২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইভিএম : নির্বাচনী বিতর্কের বিরাট উপাদান

বহমান এই সময়ে
-

বিশ্বের নানা অঞ্চলের নানা দেশে ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) নিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এক দিকে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বেশ কিছু দেশ নিজেদের দূরে রেখেছে ইভিএম ব্যবস্থা থেকে, অন্য দিকে দক্ষিণ আফ্রিকা ও এশিয়ার অল্প কিছু দেশ ইভিএমের প্রশ্নে আগ্রহ প্রদর্শন করছে। একটি সমীক্ষা মতে, বিশ্বের ৩১টি দেশ ইভিএম ব্যবহার করেছে বা করছে পুরোপুরি বা আংশিকভাবে; কিংবা এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে বা চালাচ্ছে। মাত্র চারটি রাষ্ট্র তাদের সারা দেশে ইভিএম ব্যবস্থা চালু করেছে, ১১টি দেশ আংশিকভাবে অথবা ছোট ছোট নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করছে, পাঁচটি দেশ তা ব্যবহার করছে পাইলট প্রকল্প হিসেব, তিনটি দেশ তা চালু করে পরে বন্ধ করে দিয়েছে। আর ১১টি দেশে ইভিএম পাইলট প্রকল্প হিসেবে চালু করে, পরে তা বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দেখা যাচ্ছে, এই ৩১টি দেশেও ইভিএম ব্যবস্থা পুরোপুরি চালু করা হয়নি। বিশ্বে বর্তমানে ১৯৫টি দেশ রয়েছে। এর মধ্যে দু’টি ছাড়া বাকি ১৯৩টি জাতিসঙ্ঘের সদস্য। উল্লিখিত দু’টি হচ্ছে জাতিসঙ্ঘের স্বীকৃত পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র : ফিলিস্তিন ও হোলি সি (Holy See)। ‘হোলি সি’ বা ‘সি অব রোম’ নামে পরিচিত পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রটি বিশপ অব রোমের অধীন। আমাদের কাছে ‘বিশপ অব রোম’ সমধিক পরিচিত ‘পোপ’ নামে।
এই ৩১টি দেশের কথা বাদ দিলে দেখা যায় বিশ্বের বাকি ১৬৪টি দেশ নিজেদের দূরে রেখেছে ইভিএম ব্যবহার থেকে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, তথ্যপ্রযুক্তির যুগে কেনো এই বিপুলসংখ্যক দেশ ইভিএম ব্যবস্থা চালু করেনি? আর এর স্বাভাবিক উত্তরটি হচ্ছে, এসব দেশ বাস্তবতাদৃষ্টে মনে করে ইভিএম কোনো নিরাপদ ব্যবস্থা নয়। তারা দেখেছেন, যেসব দেশ এই ব্যবস্থা চালু করেছে, সেখানেই নির্বাচনকে বিতর্কিত করে তুলেছে ইভিএম। এই ব্যবস্থায় নির্বাচনের নিরাপত্তা নিয়ে বড় ধরনের সংশয় থেকেই এসব দেশ ইভিএম ব্যবস্থার দিকে এগোয়নি। ইভিএমের নিরাপত্তা, যথার্থতা ও নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক উঠেছে বিশ্বব্যাপী। অনেক উন্নয়নশীল দেশই ইভিএম প্রযুক্তির ওপর আস্থা রাখে না। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডসÑ এমনকি যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক উন্নত দেশও ইভিএম ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ‘হাতি ঘোড়া গেল তল, গাধা বলে কত জল’-এর মতো পরিস্থিতিতে আমাদের নির্বাচন কমিশন ধনুক ভাঙা পণ করে বসে আছে বিতর্কিত এই ইভিএম ব্যবস্থা দেশে চালু করে ছাড়বেই। আপাতত আসন্ন ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন এই ব্যবস্থায় সম্পন্ন করবে বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নির্বাচন কমিশন। এর আগে কিছু স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনেও সরকারবিরোধী শিবিরের রাজনৈতিক দল-জোট এবং সুশীল সমাজের প্রবল প্রতিবাদের মুখে একমাত্র সরকার পক্ষের চাওয়া-পাওয়ার ওপর নির্ভর করে আংশিকভাবে এই ইভিএম ব্যবহার করতে দেখা গেছে আমাদের নির্বাচন কমিশনকে। তবে সে অভিজ্ঞতা যে সুখপ্রদ ছিল না, তা নির্বাচনকালীন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে প্রতিফলিত রয়েছে। সে অভিজ্ঞতার ওপর দাঁড়িয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশনের আসন্ন নির্বাচনেও ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা এসেছে সরকারের বাইরে থাকা দল, জোট ও বিভিন্ন মহল থেকে। বিরোধিতা এসেছে দল-নিরপেক্ষ সুশীলসমাজ থেকেও। তাদের আশঙ্কা দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল প্রভাবিত করার নতুন কৌশল। জনমত উপেক্ষা করে একমাত্র সরকারের ইচ্ছা পূরণের অংশ হিসেবে নির্বাচন কমিশন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করতে যাচ্ছে।
কমিশন এই বিতর্কটির সূচনা করেছে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চার মাস আগে। এই বিতর্কটি ছিল ওই নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে। তখন নির্বাচন কমিশন আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব করেছিল, বিশেষত নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টির জন্য। ২০১৮ সালে আগস্টে নেয়া, ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে একজন নির্বাচন কমিশনার কমিশনের বৈঠকে ওয়াকআউট পর্যন্ত করেছিলেন। অথচ সে বছর জুলাই পর্যন্ত কমিশন বলে আসছিল জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আরপিওর কোনো সংশোধন হবে না। নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালউদ্দিন আহমেদ সে বছর ১৪ জুলাই সাংবাদিকদের জানান, ‘আগে একটা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল আরপিও সংশোধনের, কিন্তু এখন আর তা করা হবে না।’ এরপর নির্বাচন কমিশনও সাংবাদিকদের ইঙ্গিত দেন, ২০১৮ সালের ৭ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের যে অধিবেশন বসছে, সেখানেও আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব তোলার কোনো সম্ভাবনা নেই।’ ফলে ধরেই নেয়া হয়েছিল সংসদ নির্বাচনের আগে আরপিও সংশোধন করা হবে না। সেই সূত্রে সংসদ নির্বাচনে ইভিএমও ব্যবহার করা হবে না। এর পরও আগস্টের শেষ দিকে হঠাৎ করে রহস্যজনকভাবে নির্বাচন কমিশন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম চালুর লক্ষ্যে আরপিও সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেয়। কমিশনের ভেতরেও এ নিয়ে মতদ্বৈধতার মধ্যেই কমিশন এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে। তখনই সমালোচনা করা হয় যে, সরকারের ইচ্ছা পূরণের অংশ হিসেবেই কমিশন এই বিতর্কিত কাজটি সম্পাদন করেছে। সেই থেকে ইভিএম নিয়ে বিতর্ক চলছে। এবার সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে তা নতুন করে আলোচনা-সমালোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে।
ইভিএমের নেতিবাচক দিকগুলোর কথা বিবেচনা করেই কিন্তু অনেক দেশে এই ইভিএম নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। ২০০৬ সালের অক্টোবরে নেদারল্যান্ডস ইভিএম ব্যবহার নিষিদ্ধ করে ইভিএমে ভোটদানে স্বচ্ছতার অভাবের কথা উল্লেখ করে। একই বছরে ইতালির পর আয়ারল্যান্ডও ইভিএম নিষিদ্ধ করেছে স্বচ্ছতার অভাবের কারণ দেখিয়ে। ২০০৯ সালের মার্চে জার্মানির সুপ্রিম কোর্ট রুল জারি করে বলেন, ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠান অসাংবিধানিক। সে আদালত মনে করেন, নির্বাচনে স্বচ্ছতা বিধান জনগণের সাংবিধানিক অধিকার। ইংল্যান্ড ইভিএম নিষিদ্ধ না করলেও মডেমের পরিবর্তে প্রচলিত কাগুজে ব্যালটে ভোট দেয়াকেই বেছে নেয়। ফ্রান্সও ইভিএম নিষিদ্ধ না করলেও ইভিএমের পরিবর্তে বেছে নেয় ইন্টারনেট ভোটিং ব্যবস্থাকে। ইতালি ইভিএমের একটি পাইলট প্রকল্প চালিয়েও নিজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আবার কাগজের ব্যালট পেপার ব্যবস্থায় ফিরে যায়। যুক্তরাষ্ট্রে পেপার ট্রায়াল ছাড়া ইভিএম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ভেনিজুয়েলাও যুক্তরাষ্ট্রের মতোই ব্যবস্থা নিয়েছে।
