২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

যে কথা বলতে চাই না

সময়-অসময়
-

সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী নি¤œ আদালত থেকে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত বিচারিক কাজে ৩৭ বছর (তন্মধ্যে প্রায় ১৬ বছর হাইকোর্টের বিচারপতি) নিয়োজিত থাকার পর ৮ জানুয়ারি ২০২০ তার সর্বশেষ কর্মদিবসে বিদায়ী সম্ভাষণে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করে বক্তৃতায় বলেছেন, ‘বিচার বিভাগ নিয়ে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জনগণের এই দৃষ্টিভঙ্গির মূল্যায়ন করতে হবে।’ বিচারিক কাজে নিয়োজিত ৩৭ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন বিচারপতি অবসরলগ্নে বিচার বিভাগ সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন তা গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে মন্তব্যটা কী দাঁড়ায়? ধ্রুব সত্য যে, জনগণের জন্যই তো বিচারিক ব্যবস্থা, সভ্যতার প্রথম শর্ত ন্যায়ভিত্তিক বিচার। ফলে প্রশ্ন ওঠে, সর্বস্তরের জনগণের মনের ভাষা কি বিচার বিভাগ হৃদয়ঙ্গম করে? হাইকোর্টে টাকার বিনিময়ে কজ লিস্টের সিরিয়াল ওঠা-নামার কথা ইতঃপূর্বে গ্রামপর্যায়ে চায়ের দোকানেও আলোচনা হতো, এখন তা নিয়ন্ত্রণ হয়েছে। ফলে উচ্চ আদালতের বিচারপ্রার্থীরা কিছুটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। কিন্তু এফিডেফিট ও কোর্টের আদেশ ছাড় করানোর বিষয়টি প্রধান বিচারপতির জবানিতে প্রকাশ পেয়েছে যে, সিসি ক্যামেরা লাগিয়েও তিনি তা (কোর্টের প্রশাসনিক ঘুষ প্রথা) নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। জনমনে বিশেষ করে বিচারপ্রার্থীদের দৃষ্টিভঙ্গিতে রয়েছে, বিচারপতি নিয়োগ যেমন রাজনৈতিক বিবেচনায় হয়ে আসছে, অনুরূপ বিচারিক বেঞ্চ গঠন হয়ে থাকে রাজনৈতিক বিবেচনায়। কোন সরকারের আমলে কোন বিচারপতি নিয়োগ হয়েছেন তাও বেঞ্চ গঠনে বিবেচনা করা হয় বলে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গিতে অর্থাৎ পাবলিক পারসেপসনে ধরা পড়ে, যা নিয়ে কোর্ট প্রাঙ্গণে আলোচনা প্রতিনিয়তই চাউর হয়। বিচারপ্রার্থীরাও নিজ মামলা পরিচালনার জন্য আইনজীবী নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করে। তবে ক্ষমতায় পালাবদল বা ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আদালতের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জনগণের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেও হাইকোর্ট বা উচ্চ আদালত আছে বলেই জনগণ আশ্রয়ের একটি স্থান খুঁজে পাচ্ছে। অন্যথায় আমলানির্ভর সরকার জনগণের অধিকারকে নিষ্পেষিত করার আরো অধিক সুযোগ পেত। বিচারপতি মইনুল ইসলামের মতে, বিচার বিভাগ সম্পর্কে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি যদি মূল্যায়ন করতে হয় তবে বর্ণিত বিষয়গুলোও আলোচনায় আসে বৈ কি।
বিগত সংখ্যায় ‘পরশ্রীকাতরতা’ বিষয়টি আলোচনা-পর্যালোচনায় ইতি টানতে পারিনি বলে বিষয়টি নিয়ে একটু আলোকপাত করতে হলো। দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ যদি মানুষকে তাড়িত, ব্যথিত, উৎসাহিত, অনুপ্রাণিত বা আত্মসমালোচিত না করে তবে ‘মনুষ্য’ গুণাবলি মানবজীবনে যা ধারণ করার কথা তা পরিস্ফুটিত হয় না। ব্যক্তিজীবনে একজন মানুষ কি উদাসীন থাকবে নাকি তাকে হতে হবে চিন্তাশীল? একজন মানুষের ব্যক্তি ইচ্ছা অভিলাষ থাকতে পারে, কিন্তু এর সীমারেখা কতটুকু পর্যন্ত সম্প্রসারিত হতে পারে? এটাও এখন মানুষের দৃষ্টিসীমায় থাকার কথা। যদি না হয় তবে মানুষরূপী দেহটি তার জিঘাংসা চরিতার্থ করার জন্য একটি নেকড়ে বাঘের চেয়েও হিংস্র হওয়ার অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে, যা দেখেশুনেও মানুষ্য জীবন কিভাবে কলঙ্কিত হয় তাতে অন্য কারো (মানুষের) উপলব্ধি হয় না।
