২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

নারী ভোটারদের টানতে তৎপর বুলবুল, লিটনের কৌশলী প্রচারণা

নারী ভোটারদের টানতে তৎপর বুলবুল, লিটনের কৌশলী প্রচারণা - ছবি : সংগৃহীত

রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক) নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থীদের কাছে সর্বাধিক গুরুত্ব পাচ্ছে নারী ভোটারেরা। এ জন্য নারী ভোটারদের মন জয়ে কৌশলী তৎপরতা ও প্রচারণা চলছে। নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত মেয়রপ্রার্থী, সদ্য বিদায়ী মেয়র ও মহানগর বিএনপির সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল এবং আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়রপ্রার্থী, সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন ও তাদের সমর্থকেরা নানা কৌশলে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

২০১৩ সালের ১৫ জুন অনুষ্ঠিত রাসিক নির্বাচনে বুলবুলের পক্ষে নারী ভোটারদের ব্যাপক গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। এবারেও তার ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে না। রাজশাহী সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বুলবুলের পক্ষে নারী ভোটারদের ব্যাপক সাড়া দেখা যাচ্ছে। 
তবে বুলবুলের চেয়ে প্রচারণায় এগিয়ে রয়েছেন আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। গত ১০ জুলাই প্রতীক বরাদ্দের পরপরই শুরু হয়েছে নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা। প্রচারপত্রে একচ্ছত্র আধিপত্য লিটনের। পাড়া-মহল্লা অলিগলি সবখানেই ছেয়ে গেছে নৌকা প্রতীকের পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুনে। কর্মীরা হাতে হ্যান্ডবিল নিয়ে দল বেঁধে নেমেছেন ভোটের প্রচারণায়। নগরীর উন্নয়নে লিটনকে দরকারÑএটিই প্রচার করছেন তারা। 

এ দিকে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই দুই মেয়রপ্রার্থী ও তাদের লোকজন পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগ করা অব্যাহত রেখেছেন। আর এসব অভিযোগ সম্পর্কে নির্বাচন কার্যালয় বলছে, তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। 
২০০৮ ও ২০১৩ সালে রাসিক নির্বাচনেও মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন এ দুই নেতা। তারা একে অপরের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন ও ২০১৩ সালের নির্বাচনে বিএনপির মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে প্রাপ্ত প্রাপ্ত তথ্যানযায়ী, ২০১৩ সালের নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মোট ১৩৭টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ১২৭টিতেই পরাজিত হন আওয়ামী লীগ প্রার্থী লিটন। বাকি যে ৯টি কেন্দ্রে জয়লাভ করেন তিনি সেসব কেন্দ্রে ভোট ব্যবধান সামান্য। নারী ভোটকেন্দ্রগুলোর মধ্যে একমাত্র নগরীর রাজশাহী বিবি হিন্দু একাডেমি কেন্দ্রে জয় পান লিটন। সেখানে তিনি পান ৬২৪ ভোট। আর বুলবুল পান ৫০৭ ভোট। অধিকাংশ নারী কেন্দ্রে লিটনের চেয়ে দ্বিগুণ-তিন গুণেরও বেশি ভোট পান বুলবুল। 

সবচেয়ে বড় ব্যবধানে লিটন পরাজিত হয়েছিলেন নারী ভোটকেন্দ্র ডাঁশমারী উচ্চবিদ্যালয়ে। সেখানে বুলবুল পান দুই হাজার ২৯ ভোট, আর লিটন পান মাত্র ৪৮৩ ভোট। এ ছাড়া নগরীর অন্য নারী ভোটকেন্দ্রগুলোতেও বুলবুলের চেয়ে ভোট কম পান লিটন। 

বিএনপি মনে করছে, গত নির্বাচনে বুলবুলের পক্ষে নারী ভোটারদের যে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ছিল; এবারের নির্বাচনেও তা অব্যাহত থাকবে। দলটির নেতারা বলছেন, গতবারের চেয়ে এবারের নির্বাচনে নারীদের আরো বেশি সক্রিয় তৎপরতা ও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত প্রচারণার সুযোগ পেলে, সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে ও ভোটাররা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারলে বুলবুল আবারো মেয়র নির্বাচিত হবেন বলে আশা করছেন তারা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বিএনপির মহিলা দলের কর্মীরাসহ সাধারণ নারীরাও বুলবুলের পক্ষে ভোটের প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। এতে প্রতিদিন নির্বাচনী প্রচারণায় নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। 

আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানায়, নির্বাচনে নারীদের মন জয়ে আওয়ামী লীগ পৃথকভাবে কাজ করছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে থেকেই এই কার্যক্রম চলছে। এখন প্রতিদিনই নগরীর বিভিন্ন এলাকায় নারীদের নিয়ে উঠানবৈঠক করছেন লিটনপতœী শাহীন আক্তার রেণী। যুব মহিলা লীগ ও ছাত্রলীগের নারী কর্মীরাও ছুটে যাচ্ছেন পাড়া-মহল্লায়। এ ছাড়া কাজ করছেন লিটনের মেয়ে ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি আনিকা ফারিহা জামান অর্ণা। বর্তমান সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নের বিষয়গুলো তুলে ধরে তারা নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে ভোট প্রার্থনা করছেন। 
নির্বাচন কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, রাজশাহী মহানগরীর ৩০টি ওয়ার্ডে মোট ভোটার সংখ্যা তিন লাখ ১৮ হাজার ১৩৮ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার সংখ্যা এক লাখ ৬২ হাজার ৫৩ জন। আর পুরুষ ভোটার সংখ্যা এক লাখ ৫৬ হাজার ৮৫ জন। অর্থাৎ পুরুষ ভোটারের চেয়ে নারী ভোটার সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার বেশি। 

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ২০১৩ সালের ১৫ জুন অনুষ্ঠিত রাসিক নির্বাচনের সপ্তাহখানেক আগে তড়িঘড়ি করে গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়েছিল নগরীর বাসাবাড়িতে। আর দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে আবাসিক গ্যাস সংযোগ। এতে ক্ষুব্ধ নারীরা। যদিও গ্যাস সংযোগ চালু করেও ২০১৩ সালের নির্বাচনে নারী ভোটারদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হন আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। ওই নির্বাচনে বিএনপিপ্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল (আনারস প্রতীক) এক লাখ ৩১ হাজার ৫৮ ভোট পেয়ে প্রথমবারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন। আর আওয়ামী লীগ প্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন (তালা প্রতীক) ৮৩ হাজার ৭২৬ ভোট পেয়ে পরাজিত হন। অর্থাৎ ৪৭ হাজার ৩৩২ ভোটের ব্যবধানে বিএনপি প্রার্থী বুলবুলের কাছে পরাজিত হন আওয়ামী লীগ প্রার্থী লিটন। 

ওই নির্বাচন সামনে রেখে নারী ভোটারদের মন জয় করতে দলের সংরক্ষিত নারী এমপি ও কণ্ঠশিল্পী মমতাজকে মাঠে নামিয়েছিলেন মেয়রপ্রার্থী লিটন। দলের নারী কর্মীদের নিয়ে জোর প্রচারণায় ছিলেন লিটনপতœী শাহীন আক্তার রেনীও। তবে তার সেই কৌশলও শেষ পর্যন্ত কাজে লাগেনি। ফলে ঠেকাতে পারেনি হার। 

জানা গেছে, নির্বাচিত হওয়ার পর বুলবুল মেয়রের দায়িত্ব নেয়ার প্রথম দুই বছর মহানগরীতে আবাসিকে গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়। যদিও পুরো পাঁচ বছর মেয়াদের মাত্র ২৬ মাস দায়িত্ব পালনের সুযোগ পান বুলবুল। 
নগরীজুড়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকেরা। তাদের বিভিন্ন ধরনের প্রচারণায় স্থান পেয়েছে গ্যাসের বিষয়টিও। তারা স্লোগান দিচ্ছেন, ‘গ্যাস এনেছে লিটন ভাই, মা-বোনদের সমর্থন চাই।’Ñ এ ধরনের স্লোগান দিয়ে প্রচারণা চালিয়ে নারী ভোটারদের মন জয়ে কাজ করছেন তারা। 

আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী লিটনের প্রচারণায় এবার প্রাধান্য পাচ্ছে নগরীর উন্নয়ন। তিনি সদ্যবিদায়ী মেয়রের ব্যর্থতা ও অযোগ্যতাকে ফলাও করে প্রচার করছেন। পাশাপাশি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সকারের উন্নয়ন ধারাবাহিকতাও তুলে ধরছেন লিটন। লিটন বলছেন, আমি রাজশাহীকে মেগা সিটি হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। নগরীতে গ্যাস সংযোগের মাধ্যমে শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ সার্বিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন করতে চাই। এ জন্য আমি কাজ করার সুযোগ চাই। আপনারা ভোট দিয়ে আমাকে নির্বাচিত করুন। নগরীর সব উন্নয়ন আমার কাছে থেকে বুঝে নেবেন। 
আর বিএনপি মেয়রপ্রার্থী ও সদ্যবিদায়ী মেয়র বুলবুলের প্রচারণায় গুরুত্ব পাচ্ছে পাঁচ বছর মেয়াদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি সময় তাকে করপোরেশনে বসতে না দেয়া। প্রচারণায় এ ইস্যুটি নিয়ে ভোটারদের সহানুভূতি ও মন গলানোর চেষ্টা করছেন তিনি। একই সাথে উন্নয়ন ধারাবাহিকতা রক্ষায় অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার সুযোগও চান বুলবুল। এ ছাড়া বুলবুলের প্রচারণায় বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের ওপর সরকারের চলমান দমন-পীড়নের মতো জাতীয় রাজনৈতিক ইস্যুও প্রাধান্য পাচ্ছে। 

মেয়রপ্রার্থী বুলবুল অভিযোগ করে বলেন, সরকারদলীয় মেয়রপ্রার্থীর লোকজন বিভিন্ন ওয়ার্ডে আমার পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন ছিঁড়ে ফেলছে এবং নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর করছে। সেই সাথে বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়িতে হামলা ও তাদের অযাচিতভাবে গ্রেফতার করছে। এ ছাড়া নির্বাচনী প্রচারণাকালে নেতাকর্মীদের বাধা প্রদান ও নারী কর্মীদের অসম্মানজনকভাবে কথা বলছে। এ নিয়ে বারবার নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না। 

আর মেয়রপ্রার্থী লিটনের নির্বাচনী আইন সহায়তা উপ-কমিটির সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট মুসাব্বিরুল ইসলাম অভিযোগ করেন, বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকের লোকজন ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করছেন। এ ছাড়া তারা উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান, প্রচারপত্র ছিঁড়ে ফেলা ও অপপ্রচার চালাচ্ছেন।


আরো সংবাদ



premium cement