একটি বড় প্রশ্ন হচ্ছে, আমেরিকার মতো সম্পদে এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকা, একটি দেশ কেনো আজো কাগজের ব্যালটের নির্বাচনী ব্যবস্থা ধরে রেখেছে? কেনো আজ পর্যন্ত ইভিএম সে দেশে চালু করা হয়নি? তা অবশ্যই ভেবে দেখার বিষয়। এমন রিপোর্টও রয়েছে যে, অধিকতর নিরাপদ নির্বাচনেই স্বস্তিবোধ করে আমেরিকানরা। কোনো বিতর্কিত নির্বাচনী ব্যবস্থা তারা চায় না। টাইম ম্যাগাজিনের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘ইউএস ইলেকশন অ্যাসিস্ট্যান্স কমিশন’-এর চেয়ারম্যান বলেছেন, দেশটি ইভিএম ব্যবস্থায় না যাওয়ার প্রাথমিক কারণ হচ্ছে : security and voter preference। এর সরল অর্থ, নিরাপদ নির্বাচন নিশ্চিত করা এবং ভোটারের মতামতকে অগ্রাধিকার দেয়াটাই হচ্ছে ইভিএম ব্যবস্থায় না যাওয়ার প্রাথমিক কারণ। এর বিপরীতে আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশনের যেন কাজই হচ্ছে নতুন নতুন বিতর্ক সামনে এনে গোটা নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বিতর্কিত করে তোলা এবং জনগণের মতামতকে প্রাধান্য না দিয়ে সরকারের ইচ্ছাই পূরণ করা, হোক সেটি যৌক্তিক কিংবা অযৌক্তিক। আমাদের জনগণের বিপদটা এখানেই।
টাইম ম্যাগাজিনের উল্লিখিত রিপোর্টে আরো বলা হয়, খরচের কারণেও ই-ভোটিংয়ের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয়া হয় না। কারণ, এর জন্য প্রয়োজন হয় নতুন ই-ভোটিং মেশিন ও আপগ্রেডিংয়ের, যা যুক্তরাষ্ট্রের বাজেটে নিষিদ্ধ। তা ছাড়া রাজনীতিবিদরাও চান কাগজের ব্যালট। কারণ, দশকের পর দশক ধরে এর মডেল এমন করা হয়েছে, যা ভোট প্রদান ও বিশ্লেষণের জন্য অধিকতর উপযোগী। কাগজে ছাপা ব্যালট আমেরিকান বিপ্লবী যুদ্ধের পর থেকে চলে আসছে একটি ‘ঐতিহ্যবাহী ফ্যাশন’ হিসেবে। ১৮৮৪ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর থেকে সেখানকার মানুষ গোপন ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দিয়ে আসছে।
ইভিএম মেশিনে ভোটদান নিরাপদ নয় জেনেই বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ এ থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখেছে। এ কথাটি আমাদের নির্বাচন কমিশনও ভালো করে জানে। নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম গণমাধ্যমে দেয়া, সাম্প্রতিক বক্তব্যে স্বীকার করেছেন, ইভিএমেও পড়তে পারে জালভোট; যদিও নির্বাচন কমিশন বারবার বলছে, গোপন কক্ষে থাকবে ইভিএম। সে কক্ষে ভোটার ছাড়া অন্যদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ। কিন্তু ইভিএমে অনুষ্ঠিত বিগত কয়েকটি নির্বাচনে বুথ দখল করে জাল ভোট দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এ অবস্থায় ভোটকেন্দ্রে সর্বোচ্চ নিরাপত্তার ওপর জোর দিচ্ছে নির্বাচন কমিশন বা ইসি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কমিশনার মো: রফিকুল ইসলাম বলেন, বুথ দখল করে ইভিএমে জাল ভোট দেয়া সম্ভব। তবে তিনি বলেন, ভোট কেন্দ্রের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে, যাতে দুষ্কৃতকারীরা কেন্দ্র বা বুথ দখল করে জাল ভোট দিতে না পারে। কেন্দ্র্র ও বুথ দখলকারীদের সাথে সাথে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে সোপর্দের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
ব্যালটের চেয়ে ইভিএমের খরচ ‘একটু বেশি’ হলেও নির্বাচনী অনিয়ম দূর করা সম্ভব বলে ইসি দাবি করলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় ইভিএম অরক্ষিত। এদেশে বিগত সময়ের ভোটে রাতে কেন্দ্র দখল করে ব্যালটে সিল মারার ঘটনা ঘটলেও এখন দিনেই কেন্দ্র দখল করে ইভিএমে জাল ভোট দেয়ার কিছু ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। এ জন্য ইভিএমে ভোটারদের উপস্থিতিও অনেক কমে গেছে। কেননা ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের সুরক্ষার ঘাটতির কারণে ভোটদানে অনীহা রয়েছে। তা ছাড়া একাধিক কর্মকর্তা একটি পত্রিকাকে জানিয়েছেন, ইভিএম ত্রুটিমুক্ত নয় এবং শতভাগ সুরক্ষিত নয়। তবে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সব প্রার্থীর অ্যাজেন্ট কেন্দ্রে থাকলে ইভিএমে অনিয়ম ও কারচুপি বন্ধ করা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ইসি সব কেন্দ্রে সব প্রার্থীর অ্যাজেন্টকে নিরাপদে উপস্থিত রাখতে পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, যা দিবালোকের মতো সত্য। ভোটারদের নিরাপত্তা দিতেও ইসি সমভাবে ব্যর্থ। আর বিপদটা সেখানেই।
এ দিকে গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক খবরে জানা যায়, নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, ইভিএমে ৫০ শতাংশ ভোট না পড়লে ব্যালটে আবার ভোট করা উচিত। বিভিন্ন ভোটের তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, ইভিএম নিয়ে ভেটারদের মনে আছে ভীতি। এ ছাড়া জাল ভোট পড়া প্রতিহত করা একটি বড় সমস্যা। বুথ দখল করে কিংবা গোপন কক্ষে গিয়ে জাল ভোট দেয়ার ঘটনা অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ নির্বাচন কর্মকর্তাদের সম্মিলিতভাবে গোপন কক্ষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার এই ইসির জন্য এক অগ্নিপরীক্ষা।
ইসি সে পরীক্ষায় সফল হবে, তা নিয়ে অন্তত এই সময়ে জনমনে সংশয় থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ, বিগত কয়েকটি জাতীয় ও বেশ কিছু স্থানীয় নির্বাচনে কেন্দ্র দখল এবং কেন্দ্র থেকে অ্যাজেন্ট বের করে দেয়ার যে অভিজ্ঞতা তারা অর্জন করেছে তাতে এমন সংশয় জাগাটাই স্বাভাবিক। তা ছাড়া দেশে যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করছে, সে ব্যাপারটিও নিশ্চয় জনগণের বিবেচনায় রয়েছে। এখানে ভোটারবিহীন নির্বাচন এবং মধ্যরাতে কেন্দ্র দখল করে ব্যালট বাক্স ভর্তির অভিজ্ঞতা তো তাদের মাথা থেকে সরানো সম্ভব নয়।
এই তো সাম্প্রতিক খবরে জানা গেল, গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশ এখনো হাইব্রিড গণতন্ত্রের তালিকা থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারেনি। ১৬৭টি দেশের ওপর পরিচালিত একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার বার্ষিক জরিপে গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা আগের বারের মতোই ‘হাইব্রিড গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা’ বিভাগেই পড়ে আছে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বিবেচনায় আমরা এখনো এই ১৬৭ দেশের মধ্যে ৮০তম স্থানে। লন্ডনভিত্তিক প্রভাবশালী সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’-এর অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ‘ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট’ এই জরিপ প্রকাশ করেছে। ২০০৬ সালে এই বার্ষিক সূচক প্রকাশ করা শুরু হয়। সূচক প্রকাশের প্রথম বছরে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ‘দুর্বল গণতন্ত্রের’ বিভাগে। বিশেষজ্ঞদের মতে, গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশের অবনতি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। বর্তমানে দেশে পার্লামেন্ট সংসদ অকার্যকর। সরকারি দলের লোক দিয়ে যে দেশের সংসদ চলে, সে দেশের গণতান্ত্রিকব্যবস্থা সবার কাছেই দুর্বলভাবে দৃশ্যমান হয়।
এ দিকে এ কথা অনস্বীকার্য, আমাদের দেশের রাজনৈতিক দল ও নেতাদের মধ্যে বিরাজ করছে বড় ধরনের এক আস্থাহীন পরিবেশ। এ পরিবেশে প্রয়োজন ছিল এমন একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী ব্যবস্থা, যাতে সম্মতি রয়েছে প্রতিটি রাজনৈতি দল, জোট ও মহলের। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ইভিএমে আস্থা শুধু সরকারি দলের। অপর দিকে, অনাস্থা সরকারের বাইরে থাকা সব রাজনৈতিক দল, জোট ও মহলের। সুশীলসমাজও কথা বলছে এর বিরুদ্ধে। এমনই বিভক্তির মাঝে বিতর্কিত ইভিএম ব্যবস্থায় ভোটগ্রহণে ইসির একগুঁয়েমি কতটা যৌক্তিক, তা ভেবে দেখা দরকার।
অপর দিকে, সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, ইভিএমে কারচুপি হলেও চ্যালেঞ্জ করার কোনো সুযোগ নেই। শত আপত্তি ও তুমুল বিতর্কের মুখে ঢাকার সিটি করপোরেশনের দুটি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হতে যাচ্ছে। এ নিয়ে চলছে এখন নানা বিতর্ক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ যন্ত্রের মাধ্যমে গ্রহণ করা ভোটের কোনো প্রিন্টকপি না থাকায় ভোটার তার ভোট কোথায় পড়েছে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারবেন না। তা ছাড়া ইভিএমে রয়েছে ভোটারদের আস্থার অভাব। ইভিএম যদি ব্যবহার করতেই হয় তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, ভোটারদের বিশ্বাসযোগ্যতা ও সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ইভিএমে একটি প্রিন্ট ট্রে রাখা প্রয়োজন ছিল। তখন ভোটার দেখতে পারতের, কোথায় তার ভোট পড়েছে। আর এই বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ইসির আলোচনা করা উচিত ছিল। এ ছাড়া কনট্রোল ইউনিট চিপ যে প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে যুক্ত করা হবে, সেটি প্রোগ্রামিং করার সময় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের উপস্থিত রাখা উচিত ছিল। তাহলে কিছুটা হলেও বিশ্বাসযোগ্যতা আসত।
ইভিএম বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী রিয়াজুল ইসলাম রিজুর মতে, ইভিএম যন্ত্র মানুষের তৈরি। এতে যেভাবে প্রোগ্রামিং করে দেয়া হবে, সেভাবেই চলবে এটি। সকালে ভোট শুরুর প্রথম ঘণ্টায় সঠিকভাবে ভোট হলেও পরের ঘণ্টায় তা ঠিক নাও থাকতে পারে। এখানে ফলাফল ম্যানিপুলেশন সম্ভব।
বিশেষজ্ঞদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ইভিএম প্রথম চালু হয় যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৬০ সালে। কিন্তু এখন সেখানে ইভিএমে ভোট হয় না। পৃথিবীর ৯০ শতাংশ দেশে ইভিএম পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় না। যারা এটি ব্যবহার করেছেন, তারাও এখন এটি নিষিদ্ধ করছেন। এর পরও আমাদের নির্বাচন কমিশন দেশের বিভিন্ন নির্বাচনে জনমতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ইভিএম ব্যবহার করে এটিকে পরিণত করে তুলছে নির্বাচনী বিতর্কের এক বিরাট উপাদানে। কেনো নির্বাচন কমিশনের এই অতি উৎসাহ, তা নিয়ে বাজারে চালু আছে নানা কথা। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement