২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ধান ক্ষেতের আইলে অবৈধ বৈদ্যুতিক তারে যুবকের মৃত্যু, মামলা নিচ্ছে না পুলিশ 

বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে নিহত রংপুরের বদরগঞ্জের সরদারপাড়া গ্রামের জিকরুল মিয়ার দিশেহারা পিতামাতা - নয়া দিগন্ত

বিয়ের আংটি পড়ানোর কথা ছিল বিকেল বেলা। ঘটক পক্ষের লোকজনও বাড়িতে এসে বসেছিল। কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠেনি সদ্য মাস্টার্স পাশ করা জিকরুল মিয়ার (২৮)। সেচ জমিতে যাওয়ার পথে বাড়ির পাশের মজিবর রহমান ও তার পুত্রদের অবৈধভাবে জমির আইল দিয়ে নেয়া বিদ্যুতের সেচ তারে জড়িয়ে মারা গেছেন তিনি। ঘটনাটি ঘটেছে রংপুরের বদরগঞ্জের দামোদারপুর ইউনিয়নের সরদারপাড়া গ্রামে। ঘটনার আকস্মিকতায় একমাত্র পুত্র সন্তানকে হারিয়ে দিশেহারা পিতামাতা। সন্তান হত্যার বিচার চেয়ে স্থানীয় থানা পুলিশ ও চেয়ারম্যানদের কাছে ধর্না দিয়েও কোন ফল মেলেনি। বাধ্য হয়ে ডিআইজির বরাবরে সুষ্ঠু বিচারের আশায় লিখিত আবেদনের প্রেক্ষিতে অতিরিক্ত ডিআইজি সরেজমিনে পরিদর্শন করে বদরগঞ্জ থানার ওসিকে ঘটনাস্থল থেকেই ভূক্তভোগির মামলা নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশও তিনদিনেও মানেন বদরগঞ্জ থানা পুলিশ। উপরন্তু অসহায় পরিবারটির ওপরই দোষ চাপিয়ে মূল অপরাধীদের আড়াল করার চেস্টা করছে পুলিশ ও স্থানীয় চেয়ারম্যান। 

ভুক্তভোগির পরিবার, এলাকাবাসি ও রংপুর রেঞ্জ পুলিশের ডিআইজির কাছে দেয়া লিখিত অভিযোগ সূত্রে প্রকাশ, রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার দামোদরপুর (সর্দারপাড়া) গ্রামের নুরুল হকের একমাত্র পুত্র জিকরুল মিয়া (২৮) গত ৫ আগস্ট সকালে জমিতে কাজ করার বের হন। জমিতে যাওয়ার পথে প্রতিবেশী মজিবর ও তার পুত্র কর্তৃক অবৈধভাবে জমির আইল দিয়ে নিয়ে যাওয়া বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যান তিনি। জিকরুল কারমাইকেল কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স পাশ করে ন্যাশনাল সার্ভিসের আওতায় স্থানীয় একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন পাশাপাশি বিভিন্ন চাকরীর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। খবর শুনে সেখানে হাজার হাজার গ্রামবাসির পাশাপাশি পুলিশ ও সাংবাদিকরাও উপস্থিত হন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন এবং অনুসন্ধান চালানোর পর পুলিশের এস আই ঈসমাইল হোসেন জিকরুলের পিতা নুরুল হক এবং দুই বোন নাজমা ও নিতুন জেরার  কাছ থেকে ময়না তদন্তের কথা বলে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেয়। মজিবর রহমান প্রভাবশালী হওয়ায় ময়না তদন্ত ছাড়াই

স্থানীয় চেয়ারম্যান আজিজুল হক এলাকাবাসী ও জিকরুলের আত্মীয় স্বজনকে লাশ দাফনের চাপ সৃষ্টি করে এবং এ ঘটনার সঠিক বিচারের প্রতিশ্রুতি দেন। পুলিশ ও স্থানীয় চেয়ারম্যানের চাপে ও বিচারের আশ্বাসে এলাকাবাসি ময়না তদন্ত ছাড়াই লাশ দাফন করে। কিন্তু কোন ধরনের বিচার না হওয়ায় নিহত জিকরুলের মা জিন্নাত বেগম পুত্র হত্যার বিচার চেয়ে বদরগঞ্জ থানায় এজহার দায়ের করে। কিন্তু পুলিশ সেটি মামলা হিসেবে গ্রহণ করেনি।

নিহত জিকরুলের মা জিন্নাত বেগম জানান, বদরগঞ্জ থানা পুলিশ ও চেয়ারম্যানের কাছ থেকে কোন বিচার না পেয়ে আমি আমার পুত্র হত্যার বিচার চেয়ে গত ১৮ আগষ্ট রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি বরাবরে একটি লিখিত আবেদন করি। অভিযোগ দায়েরের পরের দিনই অতিরিক্ত ডিআইজি (অপরাধ) জাহেদুল ইসলামের নেতৃত্বে পুলিশের একটি প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। ঘটনাস্থল থেকে অতিরিক্ত ডিআইজি (অপরাধ) শত শত গ্রামবাসি এবং সাংবাদিকদের সামনেই বদরগঞ্জ থানার ওসিকে বলেন, আমি জিকরুলের বাবা মাকে পাঠাচ্ছি, আপনি মামলা নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। তিনি চলে যাওয়ার পর আমরা থানায় যাই এজহার নিয়ে। কিন্তু ওসি আমাদের এজহার নিলেও মামলাটি রেকর্ড করেননি। বরং থানায় চেয়ারম্যানকে ডেকে নিয়ে এসে আমাদেরকে মিমাংসার জন্য চাপ দিতে থাকেন। বিষয়টি আমরা আবারও ডিআইজিকে বুধবার দুপুরে তার দপ্তরে গিয়ে জানিয়ে এসেছি। তিনি আমাদের বলেছেন, আমরা তদন্ত করছি, তদন্ত করে ব্যবস্থা নিবো।

বুধবার ডিআইজি অফিস থেকে বের হয়ে জিকরুলের পিতা নুরুল হক কাঁদতে কাঁদতে বলেন, একটি পরিবার প্রতিহিংসা বশত জমির আইল দিয়ে বিদ্যুতের তার নিলো। সেখানে মিটার না পাওয়া সত্ত্বেও বাড়ির বিদ্যুতের লাইন দিয়ে রেখেছিল। আমার ছেলেটা জমিতে কাজ করার জন্য রওনা দিয়ে মারা গেলো। এখন তারাই আমাদের হুমকি দিচ্ছে। ডিআইজি স্যারের নির্দেশে আমরা বদরগঞ্জ থানায় গেলাম সেখানে ওসি আমাদেরকে বললো এখানে মামলা হবে না, আপনারা কোর্টে গিয়ে মামলা করেন। 

তিনি আরও বলেন, বদরগঞ্জ থানার পুলিশ ও স্থানীয় চেয়ারম্যানকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে মজিবর ও তার পুত্ররা উল্টো বলে বেড়াচ্ছে আমাদেরই নাকি ওই তার ছিল। পুলিশ ও স্থানীয় চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে হাজার হাজার মানুষের সামনে সেদিন মজিবুর ও চারপুত্র গোলাম মর্তুজা, মোকতাজুর রহমান ও কামরুজ্জামান এবং মিডিয়ার কর্মীদের সামনে স্বীকার করলো আইল দিয়ে তারা তার নিয়ে গিয়েছে এবং ভুল করে লাইন দেয়ায় এই ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার ভিডিও ডকুমেন্টও আছে। অথচ আমার পুত্রকে মাটি দেয়ার পর পরই তারা এখন সব কিছু পাল্টে দিলো। পুলিশ চেয়ারম্যানকে কিনে নিয়ে ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে দিলো।

বুধবার ডিআইজি স্যারকে বিষয়গুলো বলে ন্যায় বিচার চেয়েছি। তিনি বলেন, আমি বুকের ধন হারিয়েছি। এভাবে যেন আর কোন পিতাকে আগে পুত্রের লাশ কাঁধে নিতে না হয়। যদি আমার পুত্রের হত্যার বিচার না হয়, তাহলে এভাবে আরও অনেক পিতার বুক খালি হবে।

নিহতের জ্যাঠাতো ভাই সোহান হাবিব জানায়, জিকরুল রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে এম এ পাশ করে। ঘটনার দিনে জিকরুলের বিয়ের আংটি পড়ানোর কথা ছিল। কিন্তু সেদিনই সে মজিবুর আর তার পুত্রদের অবৈধ বিদ্যুতের তারে মারা গেলো। কিন্তু তার কোন বিচার হচ্ছে না। পুলিশ ও চেয়ারম্যানকে দিয়ে বিষয়টি আড়াল করার চেষ্টা করছে।

এলাকাবাসি হাফিজা বেগম জানান, মজিবর ও তার পুত্ররা এলাকার কাউকেই মানে না। এতবড় একটা ঘটনা ঘটলো। অথচ তারা সেটা নিয়ে এখন বাড়াবাড়ি করছে। বলছে আমাদের আইলে আমরা তার দিয়েছি। কে মারা গেলো না গোলা সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। আমরা এ ঘটনার বিচার চাই। এভাবে যেন আর কেউ মারা না যায়।

এ ব্যাপারে অভিযুক্ত মজিবুর রহমান ও  তার পুত্র বাবু জানান,  আমরা সেচ মিটারের জন্য আবেদন করেছিলাম। কিন্তু পাই নাই। বাড়ির ব্যবহৃত মিটার থেকে তার টেনে অন্যের বোডিংয়ের মাধ্যমে সেচ কাজ চালাচ্ছিলাম। আমাদের জমির ওখানে খুটি না দিয়ে আইল দিয়েই তার নিয়ে গিয়েছিলাম। ওই তারে লাইন দেয়াছিল। জিকরুলও জমিতে সেচ দেয়ার জন্য যাচ্ছিল। সে না দেখে আইল পার হওয়ার কারণে বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছে। 

স্থানীয় চেয়ারম্যান আজিজুল ইসলাম জানান, মজিবর ও তার পুত্রদের অবৈধ বিদ্যুতের লাইনের তারেই জিকরুল মারা গেছে। বিষয়টি সমঝোতা হওয়ায় ময়না তদন্ত ছাড়াই জিকরুলের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। এখন মজিবর ও তার পুত্ররা বিষয়টিকে ভিন্নখাতে নেয়ার জন্য আমার এবং পুলিশের ওপর দায় চাপাচ্ছে। 

এ ব্যাপারে বদরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ আরিফ আলী (দায়িত্বপ্রাপ্ত) বলেন, জিকরুল বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে মারা যাওয়ার ঘটনায় চেয়ারম্যান এবং পরিবারের সম্মতিক্রমেই ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করা হয়েছে। এ ঘটনায় আমরা একটি ইউডি মামলা করেছিলাম। এরই মধ্যে ডিআইজি অফিস থেকে তদন্ত এসেছিল। সেখান অতিরিক্ত ডিআইজি অপরাধ আমাকে মামলা নেয়ার কথা বলেছেন। জিকরুলের পিতামাতা থানায় এসে এজাহার করেছেন। বিষয়টি তদন্ত করেই আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

এ ব্যাপারে রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি দেবদাস ভট্রাচার্য বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমি অভিযোগ পাওয়ার পর সরেজমিনে পরিদর্শনের জন্য টিম পাঠিয়েছিলাম। ব্যাপারটি খুবই দু:খজনক। জিকরুলের মৃত্যুর কারণে পুরো পরিবারই দিশেহারা। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। আজও (বুধবারও) তারা আমার দপ্তরে এসেছিল। আমি কথা বলেছি। তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।


আরো সংবাদ



premium cement