২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শাওয়ালের ৬ রোজার ফজিলাত

শাওয়ালের ৬ রোজার ফজিলাত - ছবি : সংগৃহীত

মহান আল্লাহ মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁরই ইবাদাতের জন্য। এ মর্মে আল্লাহ বলেছেন, “আমি জিন ও মানব জাতিকে আমারই ইবাদাতের জন্য সৃষ্টি করেছি” (সূরা যারিয়াত : ৫৬)। ইবাদাতের মাধ্যমেই বান্দা মহান আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্য লাভে ধন্য হতে পারে। প্রতিটি নেক কাজেই রয়েছে মহান আল্লাহর পক্ষ হতে প্রতিদান প্রাপ্তির নিশ্চয়তা। সূরা আনয়ামের ১৬০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, “কেউ কোনো সৎ কাজ করলে সে তার ১০গুণ পাবে।” নেক ইবাদাতের প্রতিদান প্রসঙ্গে মহানবী সা. বলেন, মহান আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা যেকোনো নেক আমলই করবে, আমার কাছে তার ১০ গুণ সওয়াব প্রস্তুত আছে” (হাদীসে কুদসী)। ১০ গুণ সওয়াব দেয়ার এই ওয়াদা দুনিয়ার কোনো মানুষের নয়, বরং মহান আল্লাহর পক্ষ থেকেই করা হয়েছে। আর এটিকে কোনো বিশেষ নেকীর সাথেও সীমাবদ্ধ করা হয়নি; বরং বলা হয়েছে যেকোনো ধরনের নেকী, হোক তা ফরয কিংবা নফল। হোক একবার সুবহানাল্লাহ বলা কিংবা আলহামদু লিল্লাহ বলা। তার সওয়াব ১০ গুণ বৃদ্ধি পাবে।

মহান আল্লাহর একান্ত ইচ্ছা তাঁর প্রত্যেক বান্দা তাঁরই ইবাদাত সম্পন্ন করার মাধ্যমে ইহ ও পরকালীন জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলবে। ইবাদাত মূলত দুই প্রকার। ফরয ইবাদাত, যেমন নামায, রোযা, হজ্জ্ব, যাকাত ইত্যাদি; নফল ইবাদাত, যেমন নফল নামায, কুরআন তিলাওয়াত, দান-খয়রাত, নফল রোযা রাখা ইত্যাদি।
মানব জাতি মূলত তখনই মহান আল্লাহর নিকট প্রকৃত সম্মানিত ও প্রিয় হবে যখন তার প্রতিটি কাজ হবে একমাত্র তাঁরই উদ্দেশে। সুখে-দুঃখে একমাত্র তাঁরই ইবাদাত করবে, তাঁকেই ভালবাসবে। তাঁরই নৈকট্য লাভের চেষ্টায় সর্বদা ব্যস্ত থাকবে। ফরয ইবাদাত সম্পন্ন করার সাথে সাথে নফল ইবাদাতে অধিক মনযোগী হবে। নফল ইবাদাতসমূহের মধ্যে নফল রোযা বান্দাকে অতি সহজেই মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছে দেয়। কারণ রোযা এমন একটি ইবাদাত যা জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাবার জন্য ঢালস্বরূপ এবং এর প্রতিদান স্বয়ং আল্লাহ দিয়ে থাকেন।

