১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

পবিত্র আশুরা : সত্যের এক অনির্বাণ শিখা

পবিত্র আশুরা : সত্যের এক অনির্বাণ শিখা - ছবি : সংগৃহীত

১০ মহররম পবিত্র আশুরা। এ ছাড়া কারবালার ঘটনার কারণে মুসলমানদের কাছে এটা অত্যন্ত বেদনার দিন। এ দিনেই রাসূলুল্লাহ সা:-এর প্রিয় দৌহিত্র, হজরত আলী রা: ও ফাতেমা রা:-এর নয়নের মণি, মুসলমানদের হৃদয়ের ধন হজরত ইমাম হুসাইন রা: দুরাচারী ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে সপরিবারে নিমর্মভাবে শাহাদত বরণ করেন। তার শাহাদতের ঘটনা এতই তাৎপর্যমণ্ডিত যে, চৌদ্দশত বছর পর আজো তা অম্লান। 

কিন্তু কেন এই শাহাদত? কী অপরাধ ছিল ইমাম হুসাইন রা:-এর। অসংখ্য শাহাদত থেকে কেন এ শাহাদত বিশেষ বৈশিষ্ট্যে আলোকিত? মতার মোহ বা অর্থলিপ্সা এ মহান ব্যক্তিত্বের ছিল না। তখনো হাজার হাজার সাহাবি জীবিত ছিলেন এবং আহলে বাইতের জীবিত প্রথম পুরুষ হিসেবে তাঁকে মুসলমানেরা মাথায় তুলে রাখতে প্রস্তুত ছিলেন। তাহলে কেন তিনি অন্যদের মতো ইয়াজিদের আনুগত্য স্বীকার করলেন না, কেন কঠিন পথ বেছে নিলেন? শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, ধর্মীয় নেতৃত্ব, বিত্ত-বৈভব কোনো কিছুরই অভাব কি তাঁর ছিল? ছিল না। তার দৃষ্টিতে একটি মাত্র অভাব ছিল, আর তা হলো তাঁর শ্রদ্ধেয় নানাজান হজরত মুহাম্মদ সা:-এর রেখে যাওয়া আদর্শের অভাব। তিনি বিচণ দৃষ্টিতে দেখলেন, ইসলামী খেলাফতে তার নানার প্রতিষ্ঠিত ও খোলাফায়ে রাশেদার পরিচালিত আদর্শের বিচ্যুতি ঘটেছে। প্রাথমিকপর্যায়ে এ বিচ্যুতি সম্মানিত অনেক সাহাবা রা:-এর চোখেও হয়তো ধরা পড়েনি। আর এ জন্যই তারা ইয়াজিদের হাতে বাইয়াত (আনুগত্য স্বীকার) করতে অস্বীকার করেননি।

কিন্তু হজরত মুহাম্মদ সা:-এর আদর্শ ও রক্তের যোগ্য উত্তরসূরি ইমাম হুসাইন দেখলেন এ বিচ্যুতি শুরুতে খুব কম হলেও ভবিষ্যতে তা মূল আদর্শ থেকে যোজন যোজন দূরত্বে চলে যাবে। দূরদর্শী ইমাম হুসাইন রা: শুরুতেই বিপথগামী গাড়িকে মূল রাস্তায় তোলার চেষ্টা করলেন, সর্বশক্তি নিয়োগ করলেন, এমনকি জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে মূল পথকে চিনিয়ে গেলেন। কেউ কেউ তাঁকে অপরিণামদর্শী বলতে পারে। ৪০০০ সশস্ত্র সৈন্যের সুশৃঙ্খল বাহিনীর মোকাবেলায় ৭২ জনের একটি ক্ষুদ্র পারিবারিক বাহিনীর অসম যুদ্ধের ফলাফল তিনি খুব ভালো করেই জানতেন। কিন্তু তিনি যদি অন্যদের মতো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতেন তবে আলো ও অন্ধকার আর কোনো দিনই পৃথক হতো না, মিথ্যা থেকে সত্যকে আলাদা করা দুষ্কর হয়ে যেত। ইমামের অবস্থান কেয়ামত পর্যন্ত সত্যকে আচ্ছাদিত করে রাখত। তাই ইমাম হুসাইন রা: দিব্য দৃষ্টিতে বুঝে-শুনে সত্যের মশাল জ্বেলে গিয়েছেন, তার পবিত্র রক্ত দিয়ে সত্যের অনির্বাণ শিখা নির্মাণ করেছেন। সত্য পথের অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থানে তিনি নিজেকে উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হিসেবে স্থাপন করে সত্যকে আঙুল দিয়ে চিনিয়ে দিয়েছেন। 
রাসূলুল্লাহ সা: কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ও খেলাফতে রাশেদা কর্তৃক পরিচালিত ইসলামী রাষ্ট্র ও সরকারের মূলনীতিগুলো সংক্ষেপে নিম্নরূপ--