মন-মানসিকতার দিক থেকে মানুষ নিজেরাও উল্টোপথের যাত্রী। একটি গাই বা গাভীর দুধ ও গোশত মানুষের জন্য উৎকৃষ্ট ও পুষ্টিকর খাদ্য, চামড়া দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান, গোবর জ্বালানি বা সার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রাচীন যুগ থেকে একটি গাধা মানুষের একটি বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অথচ কাউকে গরু, গাই, গাধা হিসেবে সম্বোধন করলে রাগান্বিত হয়, অপমানিত বোধ করে প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করে। অন্য দিকে, কাউকে বাঘ বা বাঘের বাচ্চা বলে সম্বোধন করলে খুশি হয়, সম্মানিত ও গর্ভবোধ করে। অথচ বাঘ মানুষের ওইভাবে উপকারে লাগে না, বরং অত্যাচারী রাজা, বাদশাহ, জমিদাররা সিংহ বা বাঘের খাঁচায় মানুষ হত্যার অনেক ইতিহাস রয়েছে। বাঘের গতি রয়েছে যেমন তীব্রতর, হিংস্রতাও রয়েছে অনুরূপ। তার পরও হিংস্র পশুর নামে নামকরণেই বিশেষণ লাভ করা মানুষের আশা আকাক্সক্ষা। অনুরূপ অনেক সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে হিংস্র পশুর নামকরণে, যেমনÑ লায়ন ক্লাব, ইন্টারন্যাশনাল। বাংলাদেশের ক্রিকেট টিম টাইগার নামে পরিচিত।
আমাদের সমাজে একজন খুনি খুন করে আত্মতৃপ্তি লাভ করে, অথচ তাকে ‘খুনি’ বলা যায় না। খুনিকে প্রকাশ্যে ‘খুনি’ বলে সম্বোধন করলে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য আরেকটি খুন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, শত শত খুন করলে পায় ‘বীর’ উপাধি, একটি খুনের জন্য প্রাপ্ত হয় ফাঁসির দড়ি।
‘স্বার্থ’ ও ‘আদর্শে’ যদি সঙ্ঘাত বাধে তখন মানুষ কোনটা বেছে নেয়? অবশ্যই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তখন ‘স্বার্থ’কে বেছে নেয়, স্বার্থের সাথে কোনো সঙ্ঘাত করে না, বরং সাংঘর্ষিকতা সৃষ্টি করে ‘আদর্শের’ সাথে। তখন ব্যক্তিজীবনের পরিবর্তে ‘আদর্শ’ স্থান করে নেয় শুধু আদর্শলিপির পাতায় বা কোনো বক্তৃতার মঞ্চে বা ধর্মগুরুর ধর্মসভায়। কিন্তু কর্মজীবন বা ব্যক্তিজীবনে আদর্শের সাথে যারা সঙ্ঘাতে জড়ায় না তাদের সংখ্যা এতই অল্প, যা দেখতে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্য লাগে। তবে কণ্ঠভোটে ‘আদর্শ’ হেরে গেলেও ‘আদর্শের’ একটি গৌরব আছে, যা স্বার্থপর বা পরশ্রীকাতরাদের জন্য একটি আতঙ্ক। রাতের আঁধার হোক বা সূর্যের আলোতেই, স্বার্থপরতা বা পরশ্রীকাতরতা কোনো দিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি, এটাই মনের সান্ত্বনা তাদের কাছে যারা বারবার জীবনযুদ্ধে হেরে যাচ্ছে, অভাবের তাড়নায় বা অন্য কোনো কারণে। পরশ্রীকাতর মানসিকতাসম্পন্ন সমাজব্যবস্থায় বিবেকমান মানুষগুলো যন্ত্রণার সাগরে কাতরাচ্ছে, কিন্তু আপস করছে না এবং এটাই তাদের গৌরব।
আমাদের সমাজে একটা প্রবাদ চালু রয়েছে, ‘উপকারের প্রতিদান পাওয়া যায় না।’ অর্থাৎ যার থেকে উপকার পায় বা সহযোগিতা পায় তার ক্ষতি করাও একটা স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। এর পেছনের কারণও ‘স্বার্থ’ এবং ‘স্বার্থ’। স্বার্থের প্রশ্নে মানবসমাজ একেবারেই অন্ধ। এ অন্ধত্ব মোচনের জন্য যে অনুশীলনের প্রয়োজন বর্তমান সমাজব্যবস্থা মানবজাতিকে তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