মহানবী সা:-এর বাণী : মুসলমান ব্যক্তি যাতে শুধু রমযানের রোযা রেখেই থেমে না যায়, বরং অল্প কিছু রোযা রেখে পুরো বছরের রোযা রাখার মর্যাদা লাভ করতে পারেন তার এক মহাসুযোগ করে দিয়ে মহানবী সা: বলেছেন, “যে ব্যক্তি রমযান মাসে ফরয রোযা পালন করলো, অতঃপর শাওয়াল মাসে আরও ৬ দিন রোযা পালন করলো, সে যেন সারা বছর রোযা রাখলো” (সহীহ মুসলিম)। অর্থাৎ একজন ব্যক্তি যখন রমযান মাসের রোযা রেখে তার সাথে সাথে শাওয়াল মাসের ৬টি রোযা রাখলো সে এই রোযার কারণে মহান আল্লাহর দরবারে পূর্ণ একটি বছর রোযা রাখার সাওয়াব পেয়ে গেলো। অপর এক হাদীসে এসেছে, “যে ব্যক্তি রমযানের রোযা শেষ করে শাওয়াল মাসে ছয় দিন রোযা রাখবে, সেটা তার জন্য পুরো বছর রোযা রাখার সমতুল্য” (মুসনাদে আহমদ, দারেমী)।

বিশ্লেষণ : যদি কোনো ব্যক্তি রমযান মাসের ৩০টি রোযা রাখে, তাহলে তার ১০ গুণ ৩শত রাত হবে। আর শাওয়ালের ৬ রোযার ১০ গুণ ৬০ হবে। এমনিভাবে সব রোযার সাওয়াব মিলে ৩৬০ দিন হয়ে গেল। আর আরবী দিনপঞ্জীর হিসেবে ৩৬০ দিনেই তো বছর পূর্ণ হয়।

শিক্ষা : হাদীসদ্বয় থেকে আমরা যে শিক্ষা পেয়ে থাকি তা হলো-
শাওয়ালের ৬টি রোযার গুরুত্ব ও ফযিলত অবগত হওয়া গেল। ক্ষুদ্র আমল কিন্তু অর্জন বিশাল।
বান্দার প্রতি মহান আল্লাহর সীমাহীন দয়ার বহিঃপ্রকাশ। অল্প আমলেই অধিক প্রতিদান প্রপ্তির নিশ্চয়তা।
কল্যাণকর কাজে প্রতিযোগিতাস্বরূপ এই ৬ রোযার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা মুস্তাহাব, যাতে রোযাগুলো ছুটে না যায়। কোনো ব্যস্ততাই যেন পূণ্য আহরণের এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত করতে না পারে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
নফলসমূহ ফরজের ত্রুটিগুলোর ক্ষতিপূরণ করে। অর্থাৎ জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে রোযাদার কর্র্তৃক যে ভুলত্রুটি হয়ে থাকে নফল রোযা তা দূর করতে সহায়তা করে।

শাওয়ালের ৬ রোযার উপকারিতা : এ রোযা ফরয নামাজের পর সুন্নাতে মুয়াক্কাদার মত। যা ফরয নামাযের অসম্পূর্ণতাকে পূর্ণ করে। অনুরূপভাবে শাওয়ালের ৬ রোযা রমযানের ফরয রোযার অসম্পূর্ণতাকে সম্পূর্ণ করে এবং তাতে কোন ত্রুটি থাকলে তা দূর করে।

কখন এবং কিভাবে রাখবো : শাওয়ালের ৬টি রোযা রাখা যাবে মাসের শুরু-শেষ-মাঝামাঝি সব সময়। ধারাবাহিকভাবে বা বিরতি দিয়ে যেভাবেই করা হোক, রোযাদার অবশ্যই এর সওয়াবের অধিকারী হবেন। একথা স্মরণ রাখতে হবে যে, শাওয়ালের ৬ রোযার সাথে রমযানের কাযা রোযা আদায় হবে না। উভয় রোযাই আলাদা আলাদা রাখতে হবে। প্রথমে রমযানের কাযা রোযা রাখতে হবে, তারপর ৬ রোযা রাখবে। যদি পুরো মাসই কাযা রোযায় শেষ হয়ে যায় এবং নফল রোযা রাখার সুযোগ না পাওয়া যায়, তবুও মহান আল্লাহ বান্দার মনের আকাক্সক্ষার কারণে তাকে ঐ ৬ রোযারও সওয়াব দিবেন বলে আমরা আশা করি। মা-বোনদের এ দিকটি খেয়াল রাখা উচিত যে, প্রাকৃতিক কারণে প্রতি রমযানে যে রোযাগুলো কাযা হয়ে যায়, তাদের উচিত প্রথমে সেই কাযা রোযাগুলো আদায় করা। এরপর শরীর সুস্থ ও সুযোগ থাকলে পূর্ববতী বছরের কাযা রোযা আদায় করা। যদি কোনো কাযা রোযা না থাকে তাহলে শাওয়ালের ৬ রোযা রাখাই হবে উত্তম। কারণ মহানবী (সা:) বলেছেন. “যে রমযানের রোযা রাখবে সে যেন পুরোপুরি রাখে। যার উপর কাযা রয়ে গেছে, তার রোযাগুলো পূর্ণ হয়েছে বলে গণ্য করা হবে না, কেননা সে তার কাযা আদায় করেনি” (মুগনি)। উল্লেখ্য, শাওয়ালের রোযা হচ্ছে নফল আর রমযানের রোযা হচ্ছে ফরয। আর রমযানের কাযা রোযা আদায় করাও ফরয।

শেষ কথা : প্রত্যেক সুস্থ সবল ব্যক্তির উচিত শাওয়াল মাসের ফযিলাতপূর্ণ ৬টি রোযা রেখে পূর্ণ এক বছর রোযা রাখার সমান সওয়াব হাসিল করে মহান আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্য লাভে ধন্য হওয়া। কোনো মুমিন নারী পুরুষ যদি তার অপর কোনো ভাই বোনকে এই রোযা রাখতে উদ্বুদ্ধ করেন এবং সে যদি তার পরামর্শে রোযা রাখেন, তবে উদ্বুদ্ধকারীও সাওয়াব পাবেন। উল্লেখ্য যে, কেউ নফল রোযা রেখে ভেঙ্গে ফেললে তার কাযা আদায় করা ওয়াজিব।
লেখক : গবেষক

আরো পড়ুন :
হালাল হারামের বিধান
আলাউদ্দিন ইমামী

কোনো মানুষ মুসলমান হয়ে থাকলে হালাল হারামের বিধান জানা এবং মেনে চলা তার জন্য ফরজ। কারণ হালাল হারামের বিধান আল্লাহ প্রদত্ত এবং রাসূল প্রদর্শিত বিধান। এ বিধানের উল্টো চলা কবিরা গুনাহ ও হারাম। ক্ষেত্র বিশেষে কুফরি এবং শিরিক। আল্লাহর দেয়া হালাল হারামের বিধান অমান্য করে কেউ যদি কোনো বিধান চালু এবং জারি করে, তা হবে বেঈমানি ও কুফরি। যারা এরকম বিধান চালু করে তারা তাগুত। যারা তাগুতি এ বিধান মান্য করে তারা শিরিককারী। আল্লাহর আইন ও শাসন বাদ দিয়ে তাগুতি আইন ও শাসনের গোলামি গ্রহণ করার কারণেই মুসলমানদের ওপর আজ আল্লাহর অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয় ও প্রাকৃতিক গজব চলছে। যেমন চলেছিল বনি ইসরাইল আর ইহুদিদের ওপর। কারণ বর্তমান বিশ্বের মুসলমানেরা নামে মুসলমান হলেও কাজে প্রায় বনি ইসরাইলের ইহুদিদের মতো। তাই আল্লাহ বলেন, ‘তাদের অনেকেই আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে বটে, আবার শিরিকও করে’ (সূরা ইউছুফ : ১০৬) তিনি আরো বলেন, ‘তারা তাগুতকে হুকুমদাতা বানাতে চায় অথচ তাদের আদেশ করা হয়েছিল তাগুতকে অস্বীকার ও অমান্য করতে’ (সূরা নিছা : ৬০)।