ষ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনই সর্বময় মতার উৎস এবং মানুষ তার প্রতিনিধি মাত্র। 
ষ জনসাধারণ রাষ্ট্রের গোলাম নয়। খলিফা জনসাধারণের সেবক। খলিফা আল্লাহর বান্দাদের পর কেবল আল্লাহর আইন জারি করার মতা রাখেন। 
ষ সৎবৃত্তিগুলো প্রতিষ্ঠা ও অসৎবৃত্তিগুলোর পথরোধ করাই ইসলামী সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য। 
ষ রাষ্ট্রের প্রাণশক্তি হবে তাকওয়া। অর্থাৎ খোদাভীতিই হবে নেতৃত্বের প্রধান মাপকাঠি। 
ষ স্বাধীন মতামতের ভিত্তিতে সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। 
ষ রাষ্ট্র পরিচালিত হবে পরামর্শের ভিত্তিতে। সমাজের জ্ঞানী-গুণী ও আস্থাশীল ব্যক্তিরাই হবেন পরামর্শ সভার (পার্লামেন্ট) সদস্য। 
ষ মতামত প্রকাশে জনসাধারণের পূর্ণ সুযোগ থাকবে। 
ষ দুনিয়ায় জনসাধারণের কাছে এবং পরকালে মহান আল্লাহর কাছে সরকারের জবাবদিহিতার তীব্র অনুভূতি থাকবে। 
ষ বায়তুলমাল আল্লাহর সম্পত্তি; মুসলমানদের আমানত। খলিফা বায়তুলমালের তত্ত্বাবধায়ক মাত্র। 
ষ আইনের শাসন থাকবে। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে না। 
ষ অধিকার ও মর্যাদার দিক থেকে সবাই সমান হবে। একজন অন্যজন থেকে শ্রেষ্ঠ হবেন শুধু চরিত্র, নৈতিকতা এবং যোগ্যতার কারণে। 

চতুর্থ খলিফা হজরত আলী রা:-এর সময়কাল পর্যন্ত রাষ্ট্র ও সরকারে এ মূলনীতিগুলো বহাল ছিল। কেন্দ্রীয় সরকারে এ মূলনীতিগুলো পূর্ণভাবে বহাল থাকলেও সিরিয়ায় তখন থেকেই এ মূলনীতিগুলোর বিচ্যুতি ঘটা শুরু করেছিল। রাজনৈতিক কূটকৌশলের কারণে হজরত আলী রা: সেই প্রাদেশিক সরকারে পুনর্বিন্যাস করতে পারেননি। ৪০ হিজরির ২১ রমজান ইবনে মুলজামের ছুরিকাঘাতে তিনি শাহাদত বরণ করেন। এর পরে ইমাম হাসান রা: স্বল্পসময়ের জন্য খলিফা হন এবং আমির মুয়াবিয়ার সৈন্যবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে গুজব ও ষড়যন্ত্রের কারণে খুব সুবিধা করতে না পেরে তিনি আমির মুয়াবিয়া রা:-এর কাছে সন্ধির প্রস্তাব পাঠান। আমির মুয়াবিয়া রা: তৎণাৎ সন্ধিতে সম্মত হন। সন্ধির শর্তাবলির মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য শর্ত ছিল, মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পর ইমাম হাসান রা:-এর দ্বিতীয় ভাই ইমাম হুসাইন রা: খলিফা হবেন। 

বনু হাশেম গোত্র ইমাম হাসান রা:-এর সন্ধিতে সায় দেয়নি। যা হোক, সময় দ্রুত গড়াতে থাকে। খেলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থায় আদর্শ বিচ্যুতি ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সর্বশেষে ইসলামী খেলাফতের স্বাধীন মতামতের ভিত্তিতে সরকার গঠনের মূলনীতি, আগে সম্পাদিত সন্ধি, সব কিছুকে উপো করে ইয়াজিদকে পরবর্র্তী খলিফা নিয়োগ করা হয়। এতেও ইমাম হুসাইন বিচলিত হননি। কিন্তু তিনি যখন ইসলামী রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য, নেতৃত্ব নির্বাচন, আইনের শাসন, সাম্য, বায়তুলমালের যথাযথ ব্যবহার ইত্যাদিতে ব্যাপক পরিবর্তন হতে দেখেন, তখন তিনি পেরেশান হয়ে যান এবং শুরুতেই এর পথরোধ করতে উদ্যত হন। খেলাফতের আদর্শবিচ্যুতি মোকাবেলা করতে তিনি সর্বপ্রথম যে পদপে নিলেন, তা হলো ইয়াজিদের আনুগত্যে অস্বীকার। এতে ইয়াজিদ বাহিনী প্তি হয়ে উঠল। তিনি মদিনা ছেড়ে মক্কায় চলে এলেন। খেলাফতের আদর্শ পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য তিনি প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকলেন। 

কুফাবাসীর আগ্রহ-উদ্দীপনা ও বারবার আহ্বানের মধ্যে তিনি আশার আলো দেখতে পেলেন। তিনি কুফার সত্যিকার অবস্থা পর্যালোচনা করে মতামত জানানোর জন্য তার বিশ্বস্ত চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকিলকে কুফায় পাঠান। মুসলিম বিন আকিল জনমতকে আরো সংগঠিত করলেন এবং ইমামকে কুফায় আসার ইতিবাচক মতামত জানালেন। ইতোমধ্যে কুফায় স্বৈরশাসক ইবনে জিয়াদ ষড়যন্ত্র, ভীতি প্রদর্শন ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে উৎকোচ প্রদানের মাধ্যমে মুসলিম বিন আকিলকে প্রথমে জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলল এবং সর্বশেষ তাকে নির্মমভাবে শহীদ করল। ইমাম হুসাইনকে এসব কিছুই জানানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। তথ্যপ্রযুক্তির ওই অনগ্রসর যুগে বহু পরে ইমাম তা অবগত হয়েছিলেন। যখন তিনি তা অবগত হয়েছিলেন, তখন তিনি কুফার কাছাকাছি ইবনে জিয়াদের সৈন্যদের কাছে কার্যত অন্তরীণ অবস্থায় ছিলেন। তিনি ফিরে যেতে চাইলেন, তুর্কি সীমান্তে যেতে চাইলেন, ইরাকে গিয়ে ইয়াজিদের সাথে সরাসরি কথা বলতে চাইলেন; কিন্তু ইবনে জিয়াদের বাহিনী কোনো কিছুতেই রাজি হলো না। তারা তাঁকে বৃলতাহীন কারবালার ঊষর মরুভূমিতে নিয়ে গেল। ইমাম হুসাইন যুদ্ধ করতে আসেননি। তিনি এসেছিলেন কুফাবাসীর আবেগের মূল্য দিতে। খেলাফতে রাশেদার আদর্শকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে। তাঁর সাথে ছিলেন ৭২ জন পারিবারিক সদস্য ও অনুরক্ত ভক্ত। তিনি যে যুদ্ধ করতে আসেননি তার বড় প্রমাণ তিনি স্ত্রী-কন্যা ও শিশুদের সাথে এনেছিলেন। যা হোক, ৬১ হিজরির আশুরার দিনে জোহর নামাজের পর হুসাইন রা: শাহাদতবরণ করেন। হজরত ইমাম হুসাইন রা:-এর বয়স ছিল তখন পঞ্চাশ বছর। 

কুফা গমন করতে আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা:-এর মতো ব্যক্তিত্বরাও ইমামকে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু ইমাম সত্যের স্যা দেয়ার জন্য দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। রাসূল সা:-এর ওহুদ প্রান্তরে যাওয়ার সিদ্ধান্তের মতোই তিনি আর তার সিদ্ধান্ত পাল্টাননি। আপস করেননি ইমাম হুসাইন রা:। নিজের পবিত্র রক্ত ঢেলে জ্বেলে গেলেন সত্যের অনির্বাণ শিখা। যে শিখায় খেলাফত ও রাজতন্ত্রের পার্থক্য দিবালোকের মতো স্পষ্ট দেখা যায়। লাখ কোটি ভক্ত-অনুরক্ত পরিবেষ্টিত শান্তিময় জীবন তিনি পরিহার করলেন মানবজাতিকে সত্যের পথ দেখাতে। তাই তার শাহাদাত অনন্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। তার শাহাদাত চির আম্লান। তিনি অমর। 
লেখক : প্রাবন্ধিক


আরো সংবাদ



premium cement