২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

গিলাফে ঢাকা কাবা

গিলাফে ঢাকা কাবা - ছবি : সংগৃহীত

চির বিস্ময়, চির আকর্ষণীয় ও সীমাহীন ভালোবাসা বুকে পুরে কালো গিলাফে আচ্ছাদিত হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর প্রথম ঘর বাইতুল্লাহ। ‘নিঃসন্দেহে মানুষের জন্য সর্বপ্রথম যে ইবাদাত গৃহটি নির্মিত হয় সেটি মক্কায় অবস্থিত। তাকে কল্যাণ ও বরকত দান করা হয়েছিল এবং সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য হেদায়াতের কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছিল। (আল কুরআন ৩ : ৯৬) সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে অত্যন্ত আকাক্সক্ষার বন্তু এই ঘর। যার কারণে পৃথিবীর প্রতিটি জনপদের লোকেরা এই ঘরের প্রতি প্রবল আকর্ষণ ও আবেগ অনুভূতি নিয়ে চলে আসে। খরতাপ রোদ্রে আগুনে তাপমাত্রা ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা ও অস্থির এক পরিবেশের মধ্যে কালো গিলাফে ঢাকা এ ঘর সর্বদা শান্তির প্রলেপ বুলিয়ে যায়। দূর দিগন্তের ক্লান্ত-শ্রান্ত মুসাফির সাত সমুদ্রের ধকল নিয়ে যখন এ ঘরের কাছে আসে এবং তার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, সকল প্রকার দুঃখ-কষ্ট মুহূর্তের মধ্যে দূরীভূত হয়ে যায়। ধু-ধু মরুভূমির দেশে কঠিন পাথরে পর্বতমালায় ঘেরা পাহাড়ি উপত্যকায় অবস্থিত এ যেন এক প্রস্্র্রবণ, যা নীরস শুষ্ক কঠিন হৃদয়ের মরুভূমিকে আবহমানকাল ধরে সিক্ত করে চলেছে। 

কালো গিলাফে ঢাকা আল্লাহর ঘর, যাকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর সব কিছু ঘুরছে, যাকে ঘিরে মানুষের সামগ্রিক জীবনব্যবস্থা আবর্তিত হয়। মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে তার পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবন ব্যবস্থা এ ঘরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। হজ মওসুমসহ প্রায় সারা বছর এই ঘরের চার দিকে প্রদক্ষিণ (তওয়াফ) করে মানুষ এ কথার স্বীকৃতি দিয়ে যাচ্ছে। সে জানান দিচ্ছে যে, আমার সামগ্রিক জীবনব্যবস্থা এই ঘরের মালিকের ইচ্ছা মোতাবেক চলছে এবং চলবে। তাঁর মনোনীত জীবনব্যবস্থা ছাড়া মানুষের মনগড়া অন্য কোনো জীবনব্যবস্থা আমি এই তওয়াফের মাধ্যমে পরিত্যাগ করলাম। আজ থেকে ‘আমি সব কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে ওই আল্লাহর দিকে মুখ ফিরালাম যিনি কালো গিলাফে ঢাকা ঘরের মালিক, যিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন।’ মুসলিম সমাজ-সংস্কৃতি, তাহজিব-তমুদ্দন এই ঘরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে। 

কালো গিলাফে ঢাকা পৃথিবীর প্রথম ঘর বাইতুল্লাহ অত্যন্ত সম্মান ও আকাশসম মর্যাদা বহন করে। এই ঘরের আশপাশে সব ধরনের রক্তপাত হারাম। যেকোনো অপরাধী বা জানের শত্রুও যদি এ ঘরের নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করে, তাহলে সে নিরাপত্তা লাভ করে। এই নিরাপত্তাধীন সময়কালে কেউ তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। মানুষ ছাড়াও অন্যান্য কোনো প্রাণী ও কীটপতঙ্গকে কষ্ট দেয়া যাবে না। এটি এই ঘর-এর শান-শওকত। ‘তার মধ্যে রয়েছে সুস্পষ্ট নিদর্শনগুলো এবং মাকামে ইবরাহিম বা ইবরাহিমের ইবাদাতের স্থান। আর তার অবস্থা হচ্ছে এই যে, যে তার মধ্যে প্রবেশ করেছে, সে নিরাপত্তা লাভ করেছে।’ (আল কুরআন ৩ : ৯৭) প্রথম থেকে এই ঘরের মর্যাদা এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল যে, মারাত্মক প্রাণঘাতী শত্রুকে এখানে ঘোরাফেরা করতে দেখেও শত্রুর রক্তে হাত রঞ্জিত করার আকাক্সক্ষা পোষণকারী ব্যক্তিরা পরস্পরের ওপর হাত ওঠাবার সাহস করত না। 

কালো গিলাফে ঢাকা আল্লাহর ঘর স্বয়ং আল্লাহ একে নিজের ঘর হিসেবে পছন্দ করে নিয়েছেন। ধু-ধু মরু আর কঠিন পাথরের পাহাড়গুলোর উপত্যকায় এ ঘরটি তৈরি করা হয়। তার পর মহান আল্লাহ এর আশপাশের অধিবাসীদের আহার্য সরবরাহের চমৎকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। জাহেলিয়াতের কারণে আড়াই হাজার বছর পর্যন্ত সমগ্র আরব ভূখণ্ডে চরম অশান্তি ও নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছিল। কিন্তু এই বিপর্যয়ে পরিপূর্ণ দেশটিতে একমাত্র কাবাঘর ও তার আশপাশের এলাকাটি এমন ছিল যেখানে শান্তি ও নিরাপত্তা পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত ছিল। বরং এই কাবার বদৌলতেই সমগ্র দেশটি বছরে চার মাস শান্তি ও নিরাপত্তা ভোগ করত। তার পর এই মাত্র অর্ধ শতাব্দী আগে সবাই প্রত্যক্ষ করেছিল কাবা আক্রমণকারী আবরাহার সেনাবাহিনী কিভাবে আল্লাহর রোষানলে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। সে সময়ের আরবের শিশু-বৃদ্ধ-যুবক সবাই এ ঘটনা জানত। এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীরাও কুরআন নাজিলের সময় জীবিত ছিল। ‘তুমি কি দেখনি তোমার রব হাতিওয়ালাদের সাথে কী করেছেন।’ (কুরআন ১০৫:১)
এই ঘরের বদৌলতেই কুরাইশরা এ নিয়ামতের অধিকারী হয়েছে। অথচ আবরাহার সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করার মতো শক্তি সামর্থ্য তাদের ছিল না। এই ঘরের আশ্রয় লাভ করার আগে আরবের চার দিকে তাদের কোনো মর্যাদাই ছিল না। আরবের অন্যান্য গোত্রের মতো তারাও একটি বংশধারার বিক্ষিপ্ত দল ছিল মাত্র। কিন্তু এই ঘরের সেবকের দায়িত্ব পালন করতে থাকার পর সমগ্র আরবে তাদের মর্যাদা এতটাই বৃদ্ধি হলো যে, তাদের বাণিজ্য কাফেলা নির্ভয়ে যেকোনো জায়গায় যাওয়া-আসা করতে পারত। অবস্থা এমনটি ছিল যে, কোনো জনপদ রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারত না। কোনো লুটেরা দল রাতের অন্ধকারে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ত। নিজের গোত্রের বাইরে একাকী কোনো ব্যক্তি জীবিত ফিরে আসা অথবা গ্রেফতার হয়ে গোলামে পরিণত হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যাওয়া অসম্ভব ব্যাপার ছিল। বাণিজ্য কাফেলাগুলো যাতায়াত পথের গোত্র বা কবিলাগুলোকে ঘোষ না দিয়ে সেই পথ অতিক্রম করা অসম্ভব ছিল। একমাত্র কুরাইশরা মক্কায় সম্পূর্ণ নিরাপদ ছিল। তাদের ছোট-বড় বাণিজ্য কাফেলা দেশের প্রত্যেক এলাকায় যাওয়া-আসা করতে পারত। কারণ তাদের কাফেলার বিশেষ নাম ছিল হারাম শরিফের খাদেমদের কাফেলা। এমনকি একজন কুরাইশি একাই যদি কখনো কোনো জায়গায় যেত এবং সেখানে কেউ তার ক্ষতি করতে চাইলে তার পক্ষে শুধু হারমি অর্থাৎ আমি হারাম শরিফের লোক বলে দেয়াই যথেষ্ট ছিল। এ কথা বলে দেয়ার সাথে সাথে আক্রমণকারীর হাত নিচের দিকে নেমে আসত। 

