়িখরা নদী থেকে সুস্থ-সবল বালাচাটা মাছ (৫-৭ গ্রাম) সংগ্রহের পর মিনি পুকুরে মজুদ করে নির্দিষ্ট মাত্রায় খাবার প্রয়োগের মাধ্যমে চার-পাঁচ মাস প্রতিপালন করে প্রজনন উপযোগী ব্রুড (মা) মাছ তৈরি করা হয়েছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, একই বয়সের পুরুষের চেয়ে তুলনামূলকভাবে স্ত্রী মাছ আকারে বড় এবং দেহ প্রশন্ত হয়ে থাকে। প্রজনন মৌসুমে পরিপক্ব পুরুষ ও স্ত্রী মাছ পুকুর থেকে সংগ্রহ করে হ্যাচারির ট্যাংকে ছয় থেকে আট ঘণ্টা পানির ঝর্না দিয়ে রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে যথাক্রমে ১:১ অনুপাতে একক মাত্রার হরমোন ইনজেকশন প্রয়োগ করে ১.৮ মিটার ০.৯ মিটার ০.৩ মিটার আকারের মেটালিক ট্রেতে স্থানান্তর করা হয়। প্রয়োজনীয় অক্সিজেন নিশ্চিত করার জন্য ঝর্নার মাধ্যমে পানিপ্রবাহ অব্যাহত রাখা হয়। হরমোন ইনজেকশন প্রয়োগের সাত-আট ঘণ্টা পর প্রাকৃতিকভাবে স্ত্রী মাছ ডিম ছাড়ে। ডিমগুলো আঠালো হওয়ায় ট্রের চারপাশের দেয়ালে লেগে থাকে। সাধারণত ডিম ছাড়ার ২৩-২৪ ঘণ্টা পর ডিম ফুটে রেণু বের হয়ে আসে। ডিম্বথলি নিঃশেষিত হওয়ার (৬৫-৭০ ঘণ্টা) পর রেণু পোনাকে ছয় ঘণ্টা পর পর সিদ্ধ ডিমের কুসুম দিনে চারবার দিতে হয়। এভাবে রেণু পোনা ট্রেতে চার-পাঁচ দিন রাখার পর নার্সারি পুকুরে স্থাপন করা ৩.৫ মিটার ২ মিটার ১ মিটার আকারের জর্জেট কাপড়ের তৈরি হাপাতে স্থানান্তর করা হয়। হাপাতে রেণু পোনা ক্রমান্বয়ে অংগুলি পোনায় পরিণত হয়।

এ সফলতা সম্পর্কে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, ইনস্টিটিউট থেকে বালাচাটা মাছসহ এ পর্যন্ত ২০ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় মাছের কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবন করা হয়েছে। ফলে বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায় দেশি মাছের প্রাপ্যতা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। পর্যায়ক্রমে সব দেশীয় বিলুপ্তপ্রায় মাছকে খাবার টেবিলে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সাম্প্রতিককালে ইনস্টিটিউটের গবেষণা জোরদার করা হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement