২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

‘জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে’

- ছবি : নয়া দিগন্ত

বিএনপি মহাসচিব ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, অবিলম্বে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও ফলাফল বাতিল করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। মানুষ একাদশ জাতীয় সংসদ নিবাচনের রাতে ভোট চুরি ও দিনে ডাকাতির ক্ষোভ এবং খুন গুম ধর্ষণের শোককে শক্তিতে পরিণত করে আন্দোলন মুখর হয়ে উঠেছে। এই আন্দোলন দুর্বার তরঙ্গে রুপ নিবে। আন্দোলনের মাধ্যমে এই গণশত্রুকে সরিয়ে দিতে হবে।

সোমবার দুপুরে লালমনিরহাটের রাজপুর ইউনিয়নের খলাইঘাটে ৩০ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের হাতে নিহত ইউনিয়ন বিএনপির পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক তোজাম্মেল হোসেন স্মরণে প্রতিবাদ সমাবেশে তারা এসব কথা বলেন।

ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি লিয়াক আলীর সভাপতিত্বে এসময় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন জেএসডির সভাপতি আসম আব্দুর রব, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকি, ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিএনপির রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব দুলু।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণতন্ত্র লুট হয়েছে উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে মির্জা ফখরুল বলেন, যে দলটি গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে, যে দলটির নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। তারাই এখন গণতন্ত্রকে লুট করেছে, ডাকাতি করেছে। আর খালেদা জিয়া গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন। তাকে সাজানো মামলায় কারাগারে নেয়া হয়েছে।

আওযামী লীগ এখন গণশত্রুতে পরিনত হয়েছে উল্লেখ করে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মির্জা ফখরুল বলেন, আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, ইউএনও, ডিসি, সেনাবাহিনী নিয়োগ করে তাদেরকে দিয়ে ভোটের রাতে সিল মেরে রাখে এবং ভোটের দিন আওয়ামী লীগের গুন্ডাবাহিনী প্রকাশ্যে ভোট ডাকাতি করেছে। এরমাধ্যমে তারা গণশত্রুতে পরিণত হয়েছে। জনগনের সেই মনের ভাষা আর মুখের ভাষা বোঝার ক্ষমতা আর আওয়ামী লীগের নেই। কখনও হবেও না।

উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে মির্জা ফখরুল বলেন, যতই জুলুম হোক না কেন ঐক্যবদ্ধ থাকবেন। জনগণের ঐক্য এবং জাতীয় ঐক্য একত্রিত হয়ে এই আওয়ামী লীগ নামের এই দানব সরকারকে উৎখাত করা হবে। আমাদের আন্দোলন গণতন্ত্রকে উদ্ধার করার আন্দোলন। আমাদের আন্দোলন খালেদা জিয়াকে মুক্তির আন্দোলন। আমাদের আন্দোলন তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনার আন্দোলন। আমাদের আন্দোলন খুন, গুম, ধর্ষণর শিকার হওয়া, মিথ্যা মামলায় কারাবন্দি ও নির্যাতিত মানুষকে মুক্তির আন্দোলন। আমাদের আন্দোলন দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ফিরিয়ে আনার আন্দোলন। ভোটের অধিকার ফিরিয়ে এনে একটি সমৃদ্ধশালী সবার জন্য বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলন। তাই অবিলম্বে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও ফলাফল বাতিল করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগনের সরকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আমাদের এই আন্দোলন চলবে।

খুন হওয়া বিএনপি নেতা তোজাম্মেল হোসেনকে গণতন্ত্রের জন্য শহীদ উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেনে, ৩০ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের তল্পিবাহক গুন্ডারা রাজপুরের তোজাম্মেল হককে হত্যা করেছে। তোজাম্মেল গণতন্ত্রের জন্য জীবন দিয়ে শহীদ হয়েছেন। এরকম আরও ২২ জন নেতাকর্মী শহীদ হয়েছেন। আওয়ামী লীগের গুন্ডারা ধানের শীষে ভোট দেয়ার জন্য নোয়াখালীতে এক গৃহবধূকে ধর্ষণ করেছে। আমাদের এক যুবদলের নেতার স্ত্রীকে ধানের শীষে ভোট দেয়ার জন্য ধর্ষণ করেছে।

মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা ভোটের আগে জাতীয় ঐক্য তৈরি করেছিলাম। সেসময় মানুষের মধ্যে উচ্ছ্বাসের তরঙ্গ তৈরি হয়েছিল। মানুষ ভেবেছিল ভোটাধীকার প্রয়োগ করে আওয়ামী লীগের ভয়াবহ শাসন থেকে মুক্তি পাবেন। কিন্তু মানুষ সেটা পারেন নি। জনগনের ভোটাধিকার অধিকার কেড়ে নিয়ে আওয়ামী লীগ নিজেদের নির্বাচিত ঘোষণা করেছে।

তিনি বলেন, তারা নিজেরাই নিজেদের জিতিয়ে নিয়ে এখন উৎসব করছে। গত ১০ বছরে দেশকে একটি বিভিষিকাময় পরিস্থিতি তেরি করেছে আওয়ামী লীগ। মিথ্যা মামলা, গায়েবি মামলা দেয়া হচ্ছে। আওয়ামী লীগ এবং প্রশাসনের লোকজন বিভিন্ন লোকের কাছে টাকা দাবি করছেন, টাকা না দিলে তাদের গায়েবি মামলায় গ্রেফতার করা হচ্ছে। খুন-গুম-ধর্ষণের স্বর্গরাজ্য বানিয়েছে আওয়ামী লীগ। গত ১০ বছরের অনেক মা ও স্ত্রীরা রাত জেগে আশায় থাকেন কখন তাদের গুম হওয়ার স্বামী সন্তান আসবেন। সারাদেশে ৯৮ হাজার মামলা দেয়া হয়েছে। কমবেশি ২৬ লাখ নেতাকর্মী সাধারণ মানুষের নামে মামলা দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের মাধ্যমে পুলিশসহ প্রশাসনকে মানুষের প্রতিপক্ষ বানিয়ে দিয়েছে।

জেএসডি সভাপতি আসম আব্দুর রব বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোন ভোট হয়নি। ২৯ তারিখ রাতে চুরি হয়েছে। ৩০ তারিখ দিনের বেলা ভোট ডাকাতি হয়েছে। ধানের শীষে ভোট দিতে যাওয়ার অপরাধেই তোজাম্মেলকে খুন করা হয়েছে। তোজাম্মেল হত্যার বিচার করতে হবে। দোষীদের গ্রেফতার করতে হবে। বাংলার মটিতে এসব হত্যার বিচার হবেই।

সম্মিলিতভাবে ভোট ডাকাতদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার আহবান জানিয়ে রব বলেন, বাংলাদেশে ভোটের অধিকার নিশ্চিত না হলে কেউ শান্তিতে তাকতে পারবেন না। যে বিভিষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা কখনও শেষ হবে না।

রব বলেন, এককভাবে এই ভোট ডাকাতদের মোকাবেলা করা যাবে না। সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে গণতন্ত্রের স্বার্থে, মানবসভ্যতার স্বার্থে, আমাদের আগামী প্রজন্মের স্বার্থে এদের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখতে হবে। আমরা লড়বো। মাঠ থেকে কখনও সরবো না।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট সহচর বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেন, মুক্তিযুদ্ধ করে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করতে পেরেছি। এখনও আমি শেখ হাসিনার বাবা বঙ্গবন্ধুর জন্য জীবন দিতে পারি। কিন্তু তার কন্যা ৩০ ডিসেম্বর যে নির্বাচন করেছেন, তা সারা বিশ্বে সেরা ডাকাতির নির্বাচন হয়ে কলংকের ইতিহাস তৈরি করেছে। যদি আমরা নির্বাচনে না যেতাম তাহলে বিশ্বের সেরা ভোট ডাকাতির প্রমাণ পাওয়া যেতো না। এখন সারা বিশ্বে এটি প্রমাণিত হয়েছে। পুলিশ ভোজ সভা করার মাধ্যমে সেটার দলিল দিয়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের মহা জয় নয় মহা পরাজয় হয়েছে।

আন্দোলনে জনগন বিজয়ী হবে উল্লেখ করে বঙ্গবীর বলেন, ৩০ ডিসেম্বর প্রহসনের নির্বাচনে তোজাম্মেল হোসেন খুন হয়েছেন। এই সরকার ভোটের রাতে চুরি করেছে। আর দিনে করেছে ডাকাতি। আমরা পাকিস্তার হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করেছি। পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি তাদের থেকে বড় নয়। এখন আওয়ামী লীগ উৎসব করছে। এরপর সেটা কাল হয়ে দাড়াবে। মাঝখানে তারা জিরো হয়ে যাবে। আপনারা বিজয়ী হবে। জনগন বিজয়ী হবে।

সভায় ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, প্রতিবাদ সমাবেশে বিপুল পরিমান মহিলাদের উপস্থিতি প্রমাণ করেছে তারা ভোট না দিতে পেরে ক্ষুব্ধ। পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও প্রশাসনের লোকজনদেরকে দিয়ে যেভাবে ভোট ডাকাতি করা হয়েছে তা কলংকের ইতিহাস তৈরি করেছে। এর প্রতিবাদে আন্দোলন অব্যাহত রাখতে হবে। আন্দোলন ছাড়া কোন উপায় নেই।

এসময় রংপুর মহানগর বিএনপির সভাপতি মোজাফফর হোসেন, সেক্রেটারী শহিদুল ইসলাম মিজু, সহ সভাপতি এ্যডভোকেট রেজেকা সুলতানা ফেন্সি, জেলা সভাপতি সাইফুল ইসলাম, সেক্রেটারী রইচ আহমেদ, জেলা যুবদল সভাপতি নাজমুল আলম নাজু, লালমনিরহাট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান বাবলা, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রোকন উদ্দিন বাবলু, সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন লেমন, জেলা যুবদল সভাপতি জাহিদুল ইসলাম খোকন, জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সাত্তার, জেএসডির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও রংপুর জেলা সভাপতি আমিন উদ্দিন বিএসসি, সেক্রেটারী ডা. সাদেক আলী, হারাগাছ পৌরসভা সভাপতি শরিফুল ইসলামসহ কেন্দ্রীয় এবং রংপুর ওলালমনিরহাটের নেতৃবৃন্দ মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।

প্রতিবাদ সমাবেশের আগে মির্জা ফখলরুল ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের নিয়ে নিহত তোজাম্মেল হোসেনের কবরে ফাতেহা পাঠ শেষে মোনাজাতে অংশ নেন। পরে তারা নিহত তোজাম্মেল হোসেন ও আহতদের পরিবারের সাথে দেখা করে তাদের সমবেদনা জানান এবং আর্থিক অনুদান দেন।

প্রসঙ্গত, গত ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের দিন লালমনিরহাট সদরের রাজপুর ইউনিয়নের পাগলাহাট সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্র ভোট দিতে গেলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও ইউপি চেয়ারম্যান মোফাজ্জল হোসেন মোফার নেতৃত্বে ইউনিয়ন বিএনপির পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক সম্পাদক তোজাম্মেল হোসেনকে ছুড়ি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এসময় আরও ৯ জন আহত হন। এ ঘটনায় থানায় মামলা না নেয়ায় ইউপি চেয়ারম্যান মোফাসহ ৯ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে মামলা করেন নিহতের পুত্র মোস্তফা। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি।


আরো সংবাদ



premium cement