১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

‘কাফনের কাপড় পর্যন্ত লুটে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা’

দুর্বৃত্তরা দুলাল মোল্যার বাড়িতে হামলা চালিয়ে তিনটি ঘর ভাংচুর ও লুটপাট করে - ছবি: নয়া দিগন্ত

নড়াইলের কালিয়া উপজেলার যাদবপুর গ্রামে একটি হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে বাদীপক্ষের ভয়ে বাড়ি-ঘর ছেড়ে একটি পরিবার অসহায় জীবনযাপন করছে। বাদীপক্ষের দুর্বৃত্তরা যাদবপুর গ্রামের দুলাল মোল্যার (৬৫) বাড়িতে হামলা চালিয়ে তিনটি ঘর ভাংচুর ও লুটপাট করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এছাড়া স্বর্ণালংকার, টাকা, পুকুরের মাছ, টিউবওয়েল, জমির ধান, আসবাবপত্র এবং হজের সময় সৌদিআরব থেকে আনা কাফনের কাপড় পর্যন্ত লুট করে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা।

দুলাল মোল্যা অভিযোগ করে বলেন, গ্রামের পান দোকানি সাঈদ ভূঁইয়া (৬০) হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে আমার বাড়িতে দু’দফা হামলা চালিয়ে ব্যাপক ক্ষতি করেছে বাদীপক্ষের লোকজন। আমার পরিবারের কেউ এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত নয়। এমনকি আমরা এ মামলার আসামিও নই। তবুও বাদীপক্ষের অব্যাহত অত্যাচারে বাড়িঘরে থাকতে পারছি না।

তিনি আরো বলেন, গত সাড়ে তিন মাসে দুই বার বাড়িঘরে ভাংচুর ও লুটপাট করেছে। এরই মধ্যে গত ১২ জুলাই বিকেল সোয়া ৫টার দিকে আমার বাড়িতে ভাংচুর করে চিহিৃত দুর্বৃত্তরা। তিনটি ঘরের জানালা, দরজাসহ আসবাবপত্র কুপিয়ে ও ভাংচুর করে সবকিছু তছনছ করে।

দুলাল মোল্লা অভিযোগ করেন, যাবদপুর গ্রামের কিবরিয়া গাজীর নেতৃত্বে হুমাউন শেখ, জুবা শেখ, রমজান শেখ, রাসেল গাজী, জাকির গাজী, হাদিউর সরদার, হাসিকুল সরদার, সেলিম ভূঁইয়া ও মহব্বত ভূঁইয়াসহ বেশ কয়েকজন বাড়িঘরে হামলা চালায়। হত্যার উদ্দেশ্যে আমার ওপর হামলা করতে গেলে দৌঁড়ে পালাই। আমাদের পরিবার আওয়ামী লীগ সমর্থক হলেও দুইবার বাড়িঘর ভাংচুর ও লুটপাট হয়েছে। আর সাঈদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল থেকে আমাদের বাড়ি প্রায় এক কিলোমিটার দুরে হলেও আমাদের ওপর অত্যাচার চলছে।

দুলাল মোল্লার স্ত্রী জানান, দুলাল মোল্যা বাড়িতে এসেছেন এমন খবর শুনে কিবরিয়া গাজীর নেতৃত্বে তার লোকজন গত ১২ জুলাই বিকেলে আমার স্বামীকে খুন করতে যায়। আতচিৎকারে আশেপাশের লোকজন এগিয়ে আসলে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়।

তিনি আরো বলেন, এর আগে আমাদের বাড়ি থেকে চিহিৃত দুর্বৃত্তরা প্রায় আট ভরি স্বর্ণালংকার, প্রায় ৩০ হাজার টাকা, খাটসহ বিভিন্ন আসবাপত্র লুট করে। এমনকি ২০১৪ সালে হজ পালন করে সৌদিআরব থেকে আনা আমাদের দু’জনের (স্বামী-স্ত্রী) কাফনের কাপড় পর্যন্ত লুট করে নিয়ে গেছে তারা।

তিনি জানান, পুকুরের প্রায় ১০ মণ মাছও লুট করেছে। এমনকি টিউবওয়েল পর্যন্ত খুলে নিয়ে গেছে। প্রায় ১৮০ শতক জমির বোরো ধান কেটে নিয়ে গেছে। রোযার ঈদ আমরা বাড়িতে করতে পারিনি। আমাদের পরিবারের ১৩ সদস্য বাড়িঘর ছাড়া। ছেলেরা কর্মস্থল থেকে ছুটি পেলেও বাড়িতে আসতে পারছে না। আমি এবং আমার স্বামী দিনেরবেলা মাঝে-মধ্যে বাড়িতে আসলেও দুর্বৃত্তরা বিভিন্ন ধরণের হুমকি দেয়। আমাদের সামনেই বাড়িঘরে লুটপাট ও ভাংচুর চালায়। ভয়ে কিছু বলতে পারি না। এ ব্যাপারে আমরা প্রশাসনের সহযোগিতা চাই।

প্রতিবেশিরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দুলাল মোল্যার পরিবারের সদস্যরা নিরীহ ও শান্ত প্রকৃতির মানুষ। অথচ বাদীপক্ষের লোকজনের ভয়ে বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। এছাড়াও এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যাদবপুর গ্রামের আরো ৩০টি বাড়িঘর ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে।

এ ব্যাপারে কিবরিয়া গাজীর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। তবে কিবরিয়া গাজীর সমর্থক হাদিউর সরদার বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তা মিথ্যা। দুলাল মোল্যার ওপর দু’টি ছেলে হামলা করতে গেলে আমরা তাদের প্রতিহত করেছি।

কালিয়া থানার ওসি শেখ শমসের আলী বলেন, অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে।

জানা যায়, এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত ৩১ মার্চ যাদবপুর গ্রামের পান দোকানি সাঈদ ভূঁইয়াকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এই গ্রামের কিবরিয়া গাজীর সঙ্গে হেমায়েত মুন্সির দীঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলে আসছে। নিহত সাঈদ ভূঁইয়া কিবরিয়া গাজীর সমর্থক।

 

আরো পড়ুন: ‘শুধু জীবনটা নিয়ে পালিয়ে এসেছি’

সিংড়া (নাটোর) সংবাদদাতা  ২১ জুলাই ২০১৮

সুলতান বাহিনীর ভয়ে কৃষক আনোয়ার ও মামুনের পরিবার গ্রাম ছেড়ে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছে। ছবিটি শুক্রবার বালুয়া বাসুয়া গ্রাম থেকে তোলা - ছবি: নয়া দিগন্ত

নাটোরের সিংড়ায় জমি নিয়ে বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষ বাবা সুলতান বাহিনীর হুমকির কারণে ২৫ দিন ধরে সাতটি পরিবার গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। গত ২৭ জুন সিংড়া উপজেলার দুর্গম রামানন্দ খাজুরিয়া গ্রামের আনোয়ার হোসেন, আমজাদ হোসেন, আনিস, রইস, মামুন, ফারুক হোসেন ও শহিদুল ইসলাম নামে ৭ কৃষকের বাড়ি ঘরে প্রতিপক্ষরা হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও লুটপাট করে।

এর পর প্রতিপক্ষ সুলতান বাহিনীর অব্যাহত প্রাণনাশের হুমকির মুখে নির্যাতিত সাতটি পরিবার গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়। পরবর্তীতে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের নির্দেশে উপজেলা আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ বিষয়টি সালিশ বৈঠকের মাধ্যমে সুরাহা করে দিলেও এখনও নিজ গ্রামে ফিরতে পারেনি পরিবারগুলো।

ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ উপজেলা আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের দেওয়া আশ্বাসের পর নারী সদস্যরা গ্রামে ফিরে গেলে প্রতিপক্ষের লোকজন আবারও বাড়ি-ঘরে হামলা করে এবং নারী সদস্যদের গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয়। ঘটনার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে সুষ্ঠ বিচার দাবি করেছেন তারা।

নির্যাতিত আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী নাজমা বেগম বলেন, এলাকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী এনামুল, বাবা সুলতান ও তার ভাই ফেরদৌস বাহিনী আমার সুখের সংসার ভেঙে তছনছ করেছে। প্রকাশ্যে দিবালোকে তারা বাড়িতে ঢুকে জিনিস পত্র ভাংচুর করেছে। চাল-ডাল, টাকা-পয়সা সব লুটপাট করে নিয়ে গেছে। শুধু জীবনটা নিয়ে পালিয়ে এসেছি। ছেলে-মেয়েদের লেখা-পড়াও বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা কি আর বসত ভিটায় ফিরতে পারব না? কেউ কি নেই আমাদের একটু খবর নেয়ার?

নির্যাতিত কৃষক মামুন ও ফারুক হোসেন বলেন, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান বাবা সুলতান বাহিনীর ভয়ে এলাকার কেউ মুখ খোলে না। আমরা এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছি। তাদের হুমকির মুখে প্রায় একমাস ধরে গ্রামে নিজ বাড়িতে ফিরতে পারছিনা ।

কৃষক আনোয়ার হোসেন, আয়েন উদ্দিন ও আমজাদ হোসেন বলেন, এতো হামলা ও নির্যাতন মেনে নেওয়ার মতো নয়। তারপরও উপজেলা আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দের সালিশি সিদ্ধান্ত আমরা মেনে নিয়েছি। কিন্তু এখনও আমরা বাড়ি ফিরতে পারছি না। এটা খুবই দুঃখজনক।

তবে এইসব অভিযোগকে মিথ্যা ও বানোয়াট বলে দাবী করেছেন বাবা সুলতান ও ফেরদৌসের চাচা জাকির হোসেন। তিনি পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, এলাকায় নানা অপকর্মের সাথে জড়িত থাকায় ওই ৭ পরিবার নিজেরাই দুর্বল। তাই লোক লজ্জার ভয়ে তারা গ্রামে থাকেনা। তাদের গ্রামে আসতে কেউ বাধা দিচ্ছেনা। মনের দুর্বলতা থাকায় তারা নিজেরাই গ্রামে আসছেনা। সালিশ বৈঠকে পক্ষপাতিত্ব হওয়ায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা ও ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ সাধারন সম্পাদক ইদ্রিস আলী বলেন, তারা সালিশ বৈঠকের মাধ্যমে বিরোধ মিমাংসার চেষ্টা করেছেন। সালিশে উভয় পক্ষই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। কিন্তু পরবর্তীতে একটি পক্ষ সালিশে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনে আবারও সালিশ বৈঠকের আবেদন করেছে। কিন্তু ইউপি চেয়ারম্যান দেশের বাহিরে থাকায় সালিশি করা সম্ভব হয়নি। তবে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো এখনও গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র বসবাস করছে বলে জানান তিনি।

উপজেলা আওয়ামীলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নবীর উদ্দিন ভুক্তভোগী পরিবারগুলো গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেওয়ার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, এলাকায় শান্তি শৃংখলা বজার রাখার স্বার্থে সালিশ বৈঠকে বিষয়টি সুরাহ করা হয়। উভয় পক্ষই সহঅবস্থানে বসবাসের অঙ্গিকার করে। কিন্তু এখন এক পক্ষ সালিশ মানছেন না। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আইনগতভাবেই ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে এখনও সমঝোতার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে।

সিংড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) নেয়ামুল আলম বলেন, পরবিারগুলো গ্রামে ফিরতে পারেনি, এ মর্মে পুলিশের কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। অভিযোগ হলে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।


আরো সংবাদ



premium cement