এটি শান্তির প্রতীক হিসেবে পৃথিবীবাসীকে এই মেসেজ দিয়ে যাচ্ছে যে, এই ঘরের মালিকের ইচ্ছা মোতাবেক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করা হলে, সেই সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক নিরাপত্তা ও শান্তি উপভোগ করার সাথে সাথে দুশ্চিন্তা ও অভাব থেকেও নিরাপত্তা লাভ করবে। পুরো সমাজ ও রাষ্ট্র এই ঘরের মতো পবিত্র হয়ে উঠবে। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের জানমাল একে অন্যের কাছে পবিত্র আমানত হিসেবে গণ্য হবে। শুধু রাষ্ট্রের প্রয়োজন ছাড়া অন্য সবার জন্য হত্যা বা রক্তপাত হারাম হয়ে যাবে। রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষ উপদ্রবহীনতা ও উৎপাতশূন্যতার দরুন উৎকণ্ঠা শূন্যতা, চিত্তস্থৈর্য লাভ করবে। সমুৎপাটন ঘটবে অন্যান্য সব ধরনের সামাজিক অনাচারের। 
পিতা-পুত্র হজরত ইবরাহিম আ: ও ইসমাইল আ: মিলে এই কালো গিলাফে ঢাকা ঘরকে সমাজ ও সভ্যতার মূল প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। এখান থেকেই পিতা-পুত্র জাজিরাতুল আরবের প্রতিটি অলিগলিতে শিরকমুক্ত জীবন কায়েমের দাওয়াত দিয়েছিলেন। আর তখন থেকে এটি বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্ররূপে পরিগণিত হয়ে আসছে। কালের পরিক্রমায় মক্কা ও তার পাশের এলাকা শিরক ও পৌত্তলিকতা প্রসার ঘটে। আল্লাহর ঘরে ৩৬০টি মূর্তি স্থাপিত হয়েছিল। হজরত ইবরাহিম আ:-এর দোয়ার ফসল হজরত মুহাম্মদ সা: জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণপূর্বক বাইতুল্লাহকে আবার ইসলামী সংস্কৃতি ও ইসলামী আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলেন। এ জন্য তাঁকে অনেক কষ্ট ও যাতনার পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। তথাপি তিনি ওহুদ পাহাড়সম বিশাল বাধাকে অতিক্রম করে এই ঘর থেকে অসংখ্য মূর্তি অপসারিত করেন এবং দুনিয়ার সব মুসলিম ও তওয়াফকারীদের জন্য তা পবিত্র করেন। সমাজ ও সভ্যতার সর্বস্তরে নিরঙ্কুশ আল্লাহর সার্বভৌম প্রতিষ্ঠা করেন। 

আমরাও আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থা যদি এই ঘরের আলোকে গড়ে তুলতে পারি, তবে আশা করা যায় যে, সমাজের সর্বস্তরে শান্তি ও নিরাপত্তা নেমে আসবে। আল্লাহ আমাদের নামাজ ছাড়াও ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ রাষ্ট্রের সব কিছুর কেবলা যেন এই ঘরের দিকে ফিরাতে পারি সেই তাওফিক দান করুন।
লেখক : ব্যাংকার


আরো সংবাদ



premium cement