২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
ঠাকুরগাঁও-২ আসন

ইমেজ সঙ্কটে আওয়ামী লীগ মাঠে তৎপর জামায়াত

ইমেজ সঙ্কটে আওয়ামী লীগ মাঠে তৎপর জামায়াত - ছবি : সংগৃহীত

বালিয়াডাঙ্গী-হরিপুর ও রানীশংকৈল উপজেলার ধর্মগড় ও কাশিপুর ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ঠাকুরগাঁও-২ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা দুই লাখ ৭৩ হাজার ৪১৪ জন। সব নির্বাচনেই এই আসনে এমপি হয়ে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছিলেন আওয়ামী লীগের এমপি দবিরুল ইসলাম। তবে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে সংখ্যালঘুদের জমি দখল, নির্যাতন, হুমকি-ধমকি, নিয়োগবাণিজ্য ও পারিবারিক দাপটের কারণে বর্তমানে ইমেজ সঙ্কটে ভুগছেন তিনি। ফলে তার এই ইমেজ সঙ্কটকে কাজে লাগাতে চায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। ঠাকুরগাঁও-২ আসনে এবারো ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা আব্দুল হাকিম। তার পক্ষে কৌশলী প্রচারণা চালাচ্ছেন জামায়াতে ইসলামী ও জোটের নেতাকর্মীরা। তারা গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মাঠে তৎপর রয়েছেন।

আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড : জানা যায়, দীর্ঘ দিন ধরে ঠাকুরগাঁও-২ আসনের এমপি দবিরুল ইসলাম। একই সাথে তিনি ঠাকুরগাঁও জেলা আওয়ামী লীগেরও সভাপতি। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দাবিÑ দবিরুল ইসলাম তার নির্বাচনী আসনের বিভিন্ন সাংগঠনিক পদে পরিবারের সদস্যদের বসানোর কারণে অনেকটাই প্রভাব বিস্তার করে রেখেছেন। একই সাথে তার কিছু কর্মকাণ্ড বিতর্কেরও জন্ম দিয়েছে। বালিয়াডাঙ্গী ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা লীগ ও যুবলীগের বড় পদগুলো তার পরিবারের সদস্যদের হাতে। এ ছাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান তার ভাই-ভাতিজা। ছেলে সুজন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। নানা কারণেই ঠাকুরগাঁও-২ আসনে দবিরুলের পরিবারতন্ত্রের জিম্মিদশা থেকে মুক্তি চান এলাকাবাসী। বিশেষ করে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে নতুন মুখ চেয়েছিলেন তারা। কিন্তু তা আর হয়নি। এবারো আওয়ামী লীগ দবিরুলকেই মনোনয়ন দিয়েছে। তিনি এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণাও চালাচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঠাকুরগাঁও-২ আসনে দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে আধিপত্য ধরে রেখেছেন মো: দবিরুল ইসলাম। ১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালে তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) থেকে ১৫ দলীয় ঐক্যজোটের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। পরে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে কখনো জাতীয় পার্টির সাথে, কখনো বা বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সাথে নির্বাচনে লড়াই করেন। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হন তিনি। এ কারণে এলাকার লোকজন তাকে ভোটের ‘জাদুকর’ হিসেবে মনে করেন। বালিয়াডাঙ্গী ও হরিপুর উপজেলা ছাড়াও ঠাকুরগাঁও-২ আসনের আওতায় রয়েছে রানীশংকৈল উপজেলার ধর্মগড়, কাশিপুর ইউনিয়ন।

একাধিকবার এমপি হওয়ার কারণে বিশাল বিত্তবৈভবের মালিক বনে গেছেন দবিরুল ইসলাম ও তার পরিবারের লোকজন। মূলত ২০০৮ সালের নির্বাচনের পরই তার আর্থিক উত্থান। নির্বাচনী এলাকা বালিয়াডাঙ্গীতে রয়েছে তার বিশাল টি-এস্টেট। ভারতের সীমান্তবর্তী পাড়িয়া ইউনিয়নের রণবাগ টি-এস্টেটের বিস্তৃতি এক শ’ একরেরও বেশি জমি। যদিও দবিরুল ইসলাম এসব জমির বেশির ভাগ প্রভাব খাটিয়ে সংখ্যালঘুদের কাছ থেকে অল্প টাকায় কিনেছেন বা জোর করে দখল করেছেন বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ রয়েছে। পাড়িয়া ইউনিয়নের কদমতলী গ্রামের কয়েকজন সংখ্যালঘু ও তাদের নেতা জানান, সংখ্যালঘুরা হচ্ছেÑ আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক।

এ জন্য আওয়ামী লীগ মনে করে যে সংখ্যালঘুরা অন্য দলে কখনো ভোট দেবে না, তাই নির্বাচনের আগে ভালো কথা বললেও নির্বাচনের পর অত্যাচার নির্যাতন করে। দবিরুল ইসলামও এমন করেছেন। তার কাছে গিয়ে কান্না করলেও কোনো প্রতিকার মেলেনি। নির্যাতিত হওয়ার কারণে দবিরুল ইসলামের পরিবর্তে সংখ্যালঘুরা তাদের সম্প্রদায়ভুক্ত প্রবীর কুমারকে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা হয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হরিপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, দবিরুল ইসলাম ও তার পরিবারের যন্ত্রণায় মানুষ অতিষ্ঠ। তার বয়স হয়েছে বলে ছেলেকে এবার মনোনয়নের জন্য খাড়া করার চেষ্টা করেছিলেন। সব জায়গায় ছেলের আধিপত্য, মানুষ ভয়ে কথা বলে না।
মাঠে তৎপর জামায়াত : এ দিকে ঠাকুরগাঁও-২ আসনে ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন জামায়াতে ইসলামীর ঠাকুরগাঁও জেলা আমির মাওলানা আব্দুল হাকিম। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দবিরুল ইসলামের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিপুল ভোট পেয়েছিলেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে তাকে ওই নির্বাচনে ‘কারচুপি’র মাধ্যমে পরাজিত করা হয়। নাশকতার মামলায় কারাগারে থাকলেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে আব্দুল হাকিমের পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা ও গণসংযোগে নেমেছেন তার কর্মী-সমর্থক ও অনুসারীরা। তারা কৌশলী প্রচারণা চালাচ্ছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, একাধিকবার দল ও জোট থেকে মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচনে লড়াই করেছেন মাওলানা আব্দুল হাকিম। জয়ের কাছাকাছি গিয়েও তাকে পরাজিত করা হয় কারচুপির মাধ্যমে। তবুও এলাকায় তার জনপ্রিয়তা কমেনি এতটুকুও বরং বিগত নির্বাচনের চেয়ে তার ভোট বেড়েছে বহুগুণ। হামলা-মামলা ও নির্যাতন উপেক্ষা করে তিনি গত প্রায় ৩০ বছর ধরে এলাকাবাসীর মন জয়ের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। যেখানে সরকারি দলের সংসদ সদস্য ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় তটস্থ থাকতে হয় সেখানে দলীয় নেতাকর্মী ছাড়াও এলাকাবাসীর নানা সমস্যায় ছুটে চলেছেন দিনের পর দিন। হরিপুর উপজেলায় কয়েকটি মসজিদ, এতিমখানা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা করেছেন মাওলানা আব্দুল হাকিম। নিজ উপজেলা বালিয়াডাঙ্গীতেও প্রতিষ্ঠা করেছেন বহু প্রতিষ্ঠান। কাঁচা রাস্তায় নিজ খরচে স্থানীয়দের সহযোগিতায় মাটি দেয়ার ব্যবস্থা করেন তিনি। গরিব-মেধাবী শিক্ষার্থী ও এতিমদের বিয়েশাদীতে সহযোগিতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থানে বিশুদ্ধ পানির নলকূপও স্থাপন করেছেন মাওলানা আব্দুল হাকিম। তিনি এমপি না হলেও বিগত চার দলীয় জোট সরকারের আমলে এলাকায় তার ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বহু-ব্রিজ-কালভার্ট নির্মিত হয়। তার এসব জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড এলাকায় ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছে। 

জানা যায়, শুধু তার নির্বাচনী আসনে নয়, পুরো ঠাকুরগাঁও জেলায় একজন সৎ, সদালাপী ও উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত মাওলানা আব্দুল হাকিম। রাজনৈতিক মামলায় বহুদিন কারাবরণ করলেও জামিনে ছাড়াও পান তিনি। সম্প্রতি নাশকতার মামলায় ফের প্রায় এক মাসের বেশি সময় ধরে জেলখানায় বন্দী। তবে তার পক্ষে কৌশলে প্রচারণা অব্যাহত রেখেছেন তার পরিবারের সদস্য, নেতাকর্মী ও শুভাকাক্সক্ষীরা। এই আসনের ভোটার মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগ আমলে এলাকার সাধারণ মানুষ নানাভাবে মামলা-হামলা, জেল-জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হওয়ায় এ আসনে জামায়াতের জনপ্রিয়তা যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি বেলাল উদ্দিন প্রধান বলেন, আমরা নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। এবার ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন হবে। নির্বাচনের প্রচারণা বিভিন্নভাবে অব্যাহত আছে। আশা করি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট হলে আসনটিতে আমরা জয়লাভ করব ইনশা আল্লাহ। পুলিশি হয়রানি, মিথ্যা মামলা, অন্যায়-অবিচার থেকে বাঁচতে হরিপুর-বালিয়াডাঙ্গীর সব ইসলামী ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে এক হয়ে ধানের শীষের পক্ষে প্রচারণা ও মাওলানা আব্দুল হাকিমকে বিজয়ী করার আহ্বান জানান তিনি।


আরো সংবাদ



premium cement