গত বছরটি ছিল বিরাজনীতিকীকরণের বছরÑ জাতীয় পত্রিকার মন্তব্য। দেশ দিনে দিনে বিরাজনীতিকীকরণের দিকে এগোচ্ছে, এটাই সাধারণ নাগরিকদের ধারণা। মানুষ কি রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, নাকি রাজনীতিবিদরা গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে (!) যে রাজনৈতিক দল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনীতি করে সে দলে কি অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের অনুশীলন আছে? রাজনৈতিক দলের সংবিধান কি মূলত কার্যকর রয়েছে? তৃণমূল থেকে একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম কিভাবে তৈরি হতে হয়, অনুরূপ অনুশীলনের দাবি কি কোনো রাজনৈতিক দল জোরগলায় করতে পারবে? দলের মূল নেতাকে ঘিরে রাখা নিকটস্থ নেতাদের আনুগত্যের প্রতিযোগিতা চলে বটে, তবে সে আনুগত্য দলীয় আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নয়, বরং নিজের মৃত্যুর পর ছেলেটা যেন এমপি-মন্ত্রী হতে পারার পথ সুগম করার প্রতিযোগিতা। দলে যখন ক্র্যাকডাউন হয়, তখন কথিত অতি আনুগত্যদের খুঁজে পাওয়া যায় না এবং এটাই সুবিধাভোগী ও সুবিধাবাদী রাজনীতির চরিত্র। ফলে দেশের রাজনীতি দিন দিন বিরাজনীতিকীকরণের দিকে এগোচ্ছে। হয়রানি হতে হচ্ছে জনগণকে। রাজনৈতিক আন্দোলনই জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তনসহ শাসক দলের বিভিন্ন অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে, অধিকার আদায়ের জন্য জীবনবাজি রেখে সংগ্রাম করেছে।
জনগণের সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের যে সংগঠন তা-ই রাজনৈতিক দল। ক্ষমতায় যাওয়াই একটি রাজনৈতিক দলের একমাত্র টার্গেট থাকা বাঞ্ছনীয় নয়। ক্ষমতায় যাওয়ার টার্গেট অবশ্যই থাকতে হবে, তবে দলের আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য একটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীবাহিনী থাকা দরকার, যারা গড়ে উঠবে শুধু আদর্শভিত্তিক। আদর্শভিত্তিক কর্মীবাহিনী থেকে নেতৃত্ব বের করে আনতে হবে। আদর্শের পরিবর্তে নির্বাচনের আগ মুহূর্তে বা পূর্ব রাতে কোরবানির হাটের মতো নেতা কেনাবেচার পথ বন্ধ করার জন্য আদর্শভিত্তিক একটি কর্মীবাহিনী গঠন করা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। এ পদ্ধতিতে রাজনৈতিক দলগুলো হাঁটে না বিধায় দল যখন বিপদে পড়ে তখন সুবিধাবাদী বা সুবিধাভোগী চক্রদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না, কিন্তু আদর্শবান কর্মীদের ভোগান্তি থাকে চিরদিন। একটি রাজনৈতিক দল অর্থের কাছে বিক্রি হতে পারে না এবং দলের কর্মী থেকেই নেতৃত্ব সৃষ্টি করার অনুশীলন দল করবে, এটাই একজন আদর্শবান রাজনৈতিক কর্মীর প্রত্যাশা।
একটি আদর্শ জাতি গঠন ও জাতিসত্তা বিনির্মাণে রাজনৈতিক দলগুলোর আদর্শিক ভূমিকা থাকা উচিত। অন্যথায় আদর্শভিত্তিক কর্মীবাহিনী গড়ে উঠবে না বিধায় যে দলই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হোক না কেন, তাতে চুরি, ছেচরামি, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, পুকুরচুরি, সাগরচুরি, অবৈধ দখল এবং জাতিসত্তা হরণ করা চলতেই থাকবে। ফলে ক্ষমতায় পালাবদল হবে বটে। কিন্তু ভাগ্যাহত মানুষদের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে না, ভাগ্যবানরা আরো সৌভাগ্যবান হবে, দরিদ্ররা আরো হতদরিদ্র হতে থাকবে। তখন ক্ষমতা হবে সেবার নয় বরং শাসন ও শোষণের হাতিয়ার, রাজনৈতিক দল হবে ও হচ্ছে শোষকদের পৃষ্ঠপোষক বা দুর্বৃত্তদের সম্মেলনস্থল বা ক্লাব জাতীয় সংগঠন। যারা কর্মীদের ব্যবহার করে বা করবে টিস্যু পেপারের মতো এবং রাজনীতি প্রেমিককর্মীরা অন্ধের মতো ব্যবহার হতেই থাকবে, ইতঃপূর্বে যেমনিভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। ফলে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত করার জন্য নিবেদিত কর্মীদের অন্ধ হলে হবে না, নিজেদের পথ নিজেকেই খুঁজতে হবে। হ

লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী
ঊ-সধরষ: ঃধরসঁৎধষধসশযধহফধশবৎ@মসধরষ.পড়স


আরো সংবাদ



premium cement