১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অনলাইন নিরাপত্তা ও প্রাইভেসি নিয়ে কতটুকু সচেতন আপনি?

-

সকালে ঘুম থেকে উঠে পার্কে হাঁটতে গেছেন, এমন সময় হঠাৎ কারো সঙ্গে আপনার আলাপ-পরিচয় হলো। তাকে আপনি প্রথম দিনই বাসায় নিয়ে এলেন। তার সঙ্গে গল্পের ফাঁকে আপনার জীবনের ব্যক্তিগত গল্প শোনালেন। সারা ঘর ঘুরে ঘুরে দেখালেন, আপনার বেডরুম, ডাইনিং ও কিচেন দেখতে কেমন! এরপর আলমারি থেকে ফ্যামিলি ফটো অ্যালবামটা নামিয়ে পারিবারিক ছবি দেখালেন।
শুনে হয়তো একটু অবাকই লাগছে। প্রথম দেখায় একটা মানুষকে এত আপন করে নেয়া কিভাবে সম্ভব! অনেকেই আমার সাথে হয়তো একমত হবেন। বাস্তব জীবনে এমনটি না ঘটলেও আমরা প্রতিনিয়তই অনলাইন দুনিয়ায় অপরিচিত বন্ধুর সাথে এমন আচরণই করছি। শুধু অনলাইনে ঘটছে বলে ব্যাপারটির গুরুত্ব ও তির মাত্রা অনেকেই অনুধাবন করতে পারছেন না।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, টুইটার বা উইচ্যাটে আপনার বন্ধুর তালিকায় এমন কেউ কি আছেন, যাকে আপনি আসলেই চেনেন না? কিংবা নিজের চোখে যাকে কখনো দেখেননি? বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই সহজ উত্তরÑ অনলাইনে সবাইকে চেনার কী প্রয়োজন। আছে, প্রয়োজন আছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপনি কি কোনো ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করছেন, যা শেয়ার করার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই, যেমন ই-মেইল (ব্যক্তিগত), টেলিফোন নম্বর, ঠিকানা, পেশা ইত্যাদি। এসব প্রশ্নের উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয়, তাহলে ওপরের পরিস্থিতির উত্তরও আপনার েেত্র ‘হ্যাঁ’ হওয়া উচিত, যা স্বভাবতই আপনার কাম্য নয়। এভাবে প্রতিনিয়তই আমরা সামাজিক যোগাযোগ রার নামে অনলাইনে নিজেদের প্রাইভেসি ধ্বংস করে চলেছি? সম্ভবত এর কারণ হলো, বাস্তব জীবনে আপনি যতটা সচেতন, অনলাইনে আপনি সচেতন থাকেন না। ইন্টারনেট আপনার কাছে কল্পনার ফানুসের মতো। এই আছে, এই নেই। রাস্তায় চলার পথে অপরিচিত কাউকে বন্ধু না বানালেও অনলাইনে বোতাম টিপে বন্ধু বানাতে আপনার আপত্তি নেই। আবার কেউ যদি আপনার নামধাম-পরিচয় জিজ্ঞেস করে, আপনি একটু বিরক্ত হলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেই এসব অকাতরে শেয়ার করছেন। অপরিচিত কাউকে ঘরে এনে মা-বাবা-স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে আপনার আপত্তি থাকলেও, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঠিকই পরিবারের সবার ছবি পাবলিকলি আপলোড করতে আপনার আপত্তি নেই। এমনকি অনেককে দেখছি তার জাতীয় পরিচয়পত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ এমনকি পাসপোর্টের মতো ডকুমেন্টও অনায়াসে শেয়ার করছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
মাজেদুল হক, কাজ করছেন ঢাকার একটি বেসরকারি ব্যাংকে। তিনি অনলাইন মাধ্যমের একজন সচেতন ব্যবহারকারী। তার ফেসবুকেও ব্যক্তিগত তেমন কোনো তথ্য দেয়া নেই। তুলনামূলক তার ফেসবুকের পাসওয়ার্ডটিও কঠিন। তার মতে, তার অ্যাকাউন্ট হ্যাক করা সহজ ব্যাপার নয়। মাজেদুল দীর্ঘ দিন ধরে ড্রাইভিং লাইসেন্স করার জন্য ঘুরে অবশেষে হাতে পেলেন কাক্সিক্ষত লাইসেন্স। হাতে পাওয়ার ৩০ মিনিটের মধ্যেই ছবি তুলে পোস্ট দিলেন ফেসবুকে। আবেগে দেয়া এই পোস্ট তার জীবনে খতির কারণ হয়ে দাঁড়াল। কারণ, তার ড্রাইভিং লাইসেন্সের তথ্য নিয়ে হ্যাকাররা তার ফেসবুক হ্যাক করল ওইদিন রাতেই। কারণ খুব সহজ। মাজেদুল তার ফেসবুকের পাসওয়ার্ড দিয়েছিলেন নিজের নামের প্রথম অক্ষর আর জন্মসাল। এ তথ্য ড্রাইভিং লাইসেন্সের ছবিতে স্পষ্টই ছিল।
এর পেছনে কারণ হলো, আপনি এখনো সাইবার ক্রাইমের শিকার হননি। সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক অবয় বা অন্য যেকোনো কারণে ব্যক্তিগত লেভেলে সাইবার ক্রাইমের কিছু ঘটনা ঘটছে। যেমনÑ কারো ব্যক্তিগত ছবি বা তথ্য নোংরাভাবে উপস্থাপন করে ব্ল্যাকমেইল করার মতো ঘটনা পত্রিকায় মাঝে মধ্যেই দেখছি। এসব তথ্য বা ছবি সাধারণত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে নেয়া, যা অপরাধীদের জন্য খুঁজে পাওয়া অনেক সহজ। কারণ, আপনি নিজেই অপরাধীদের কাজ সহজ করে দিয়েছেন।
দুঃখজনক ব্যাপার হলো, অনলাইন সুবিধা ব্যবহারকারীরা শিতি হয়েও প্রাইভেসির ব্যাপার বেশ হালকাভাবেই দেখেন। আবার অনেকে ব্যাপারটা তেমন ভালো জানেন না। তারা হয়তো জানেনই না, মোবাইল দিয়ে তোলা একটা ফটো ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, গুগল ইত্যাদি কত কত জায়গায় না চলে যাচ্ছে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর প্রত্যেকের নিজস্ব কাউড সার্ভার রয়েছে, যা আপনার ছবিটা আলাদাভাবে জমা করছে, যাকে বলা হয় ডেটা ফ্রেগমেন্টেশন।
‘আপনি কতটা উন্মাদ’, ‘আপনি দেখতে কোন বলিউড অভিনেতার মতো’ কিংবা ‘কোন বন্ধু আপনাকে গোপনে ভালোবাসে’ এমন সব মজার বা অদ্ভুত প্রশ্নের উত্তর জানার অ্যাপ ফেসবুকে প্রায় সবাই দেখেছেন। জনপ্রিয় এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অহরহই এমন অ্যাপের পোস্ট দেখা যায়। সেখানে ঢুকে প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে চাইলে অ্যাপগুলো আপনার প্রোফাইল ঢোকার অনুমতি চায়। আপনিও সরল মনে সেই অনুমতি দিয়ে দেন ‘অ্যালাউ’ বোতাম চেপে। এরপর সেই অ্যাপগুলো আপনার প্রোফাইল বিশ্লেষণ করতে থাকে। পেয়ে যায় আপনার ব্যক্তিগত নানা তথ্য।
অ্যাপগুলো ফেসবুক ব্যবহারকারীর নাম, প্রোফাইল ছবি, ইমেইল ঠিকানা ইত্যাদি পায়। তবে কোনো কোনো অ্যাপ ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত বার্তার তথ্যও নিয়ে থাকে। আর তথ্যগুলো নিজের অজান্তেই দিয়ে থাকেন ব্যবহারকারী। বিপত্তিটা তাৎণিকভাবে বোঝা না গেলেও পরে এসব তথ্য বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে থাকে সেই অ্যাপগুলোর নির্মাতা।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে শুধু কারো নাম জানা থাকলেই তার ব্যক্তিগত সব তথ্য জেনে নেয়া যাচ্ছে। আপনার বিভিন্ন সময় তোলা ছবি, ভিডিও, স্ট্যাটাস, কমেন্ট ইত্যাদি পড়ে খুব সহজেই আপনার নামধাম-পেশা, পছন্দ-অপছন্দ, শখ, পারিবারিক সম্পর্ক ইত্যাদি জেনে নিতে পারছে। অবাক হওয়ার কিছু নেই। আপনি নিজেই এটা পরীা করতে পারেন আপনার নিজের ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টুইটার ইত্যাদি চেক করে। এসব মাধ্যমের অনেকের সঙ্গেই আছে থার্ড পার্টি অ্যাগ্রিমেন্ট, যার কারণে আপনার তথ্য ব্যবসায়িক কারণে অন্য কোনো কোম্পানি কর্তৃক ব্যবহৃত হচ্ছে আপনার অজান্তেই। আর এর আইনি বৈধতাও আপনি দিয়েছেন শুধু ‘আই অ্যাগ্রি’ লেখা কোনার ছোট্ট বক্সটাতে কিক করে। আপনি চাইলেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওয়েবপেজের সেটিংসে গিয়ে এসব অব্যবহৃত অ্যাপ রিমুভ করে দিতে পারেন।
অনলাইন মিডিয়ার ক্রাইমগুলো বেশির ভাগেরই কারণ ভিকটিমের অসচেতনতা। ইদানীং মোবাইল ফোন মানেই ছবির বন্যা। শুধু যে সেলফি, তা নয়। বন্ধুদের আড্ডায় হয়তো স্বল্পপরিচিত কেউ আপনার গ্রুপ ছবি উঠিয়ে নিলো। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গেই ফেসবুকসহ নানা জায়গায় চলে গেল সম্পূর্ণ আপনার অজান্তে। তাই ছবি তোলার েেত্র সচেতন হোন। অপরিচিত কারো ছবি তুলতে চাইলে অনুমতি অবশ্যই নিতে হবে, এই ভদ্রতাজ্ঞানটুকু অনেকেরই নেই। আর নিজে কোনো ছবি আপলোড করতে চাইলে প্রাইভেসি সেটিংস ভালোভাবে চেক করে নিন। সাধারণত হাই-কোয়ালিটির ছবি এডিটিং করা সহজ। তাই ছবির রেজুলেশন কমিয়ে পোস্ট করতে পারেন। ছবির কোয়ালিটি কমানোর জন্য বিভিন্ন সফটওয়্যার পাওয়া যায়, যা ব্যবহার করতে পারেন। এসব ছবি বিকৃত করা কঠিন বা করলেও তা সহজেই বোঝা যায়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, অপ্রয়োজনে শুধু ফান মনে করে যত্রতত্র ছবিসহ তথ্য আপলোডে সতর্কতা জরুরি। মনে রাখা উচিত, ইন্টারনেট আমাদের প্রাত্যহিক জীবন সহজ করলেও ব্যক্তিগত জীবনে অনেক দুর্ঘটনারও জন্ম দিতে পারে। তাই আগেই সচেতন হওয়া জরুরি।


আরো সংবাদ



premium cement