২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ঈদ তাই স্বপনের বাড়িতে তাদের ভিড় 

ঈদ তাই স্বপনের বাড়িতে তাদের ভিড়  - ছবি : সংগৃহীত

জাহিদুল হাসান স্বপন। বয়স এখনও চল্লিশের কোঠা পেরোয়নি। কিন্তু বয়সকে ছাপিয়ে নিজেকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। অবশ্য সে উচ্চতা মাপার মাপকাঠি কেবলই মানবিকতা আর সামাজিকতা। সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার চরাঞ্চলের ৬টি ইউনিয়নের সহ¯্রাধীক প্রতিবন্ধীদের পরম বন্ধু জাহিদুল হাসান স্বপন। প্রায় দশ-বারো বছর পূর্বে থেকেই স্বপনের স্বপ্নে বাসা বাধে প্রতিবন্ধীদের যাপিত জীবনের দুঃখ-গাঁথা। চোখের সামনে তার স্বজন এক প্রতিবন্ধীকে বিনা চিকিৎসায় মরে যেতে দেখেছেন। তখন সে হাইস্কুলের গন্ডি পেরোয়নি। কিন্তু মনের মধ্যে গেঁথে যায় প্রতিবন্ধী স্বজনের বিয়োগ-ব্যথা। তখন থেকেই নিজেকে সঁপে দেন প্রতিবন্ধীদের কল্যাণ কাজে। নিজে টিফিনের টাকা জমিয়ে দুস্থ এক প্রতিবন্ধীকে প্রথম একটি টি শাট কিনে দেন কোন এক ঈদে। টি শাটটি পরে যখন আনন্দ প্রকাশ করছিল ওই প্রতিবন্ধী ছেলেটি তখন কি যে আনন্দ পেয়েছিলাম সেটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না জানান স্বপন। সেই থেকে শুরু। নিজেকে তিনি প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে পুরোপুরি নিয়োজিত করেন। লেখাপড়া শেষ করে কোন চাকরি নেননি এই যুবক। গতবছর গড়ে তুলেছেন ‘যমুনা প্রতিবন্ধী কল্যাণ সংস্থা’ নামের একটি বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।


স্বপন জানান, চরাঞ্চলের নিবন্ধিত প্রতিবন্ধীদের জন্যে তিনি বাবার সামান্য জমিটুকুও বিদালয়ের নামে উইল করে একটি প্রতিষ্ঠান গড়তে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আর এসব করতে গিয়ে এখন নিজের সংসারের মায়াজালে কাউকে জীবন সঙ্গী করে নিতে পারেননি। গত বছর তার বাবা মারা যাওয়ায় নিজেই অসহায় হয়ে পড়েছেন তিনি। তারপরেও প্রতিন্ধীদের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন।


স্বপন জানান, যখনই ঈদ আসে তখনই ওরা (প্রতিবন্ধীরা) বাবা-মা সহ আমার বাড়িতে আগে থেকেই খোঁজ খবর নিতে শুরু করে। আমি নিজের সামান্য উপার্জন আর সমাজের বিত্তবানদের নিকট হাত পেতে সংগ্রহ করা অর্থে ওদের জন্যে কিছু করি। ঈদে ওরা যে লাচ্চা-সেমাই খায় আমিও একসাথে বসে তাই খাই। কিন্তু খুবই কষ্ট হয় যখন সবাইকে দিতে পারিনা। সব সময়তো আর কেউ সহায়তা করে না ।
স্বপনের এই ভালো কাজের জন্যে অনেক বিড়ম্বনাও পোহাতে হয়। শুনতে হয় নানা কটুকথা। কেউ কেউ এক টাকা সহায়তা না দিয়েও স্বপনের নামে নানা কুৎসা রটায়। কিন্তু এসব এখন গা সওয়া হয়ে গেছে বলে জানিয়ে স্বপন বলেন, কে কি বললো সেটা নিয়ে আর ভাবি না। যখন ওদের মুখের একটু হাসি দেখি তখনই সব ভুলে যাই। গত কয়েক বছর যাবৎ স্বপন ঈদ এলেই লাচ্চা. সেমাই, চিনি, গুড়, চাল, ডাল, লবণ, কাপড়-চোপর এসব প্রতিবন্ধীদের মাঝে বিতরণ করেন। মাঝে মধ্যে উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান, সমাজের বিত্তবানগণ তার হাতে কিছু অর্থ সহায়তা দেন। সেইসাথে নিজের সাধ্যমতো অর্থ যোগ করে বিভিন্ন সময় প্রতিবন্ধীদের মাঝে খাবার ছাড়াও সেলাই মেশিন, টিউবওয়েল, হুইল চেয়ার বিতরণ করেন।


হ্যামেলিওনের বাশিঁওয়ালা এই জাহিদুল হাসান স্বপন। সম্প্রতি এই প্রতিবেদক সরেজমিন স্বপনের রেহাইশুড়িবেড় চরে যমুনা প্রতিবন্ধী কল্যাণ সংস্থার কার্যালয়ে গেলে সমবেত শ‘ পাঁচেক প্রতিবন্ধী স্বপনের ঈশারায় দাঁড়িয়ে ওদের মতো করে হাত নেড়ে সালাম জানায়। এসময় অনেক শিশু প্রতিবন্ধী ওদের বাবা মায়ের কোল থেকে নেমে স্বপনের কাছে চলে আসে। ওদের অনেকের মুখ থেকে তখনও অনবরত লালা গড়িয়ে পড়ছে, অনেকের গা থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে কিন্তু তাতে কী। নিদ্বিধায় স্বপন ওদের কাছে ডেকে কোলে নিয়ে আদর করছে। এমন দৃশ্য চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না।


বাবা মারা যাওয়ায় আসছে ঈদে স্বপনের চিন্তা আরও বেড়ে গেছে। ঈদের কয়েক দিন আগে থেকে স্বপনের বাড়িতে প্রতিবন্ধীরা এসে ভিড় করবে। তাদের আশা ঈদের জামা, লাচ্চা, সেমাই এখন থেকেই তারা পাবে। কিন্তু এবছর স্বপনের কাছে নেই সেই পরিমাণ অর্থ। বাধ্য হয়ে তিনি বিত্তবানদের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি বলেন, সমাজের যাকাতের অনেক অর্থই অনেকে নানা সংস্থায় দিয়ে থাকেন। একবার করে অন্তত এই প্রতিবন্ধীদের জন্যে কেউ যদি কিছু সহায়তা করতো তাহলে ওরা ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারতো। কথা হয় দশ বছরের রেশমা নামের দৃষ্টি প্রতিবন্ধীর বাবার সাথে। রেশমাকে কোলে নিয়ে তিনি এসেছেন স্বপনের নিকট ঈদে সাহায্য পাবার আগাম দাবিটি জানান দিতে। পেশায় দিনমজুর শেরআলী জানান, আমাগোরে রিদের (ঈদের) বাজার হেই (স্বপন) দ্যায়। এবার আছি কয়া (বলে) গেলাম। বসুন্ধরা গ্রুপের এজিএম এস্টেট আমিনুল ইসলাম, এ্যাডভোকেট মোকাদ্দেস আলী, নাজমুল হাসান রানা, ইঞ্জিনিয়ার সাখাওয়াত হোসেন শুরু থেকেই স্বপনের এই পথচলায় সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। কাজিপুর উপজেলা চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক বকুর সরকার জানান, ছেলেটি সমাজের অসহায় প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করছে। এটি নিঃসন্দেহে ভাল কাজ। তেকানী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হারুন আর রশিদ জানান, আমি স্বপনের ডাকে মাঝে মধ্যে যাই। দেখি প্রতিবন্ধীরা ওকে কিভাবে ঘিরে ধরে আনন্দ প্রকাশ করে। তাই পরিষদের পক্ষ থেকে সামান্য সহায়তা করার চেষ্টা করি।

আসন্ন ঈদে প্রতিবন্ধীদের যেন অন্তত একবেলা দুমুঠো ভালো খাবার দেয়া যায় এটিই স্বপনের চাওয়া। আর সহ¯্রাধীক প্রতিবন্ধীর মুখের হাসি ফোটাতে সমাজের বিত্তবানগণ এবার নজর দেবেন এটাই তার চাওয়া।


আরো সংবাদ



premium cement