আল্লাহর আরো বলেন, ‘তোমরা যদি তাদের কথা মতো চলো তাহলে তোমরা শিরিককারী হয়ে যাবে’ (সূরা আনয়াম : ১২১)। অপর আয়াতে বলেন, ‘তারা যদি শিরিক করে তাদের সমস্ত আমল (নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত) বরবাদ হয়ে যাবে’ (সূরা আনয়াম : ৮৮)। আল্লাহ অপর আয়াতে বলেন, ‘জলে স্থলে যত অরাজকতা সব মানুষের হাতের কামাই’ (সূরা রুম : ৪১)। হালাল হারামের এ বিধান মান্য করা মুসলমানদের জন্যই শুধু ফরজ। অমুসলমানগণ আল্লাহর নিরঙ্কুশ একত্ববাদের প্রতি ঈমান না আনার কারণে হালাল হারামের এ বিধান তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। মুসলমান দেশে দেশে আল্লাহর যত গজব চলছে, সবই মুসলমানদের পাপের এবং আল্লাহর রাসূলের সা: বিরোধিতার কারণেই চলছে। অমুসলমানদের কারণে নয়।

কোনো ব্যক্তি, শক্তি, প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন অথবা কোনো দল যদি আল্লাহর দেয়া হালাল হারামের বিধান লঙ্ঘন করার মতো অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়, তা প্রতিরোধ করে হালাল হারামের বিধান চালু করা মুসলমানদের ঈমানি দায়িত্ব। আল্লাহর নবী সা: বলেন, ‘তোমরা যদি কেউ কোনো অন্যায় দেখো তা হাতে বদলিয়ে দাও। যদি সম্ভব না হয় মুখে প্রতিবাদ করো। তাও যদি অসম্ভব হয় অন্তরে ঘৃণা করো (তার থেকে দূরে থাক)। ইহা সবচেয়ে দুর্বল ঈমানের পরিচয়’ (হাদিস)। অপর হাদিসে তিনি বলেন, ‘ হে সাহাবাগণ! শিগগিরই কুরআন থেকে শাসন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তখন শাসকেরা এমন হুকুম ও বিধান দেবে, তোমরা মান্য করলে তোমাদের গুনাহ্ হবে। অমান্য করলে তারা তোমাদের হত্যা করবে’ (হাদিস)। ইমাম হোসাইন রা: এবং কারবালার শহীদরা এর জ্বলন্ত প্রমাণ। এ রাজনীতির কারণে বর্তমান বিশ্বে মুসলমানের দেশে দেশে আজ কারবালা চলছে।

আল্লাহকে বিশ্বাস ও ভয় করে ইসলামের হালাল হারামের বিধান মেনে চলার ওপরই নির্ভর করে দুনিয়ার সুখ, শান্তি ও উন্নতি। আল্লাহ বলেন, ‘এলাকার লোকেরা যদি আল্লাহকে বিশ্বাস করে এবং ভয় করে চলে, আমি তাদের জন্য আসমান জমিনের বরকতের সব দরজা খুলে দেবো’ (সূরা আরাফ : ৯৬)। এ জন্যই আল্লাহ বলেছেন, ‘হে ঈমানদারেরা! আল্লাহকে বিশ্বাস করো’ (সূরা নিসা : ১৩৬)।

কোনো কথা কাজ ও বিশ্বাসে অন্য কোনো ব্যক্তি শক্তি প্রতিষ্ঠান দল ও পার্টিকে আল্লাহর সমান বানানোটা হচ্ছে শিরিক। আর এ শিরিক থেকে মুক্ত হওয়া মুসলমানদের জন্য ফরজ। কুরআন বর্জিত হারাম রাজনীতি করে আল্লাহর সাথে শিরিক করার কারণেই আল্লাহর গজবস্বরূপ মুসলমানের দেশে দেশে আজ অরাজকতা। সঙ্ঘাত সংঘর্ষ। পারিবারিক ও সামাজিক অশান্তি। রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা।
লেখক : খতিব

 


আরো সংবাদ



premium cement