১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার সময় এখনই

-

(ভারতের কেরালা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন ভারতের প্রখ্যাত ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকায় যে প্রবন্ধ লেখেন, এর অনুবাদ এখানে দেয়া হলো।)
২০১৯ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল যা সম্প্রতি ভারতীয় লোকসভায় এবং রাজ্য সভায় অনুমোদিত হয়েছে তা তিনটি কারণে ভারতবাসীকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। প্রথম কারণ হলো, এই আইন ভারতের সংবিধানের মূলনীতি ও আদর্শের পরিপন্থী। দ্বিতীয় কারণ হলো, এই আইন বিবাদ ও বিভাজন সৃষ্টিকারী এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী। তৃতীয়, এটি হিন্দুত্ববাদের রাজনৈতিক দর্শনের ওপর ভিত্তি করে ভারতের রাজনীতিতে ও সংবিধানে বা শাসনতন্ত্রে হিন্দুত্ববাদ কায়েমের একটি বিরাট বিপজ্জনক প্রয়াস। কাজেই কোনো ভারতীয় যার গণতন্ত্রের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ও বিশ্বাস রয়েছে এই সর্বনাশা ভয়াবহ পরিস্থিতিতে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারেন না।
আসুন, উপরোল্লিখিত তিনটি বিষয়ে আমরা বুঝতে চেষ্টা করি। প্রথম হলো, বর্তমান নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন আমাদের শাসনতন্ত্রের মৌলিক আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক। আমাদের শাসনতন্ত্রে ৫ থেকে ১৩ ধারা পর্যন্ত নাগরিকত্বের বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে এবং ১৯৫৫ সালের নাগরিক আইনের ধারা অনুযায়ী নাগরিকত্বের ভিত্তি হলো জন্মগত, বংশধররূপে উদ্ভব, নাগরিক হিসেবে নিবন্ধনভুক্ত করা, রাষ্ট্রের দখলে কোনো ভূমি আসার পর সেখানকার অধিবাসী হওয়া। এবার সংশোধিত নাগরিক আইনে নতুন শর্ত অন্তর্ভুক্ত করার পর সংশোধনীটির দ্বারা শাসনতন্ত্র লঙ্ঘিত হয়েছে। অথচ এর ১৪ নম্বর বিধিতে বলা হয়েছেÑ শাসনতন্ত্র কোনো নাগরিককে আইনের সাম্য থেকে বঞ্চিত করবে না। ১৪ ধারা শুধু নাগরিকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, এটি যারাই ভারতের অভ্যন্তরে অবস্থান করেছে সে অধিকার সমভাবে তারাও পাবেন।
সংবিধান বা ‘শাসনতন্ত্রের আত্মা’ তথা ‘শাসনতান্ত্রিক উদ্দীপনা’ বলতে আমরা কী বুঝি? ভারতের স্বাধীনতার স্থপতিরা শাসনতন্ত্র রচনার সময় দীর্ঘদিন লোকসভায় নতুন শাসনতন্ত্রের ওপর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেছিলেন। এতে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছিলেন বাবাসাহেব আম্বেদকার। এ ছাড়া লাখ লাখ স্বাধীনতার সংগ্রামীর আপসহীন আন্দোলনের ফলে এটি বাস্তবে রূপ লাভ করেছে। এ ছাড়া, লাখ লাখ শ্রমজীবী এবং কৃষিজীবী উপনিবেশবাদী শক্তির বিরুদ্ধে আপসহীন আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তাদের স্বপ্ন ছিল অর্থনৈতিক সাম্য গড়ে তোলা। বস্তুত এই সংগ্রামের লক্ষ্য শুধু বিদেশী শাসকদের উৎখাত করা ছিল না। এ লক্ষ্য ছিল ব্যাপকভিত্তিক। আধুনিক ভারতের ইতিহাসের এই আলোকবর্তিকাদের সংগ্রামের উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক ন্যায়বিচার কায়েম করা। এ জন্য একটি গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ শাসনতন্ত্রই ছিল কাম্য যাতে মানুষে মানুষে বিভেদ, পক্ষপাত এবং বিভিন্ন বৈষম্য চিরতরে বিদায় নেবে।
যদিও শাসনতন্ত্র রচিত হওয়ার পর সম্পূর্ণ মুক্তি এবং সামাজিক সমতা ফিরে আসেনি, তবুও এই শাসনতন্ত্র আমাদের জাতির পথনির্দেশিকা হিসেবে বহুত্যাগের বিনিময়ে আমরা লাভ করেছি। আমাদের স্বাধীনতার অগ্রদূতরা সবসময় সজাগ ছিলেন যে, তাদের এই সংগ্রামের ফলে এমন একটি সমাজ গড়ে তুলতে হবে যা হবে জাতহীন, বর্ণহীন ধর্মনিরপেক্ষ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণমুক্ত। ১৯৩১ সালে করাচিতে অনুষ্ঠিত ভারতীয় কংগ্রেস দলের সম্মেলনে বাকস্বাধীনতা, জনসভার স্বাধীনতা এবং আইনে সবার সমতাসহ মানবাধিকার সংক্রান্ত সব বিষয়ে স্বাধীনতা দেয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভারতের অনেক দেশীয় রাজ্যও অংশগ্রহণ করেছিল।
আমাদের স্বাধীনতার স্থপতিরা স্বপ্ন দেখেছিলেন, ভারত সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্ত থাকবে। অথচ আজকে আমাদের শাসনতন্ত্রের সর্বঅংশ আক্রান্ত হচ্ছে যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সামাজিক সাম্য, ভারতের ফেডারেশনের রূপরেখা ইত্যাদি লিপিবদ্ধ রয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, যেসব শ্রেণীর মানুষ ওই আদর্শগুলোর ওপর আক্রমণ করছে, তাদের ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে কোনো অবদান নেই। ‘হিন্দুত্ববাদের’ অগ্রদূতরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে আত্মসমপর্ণ করেছিল। শতবার তা অস্বীকার করলেও বীরত্বপূর্ণ সে অতীত তারা অস্বীকার করতে পারবে না কিংবা মুছে ফেলা যাবে না। দ্বিতীয় আলোচ্য বিষয় হলো নাগরিকত্ব আইন, এই আইন বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টিকারী, অসাম্যমূলক এবং মানবিক অধিকার লঙ্ঘনকারী। আগেও বলেছি, আমাদের জাতীয় ঐক্য সংগ্রাম ও আন্দোলনের মাধ্যমে এসেছে। নাগরিক আইনের সংশোধনী বর্তমানে আমাদের জাতীয় ঐক্য ধ্বংস হওয়ার অনেক কারণের মধ্যে একটি। অতি কষ্টে গড়া শাসনতন্ত্রে আমরা নিজেদের সামাজিক পার্থক্য এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ের কথা আমরা অকপটে স্বীকার করেছি এবং বৈচিত্র্যের মধ্যে আমাদের ঐক্যের কথা মেনে নিয়েছি।
নাগরিকত্ব সংশোধনী আর কিছু নয়, এটি সাম্প্রদায়িক পার্থক্য আরো গভীরভাবে সৃষ্টি করে দেয়ার আরেকটি নোংরা প্রয়াস। এই আইন মোতাবেক আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি এবং খ্রিষ্টানদের যারা ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ সাল, পর্যন্ত ভারতে প্রবেশ করেছে তারা ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবেন। তবে এ সময়ের মধ্যে এ দেশগুলো থেকে কোনো মুসলমান ভারতে এলে তাকে নাগরিকত্ব দেয়া হবে না। সে ক্ষেত্রে তাদেরকে নিজ নিজ দেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে। এতে ভারতীয় শাসনতন্ত্রের মৌলিক আদর্শ, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ অস্বীকার করা হয়েছে যা এই শাসনতন্ত্রের অবমাননা। ভারতীয় স্বাধীনতার স্থপতিদের অনেক গবেষণা এবং দীর্ঘ আলোচনার পর তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ছাড়া ভারতের ঐক্য কিছুতেই টিকিয়ে রাখা যাবে না।
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সংশোধিত নাগরিক আইনের বিরুদ্ধে অগণিত মানুষ রাস্তায় আন্দোলনে নেমে পড়েছে। তাদের মতে এই আইন বৈষম্যমূলক, মানবিক অধিকার হরণকারী এবং ভারতকে এই আইন বহুভাগে বিভক্ত করে ছাড়বে। উল্লেখযোগ্য হলো, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বাতিলের আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি অংশগ্রহণ করেছে ভারতের প্রায় বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। তবে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবং তাদের সহযোগী দলগুলো অতি সহজেই পার্লামেন্টের উভয় হাউজে এই আইন অনুমোদন করিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এই আইনের সংশোধনের বিরুদ্ধে সমগ্র ভারতের যুবসমাজ বিশেষ করে ছাত্রসমাজ, ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ের মতো মাঠে নেমেছে ধর্মীয় ভিত্তিতে ভারত বিভক্তির বিরুদ্ধে। তারা ঘোষণা দিয়েছেন, বিবাদ সৃষ্টিকারী এবং মানবতাবিরোধী এই আইন তারা কিছুতেই মেনে নেবেন না। আমাদের শেষ বক্তব্য হলো, ভারতীয় জনতা পার্টি এই আইন পাস করে ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। এটাই হলো বিজেপি এবং আরএসএসের লক্ষ্য। আমরা আগেই বলেছি, স্বাধীনতা আন্দোলনে আরএসএসের কোনো অবদান ছিল না। এই সময়ে তাদের নেতা গোলওয়ালকার ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন, যেখানে অন্য কোনো ধর্মাবলম্বীর বসবাসের অধিকার থাকবে না। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনই হলো বিজেপির ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি আঘাত।
সামাজিক সাম্য এবং ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য কেরালার সংগ্রাম থেকে আমাদের অনেক কিছুই শিক্ষা নেয়ার রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে কেরালার সব রাজনৈতিক দল আর বিভিন্ন সামাজিক শক্তি এবং পরবর্তীকালে বামপন্থী ও অন্যান্য প্রগতিবাদী সামাজিক শক্তিগুলো সামাজিক অসাম্য এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সর্বকালে সংগ্রাম চালিয়ে গেছে। কেরালার সব রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক সংগঠনগুলো (একমাত্র হিন্দুত্ববাদী শক্তিছাড়া) অর্থাৎ, সবাই এক হয়ে ভারতীয় শাসনতন্ত্রের মূল্যবোধ এবং মৌলিক মানবিক অধিকারগুলো রক্ষার জন্য একত্র হয়ে সংগ্রামে নেমেছে। আমরা গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর জঘন্য হামলার বিরুদ্ধে অবরোধ এবং আন্দোলন বন্ধ করতে পারি না। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা করার এখনই সময়। হ
ভাষান্তরÑ শাহাবুদ্দীন খালেদ চৌধুরী
shahabuddinkhaled47@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement