২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কোরবানির জরুরি কিছু মাসায়েল

কোরবানির জরুরি কিছু মাসায়েল - কোরবানির জরুরি কিছু মাসায়েল

স্বীয় কামনা-বাসনা, ব্যক্তিসত্তা, কষ্টার্জিত সম্পদ ও প্রাণাধিক প্রিয় বস্তুকে মহান আল্লাহর ইচ্ছা ও সন্তুষ্টির সামনে সমর্পণের উদাত্ত আহ্বান নিয়ে কোরবানির ঈদ আমাদের সামনে উপস্থিত। কোরবানি এক দিকে যেমন ত্যাগের অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম আ:-এর ত্যাগদীপ্ত সংগ্রামী জীবনের ইতিহাস আমাদের স্মৃতিপটে জাগিয়ে দেয়, তেমনি প্রতিটি মুমিন অন্তরকে ঈমানি চেতনায় করে তোলে উজ্জীবিত।

কোরবানি কী : কোরবানি শব্দের অর্থ উৎসর্গ ও নৈকট্য অর্জন। শরিয়তের পরিভাষায় জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখে নির্দিষ্ট নিয়ম ও সময়ে, নির্দিষ্ট জন্তুকে মহান আল্লাহর অধিক সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে জবাই করাকে কোরবানি বলা হয়। কোরবানি আদায় করা বিত্তবানদের ওপর ওয়াজিব। তবে দরিদ্র ব্যক্তিও ইচ্ছা করলে কোরবানি আদায় করে ছাওয়াব অর্জন করতে পারেন।

কোরবানির ফজিলত : কোরবানির ফজিলত সীমাহীন। মহানবী সা: বলেছেন, ‘কোরবানির সময় আল্লাহর নিকট কোরবানির চেয়ে অধিক প্রিয় আর কোনো জিনিস নেই। কোরবানির সময় কোরবানিই সবচেয়ে বড় ইবাদত। কোরবানি জবাই করার সময় প্রথম যে রক্তের ফোঁটা পড়ে, তা মাটি পর্যন্ত পৌঁছার আগেই কোরবানি আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায়।’

মহানবী সা: আরো বলেছেন, ‘কোরবানির জানোয়ারের যত পশম থাকে প্রত্যেক পশমের পরিবর্তে এক একটি নেকি লেখা হয়।’ অন্যত্র বলেছেন, ‘তোমরা মোটা ও তাজা জন্তুর দ্বারা কোরবানি করো, কারণ এটা পোলসেরাতে তোমাদের সাথী হবে।’

যাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব : ১০ জিলহজের ফজর থেকে ১২ জিলহজের সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কোনো ব্যক্তি যদি মালিকে নিসাব (সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপা কিংবা সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সমমূল্যের নগদ অর্থ অথবা কিছু স্বর্ণ, কিছু রূপা এবং কিছু নগদ অর্থ- সব মিলিয়ে যদি সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমান হয়, এরূপ সম্পদের অধিকারী) হয়, তবে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হবে। স্ত্রী ও বালেগ পুত্র, বালেগা কন্যা ধনী হলে তাদের নিজ থেকেই কোরবানি করা ওয়াজিব। কিন্তু নাবালেগ পুত্র, নাবালেগ কন্যা ধনী হলেও তাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব হবে না। স্বামী যদি স্ত্রীর পক্ষ থেকে তার অনুমতিক্রমে কোরবানি আদায় করে, তা হলে স্ত্রীর ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে। মুসাফিরের ওপর মুসাফিরি অবস্থায় কোরবানি ওয়াজিব হবে না।

কোরবানির সময়সীমা : ১০ জিলহজের ফজর থেকে ১২ জিলহজের সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই কোরবানি আদায় করতে হবে। এই তিন দিনের যে দিন ইচ্ছা সে দিনই কোরবানি করা যেতে পারে। তবে ঈদের নামাজের আগে কোরবানি করা ঠিক নয়। অবশ্য যে স্থানে ঈদের নামাজ ও জুমার নামাজ আদায় হয় না, সে স্থানে ১০ জিলহজ ফজরের পরও কোরবানি করা যেতে পারে। রাতের বেলা বা অন্ধকার স্থানে কোরবানি না করাই উত্তম।

কোরবানির পশু : বকরি, পাঠা, খাসি, ভেড়া, দুম্বা, গাভী, ষাড়, বলদ, মহিষ, উট এই কয় প্রকার জন্তুর দ্বারা কোরবানি করা যাবে। হরিণ, বক ইত্যাদি হালাল বন্য জন্তুর দ্বারা কোরবানি আদায় হবে না। বকরি, পাঠা, খাসি, ভেড়া, দুম্বা পূর্ণ এক বছরের কম বয়সের হলে তা দ্বারা কোরবানি আদায় হবে না। তবে ছয় মাসের বেশি বয়সের দুম্বার বাচ্চা যদি মোটাতাজা হওয়ার কারণে এক বছরের বাচ্চার মতো মনে হয়, তবে তা দ্বারা কোরবানি করা বৈধ হবে। গরু, মহিষের বয়স কমপক্ষে দুই বছর এবং উটের বয়স পাঁচ বছর হতে হবে। কোরবানির পশু সুস্থ, সবল এবং দৃষ্টিনন্দন হতে হবে। অন্ধ, কানহীন জন্তু কিংবা একটি কান বা লেজের এক তৃতীয়াংশ বা তদপেক্ষা বেশি কেটে গেছে, মূল থেকে ভেঙে যাওয়া শিংওয়ালা জন্তুর দ্বারা কোরবানি বৈধ হবে না। অনুরূপভাবে অতি কৃশকায়, দন্তহীন জানোয়ার, তিন পায়ে ভর দিয়ে চলা খোড়া জন্তু দ্বারা কোরবানি করা বৈধ হবে না। শিংহীন জন্তু বা শিং উঠেছে কিন্তু ভেঙে গেছে, খাসি বানিয়ে দেয়া জন্তু বা জন্তুর গায়ে বা কাঁধে অল্প দাদ বা খুজলি হয়েছে এরূপ জন্তু দ্বারা কোরবানি বৈধ। ভালো পশু ক্রয় করার পর যদি কোনো কারণে কোরবানি করার অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে তবে অন্য একটি পশু ক্রয় করে কোরবানি করতে হবে। মালিকে নিসাব না হলে তিনি সে পশু দ্বারাই কোরবানি করতে পারবেন।

কোরবানি কত নামে করা যাবে : গরু, মহিষ ও উটের ক্ষেত্রে এক থেকে সাত নাম দেয়া যেতে পারে। অন্যান্য জন্তুর ক্ষেত্রে এক নাম দেয়া যাবে। গরু, মহিষ ও উট ক্রয় করার আগে সাতজন ভাগীদার ঠিক করে নেয়া উত্তম। যদি কেউ ক্রয় পরবর্তী ভাগীদার পাওয়ার ইচ্ছায় একা গরু, মহিষ বা উট ক্রয় করে তবে তা বৈধ হবে। একা করার নিয়তে পশু ক্রয় করার পর পরবর্তীতে কাউকে ভাগীদার হিসেবে নিলে তা বৈধ হলেও উত্তম নয়। উল্লেখ্য, ক্রেতা গরিব হলে তিনি অন্যকে ভাগীদার হিসেবে নিতে পারবে না।

কোরবানিদাতাদের নিয়ত : কোরবানি একমাত্র মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে হতে হবে। ভাগীদারদের কারো গোশত খাওয়ার নিয়ত থাকলে কোরবানি গ্রহণযোগ্য হবে না। কোরবানির ক্ষেত্রে ভাগীদার থাকলে সবার ভাগ সমান হতে হবে। আন্দাজে ভাগ না করে পাল্লা দিয়ে মেপে সমান সমান ভাগ করতে হবে। কম-বেশি হলে কোরবানি হবে না। আকিকার নিয়তে কেউ ভাগীদার হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে।

কোরবানি কে করবেন : নিজের কোরবানির পশু নিজ হাতেই জবাই করা মুস্তাহাব। নিজে অক্ষম হলে একজন অভিজ্ঞ আলেম দ্বারা কোরবানি করানো উচিত। এ সময় নিজে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভালো। মহিলাদের সামনে উপস্থিত না থাকাই উত্তম।

কোরবানি করার নিয়ম : কোরবানির পশুকে কিবলামুখী করে শুইয়ে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে জবাই করতে হবে। কোরবানি করার সময় মুখে নিয়ত করা ও দোয়া উচ্চারণ করা জরুরি নয়। স্মরণ থাকলে কোরবানির জন্য নির্ধারিত দোয়া পড়া যেতে পারে। ক্রয়কৃত জন্তুর বাচ্চা হলে ওই বাচ্চাকে কোরবানি করে গরিব মিসকিনকে দিয়ে দিতে হবে, নিজে খাওয়া যাবে না। বাচ্চাকে জবাই না করে গরিবকে দান করে দেয়া যেতে পারে।
হারিয়ে যাওয়া পশু : কোরবানির জীব হারিয়ে গেলে তার পরিবর্তে অন্য পশু ক্রয় করার পর প্রথম পশুটি পাওয়া গেলে ক্রেতা মালিকে নিসাব হলে তার জন্য যেকোনো একটি কোরবানি করা ওয়াজিব হবে। যদি মালিকে নিসাব না হয় তবে উভয়টি কোরবানি করা ওয়াজিব হবে। একটি কোরবানি করার পর অপরটি ১২ জিলহজের পর পাওয়া গেলে গরিব লোকটি সেই পশুটিকে সদকা করে দেবে।

গোশত খাওয়া ও বণ্টন : কোরবানির পশুর গোশত পরিবার পরিজন ও আত্মীয়-স্বজন নিয়ে তৃপ্তিসহকারে খাওয়া যাবে। গোশত বণ্টনের মুস্তাহাব নিয়ম হচ্ছে- তিন ভাগ করে এক ভাগ গরিবদের, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজন ও এক ভাগ নিজে রেখে দেয়া। নিজে বেশি অংশ রেখে গরিবদের সামান্য দান করলেও কোরবানি আদায় হয়ে যাবে।
কোরবানির চামড়া : কোরবানির চামড়ার প্রকৃত হকদার হচ্ছে এতিম-মিসকিন তথা গরিবেরা। যদি কেউ তা বিক্রি করে তবে বিক্রিত অর্থ সম্পূর্ণ দান করে দিতে হবে। নিজের কাজে ব্যবহার করা যাবে না। পশু জবাইয়ের বিনিময় কিংবা বানানোর পারিশ্রমিক চামড়া বিক্রির পয়সা বা গোশত দিয়ে দেয়া যাবে না। মসজিদ নির্মাণ, মেরামত কিংবা অন্য কোনো নেক কাজে এই অর্থ দান করা যাবে না।

মৃত ব্যক্তির জন্য কোরবানি : মৃত্যুর আগে কেউ কোরবানির জন্য অসিয়ত করে গেলে তার অংশের সব গোশত দান করে দেয়া ওয়াজিব। তবে স্বীয় ইচ্ছায় মৃতকে সওয়াব পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে কোরবানি করা হলে ওই অংশের গোশত ইচ্ছা অনুযায়ী খেতে ও দান করতে পারবেন। কোরবানির যে বিধান শরিয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছে, সে মোতাবেক কোরবানি করা জরুরি।
লেখক : গবেষক


আরো পড়ুন :
হজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
ড. এম এ সবুর

হজ ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ ও মৌলিক ইবাদাত। জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন প্রত্যেক সচ্ছল মুসলিম নর-নারীর ওপর হজ পালন করা ফরজ। আত্মিক উন্নতি, সামাজিক সম্প্রীতি ও বিশ্বভাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় হজের গুরুত্ব সর্বাধিক। মুসলিম বিশ্বের ঐক্য-সংহতি গড়তেও হজের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব মুসলিমের করণীয়-বর্জনীয় সম্পর্কে সঠিক দিকনির্দেনাও লাভ করা যায় হজের বিশ্ব মহাসম্মিলন থেকে। হজ শুধু ইবাদতই নয়, বরং আত্মিক পরিশুদ্ধতার এক অনস্বীকার্য পদ্ধতি। আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হজের বিনিময় নিশ্চিত জান্নাত। এ সম্পর্কে হাদিসে বলা হয়েছে, ‘কবুল হজের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া আর কিছুই নয়’।

জিলহজ মাসের নির্দিষ্ট (৮-১০) তারিখে পবিত্র বায়তুল্লাহ বা কাবাঘর প্রদক্ষিণ, আরাফাত ময়দানের মহাসম্মিলনে যোগদানসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা পালনের মাধ্যমে হজ আদায় করতে হয়। হজ পালনকারীকে এ সময় অশ্লীল-পাপাচার, যুদ্ধ-বিগ্রহ, যৌনমিলন ইত্যাদি পার্থিব কাজ থেকে বিরত থাকতে হয়। আল কুরআনের ভাষায়, ‘হজের জন্য নির্ধারিত মাস আছে। যে ব্যক্তি হজ পালন করবে, সে স্ত্রীর সাথে যৌনমিলন, অশ্লীল কাজ ও অযথা ঝগড়া-বিবাদ করতে পারবে না’ (সূরা বাকারা : ১৯৭)। হজ পালনের সময় একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন থাকতে হয়। এ সময় হজ পালনকারীরা তাদের অনেক সম্পদ-প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকা সত্ত্বেও কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে অনাড়ম্বর জীবন যাপন করেন। তারা মুণ্ডিত মস্তকে, স্বল্পবসন আর নগ্ন পায়ে সব সময় মহান আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকেন। দুনিয়ার ভোগ-বিলাস, রূপ-লাবণ্য, ধন-সম্পদের মোহ কোনো কিছুই তাদের আকৃষ্ট করতে পারে না। এভাবে এক দিকে একনিষ্ঠ ইবাদত-বন্দেগি, অন্য দিকে নিরহঙ্কার, অনাড়ম্বর ও নির্মোহ জীবন যাপনের মাধ্যমে হজ পালনকারীদের আত্মা ষড়রিপুর কুপ্রভাব থেকে কলুষমুক্ত ও বিশুদ্ধ হয়। হজের মাধ্যমে যেমন আত্মার উন্নতি সাধিত হয়, তেমনি গুনাহও দূরীভূত হয়। এ বিষয়ে বুখারি শরিফের এক হাদিসে উল্লেখ আছে, ‘পানি যেমন ময়লা-আবর্জনা দূর করে, তেমনি হজও গুনাহ দূর করে।’

হজ মুসলমানদের জন্য ফরজ বা আবশ্যিক ইবাদত। প্রত্যেক জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন ও সামর্থ্যবান মুসলিম নর-নারীর ওপর হজ ফরজ করে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, ‘মানুষের মধ্যে যারা পথের ব্যয় নির্বাহ করতে সক্ষম তাদের ওপর আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে কাবাঘরে হজ পালন করা ফরজ’ (সূরা বাকারা : ৯৭)। মুসলিম শরিফের বর্ণিত হাদিসে রাসূল সা: বলেছেন, ‘হে মানব সম্প্রদায়! আল্লাহ তোমাদের ওপর হজ ফরজ করেছেন।

সুতরাং তোমরা হজ পালন করো।’ সামর্থ্যবান ও সক্ষম মুসলিম হজ পালন না করলে তার জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা আছে। হাদিসের ভাষায়, ‘আল্লাহ তায়ালা যাকে হজ পালনের সামর্থ্য দিয়েছেন অথচ সে হজ না করে মৃত্যুবরণ করে, তা হলে সে দোজখের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তিতে পতিত হবে’ (মিশকাত)। হজ শুধু উম্মাতে মুহাম্মদির ওপর ফরজ করা হয়নি। পূর্ববর্তী অনেক নবী-রাসূল ও তাঁদের অনুসারীদের ওপরও হজ আদায়ের বিধান ছিল। এ জন্য আল্লাহ তায়ালা প্রথম মানব হজরত আদম আলাইহিস সালামকে কাবাঘর নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। হজরত ইবরাহিম ও ইসমাইল আলাইহিস সালাম আল্লাহর নির্দেশে কাবাঘর সংস্কার করেছেন এবং তারাও হজ পালন করেছেন। প্রাচীনকাল থেকেই আরবের লোকেরা হজ পালন করত। তাই তো ইতিহাস থেকে জানা যায়, দক্ষিণ আরবের বাদশাহ আবরাহা রাসূলের জন্ম বছরে কাবাঘর ভেঙে ফেলার জন্য বিশাল হাতিবাহিনী নিয়ে এসেছিলেন। অবশ্য আল্লাহর বিশেষ রহমতে ও কুদরতে কাবাঘর রক্ষা পায় এবং বাদশাহ আবরাহার বিশাল হাতিবাহিনী আবাবিল পাখির পাথর নিক্ষেপে ভক্ষিত তৃণরূপ হয়ে যায়। হাদিস ও ইতিহাস থেকে জানা যায়, জাহেলিয়া যুগের লোকেরা হজ মওসুমে নগ্ন হয়ে কাবাঘর প্রদক্ষিণ করত। ইসলামের প্রাথমিকপর্যায়ে মহানবী সা: হজ মওসুমে মক্কায় আগত মানুষদের কাছে ইসলামের সুমহান দাওয়াত পৌঁছে দিতেন। এতে বোঝা যায়, পূর্ববর্তী অনেক নবী-রাসূলের ওপরও হজ পালনের বিধান ছিল। তাদের স্মৃতি স্মারক ও ঐতিহ্য সম্পর্কে অবগত হওয়া এবং শ্রদ্ধা প্রদর্শন করাও হজের অন্যতম উদ্দেশ্য। অধিকন্তু পূর্ববর্তী ধর্মগুলোর সাথে ইসলামের সমন্বয় সাধনও হজের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

হজ শুধুই ইবাদত নয়। বিশ্বভাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাপক। হজের সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ পবিত্র মক্কা নগরীতে একত্র হয়। ভাষা-বর্ণের ভিন্নতা, সাংস্কৃতিক-জাতীয় পরিচয়ের পার্থক্য ও ভৌগোলিক দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও বিশ্ব মুসলিমের ভাতৃত্ববোধ জাগ্রত ও সুসংহত হয় পবিত্র হজ উদযাপনে। বিশ্ব মুসলিমের পারস্পরিক দুঃখ-অভাব, অভিযোগ-সমস্যা সম্পর্কে অবগত হওয়া ও তার সমাধানের সুযোগ হয় পবিত্র হজের বিশ্ব সম্মিলনে।

হজ গণতান্ত্রিক এক বিশ্ব সম্মিলন। এ সম্মিলনে বিশ্বের সর্বস্তরের মুসলিম অংশগ্রহণ করতে পারেন। জাতিসঙ্ঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন সংগঠন-সংস্থার সম্মিলনে সংশ্লিষ্ট দেশ-জাতির নেতা ও প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত। কিন্তু হজের সম্মিলনে বিশ্বের সর্বস্তরের মুসলিমের অংশগ্রহণের সুযোগ অবারিত। উঁচু-নিচু, ভাষা-বর্ণ, জাতি-গোত্র নির্বিশেষে বিশ্বের সামর্থ্যবান যেকোনো মুসলিমের নিঃশর্তভাবে হজ করার অধিকার ইসলামসম্মত।
হজ এক ধরনের দীর্ঘ সফর বা ভ্রমণ হলেও তা কোনো ভ্রমণবিলাস নয়। বরং এর মধ্যে লুকায়িত আছে মহান আল্লাহর প্রতি অগাধ আস্থা-আনুগত্য আর শ্রদ্ধা-ভালোবাসা। নিজের উপার্জিত অর্থ ব্যয় এবং দৈহিক কষ্ট করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের প্রচেষ্টা করা হয় পবিত্র হজে। মূলত হজ একটি অনন্য ইবাদত, যাতে সমন্বয় ঘটেছে আর্থিক ত্যাগ ও দৈহিক কসরত।

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও রাজনৈতিক সংহতিতেও হজের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। হজের মওসুমে মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোয় বিশেষত সৌদি আরবের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়ে যায়। এ সময় ব্যবসায়ী বিশ্ব মুসলিম নেতারা আলাপ-আলোচনা-চুক্তির মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধশালী করতে পারেন। অনুরূপভাবে বিভিন্ন দেশ থেকে আগত মুসলিম নেতারা পারস্পরিক মতবিনিময়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান করতে পারেন। এতে বিশ্ব মুসলিম নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক সংহতি গড়ে উঠতে পারে। হজের সময় তারা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিশ্বমুসলিম সমাজ-সংস্কৃতিকে সুসংহত ও সমৃদ্ধ করতে পারেন।

নির্যাতিত-নিপীড়িত-বঞ্চিত ও সাম্রাজ্যবাদীদের আধিপত্যের শিকার মুসলিম বিশ্বের জন্য হজ বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। হজ মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এবং অধিকার আদায়ের সুযোগ করে দেয়। হজ মওসুমে মুসলিম বিশ্বের নেতারা বিভিন্ন মুসলিম দেশের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-মতভেদ নিরসনে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারেন। এ ছাড়া হজের বিশ্ব সম্মিলন থেকে মুসলিম নেতারা নিজেদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আধিপত্যবাদীদের মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ লাভ করেন। ইসলামের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদসহ প্রচারিত অন্যান্য অপবাদের বিরুদ্ধে মুসলিম বিশ্বের করণীয় সম্পর্কে সঠিক দিকনির্দেশনাও দিতে পারেন তারা।

আরাফাত ময়দানে অবস্থান হজের অন্যতম ফরজ কাজ। তবে এ অবস্থান নিছক অবস্থানই নয়। এর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য সমবেত বিশ্ব মুসলিমের করণীয়-বর্জনীয় সম্পর্কে বিশ্বনেতাদের দিকনির্দেশনা দেয়া। মহানবী সা:-এর হজ থেকে এ শিক্ষাই পাওয়া যায়। তিনি বিদায় হজের সময় আরাফাত ময়দানে উপস্থিত মুসলিমদের উদ্দেশে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন বিষয়ের দিকনির্দেশনা দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছেন এবং তার বক্তব্য অনুপস্থিতদের কাছে পৌঁছানোরও নির্দেশ দিয়েছেন। ঐতিহাসিকেরা হজরতের এ ভাষণকে বিদায় হজের ভাষণ নামে আখ্যাত করেছেন। মহানবীর এ ভাষণ রাজনৈতিক পরিভাষায় ‘ম্যাগনাকার্টা’ হিসেবেও পরিগণিত হয়েছে।

পবিত্র কাবাঘর প্রদক্ষিণ, আরাফাত ময়দানে অবস্থান, সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মধ্যে দৌড়ানো, জামারায় পাথর নিক্ষেপ, আল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি ইত্যাদি হজের আনুষ্ঠানিক ইবাদত। হজের এসব ইবাদত পারস্পরিক সম্পর্কিত হলেও এর প্রত্যেকটির মধ্যেই রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও নিজস্ব ঐতিহ্য। কাবাঘর প্রদক্ষিণ ও পশু কোরবানির মাধ্যমে হজরত ইবরাহিম ও ইসমাইলের আদর্শ-ত্যাগের প্রতি প্রকাশিত হয় গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন। জামারায় পাথর নিক্ষেপের সাথে জড়িত আছে শয়তানের প্রতি বালক ইসমাইলের অবজ্ঞার নিদর্শন। আর সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে দৌড়ানোর মধ্যে নিহিত আছে শিশু ছেলে হজরত ইসমাইলের প্রতি বিবি হাজেরার ব্যাকুলতা স্মরণ।

প্রকৃতপক্ষে হজ একটি ঐতিহ্যবাহী অনন্য ফরজ ইবাদত ও বিশ্ব মুসলিম সম্মিলন। হজের মাধ্যমে বিশ্ব মুসলিমের আধ্যাত্মিক-নৈতিক উন্নতি, সামাজিক-রাজনৈতিক সংহতি, অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি এবং আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় ইসলাম-মুসলিমের অবস্থান সুসংহত ও সুদৃঢ় হয়।
লেখক : গবেষক


আরো সংবাদ



premium cement