২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

পেঁয়াজÑ একটি প্রাসঙ্গিক উপাখ্যান

-

[২]

মুনাফা বনাম নৈতিকতা
সবাই প্রত্যাশা করে, ব্যবসায়ীরা সব সময় একটা নৈতিকতা বোধের পরিচয় দেবে। ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ও তাই চায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এই নৈতিকতার পরিমাপ ও পরিধি কী হবে তা আজো পরিমাণ করা সম্ভব হয়নি। স্থান-কালপরিক্রমায় অন্যান্য পরিবর্তনের (রাজনৈতিক ও সামাজিক) সাথে অর্থনৈতিক নৈতিকতাও বদলায়। তা ছাড়া নৈতিকতার নানা দিক ও মাত্রা আছে। ব্যক্তিগত সততা, ন্যায্য আচরণ, চুক্তি অনুযায়ী মূল্য পরিশোধ, যথাসময় দেনা পরিশোধ, অতিরিক্ত মুনাফা করার লোভ থেকে বিরত থাকা, যথাযথ পরিমাপ প্রদান, গ্রাহকের সাথে সত্য কথা বলা; এসবই যেমন মানুষের ব্যক্তিগত নৈতিকতার সাথে জড়িত, তেমনি অর্থনীতির সাথে সম্পর্কিত। নৈতিকতার সংজ্ঞা সম্পর্কে নানা ধরনের মানুষ, নানা ধারণা পোষণ করেন বিধায় জনসমাজে নৈতিকতা নানা দিকমাত্রায় গঠিত।
অর্থনীতির নানা বিষয় দৈনন্দিন জীবনের নানা উপাদান হিসেবে গুরুত্ব¡পূর্ণ। বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারের হস্তক্ষেপের ব্যাপারে অনেকে আদর্শিক যুক্তিতর্কের সীমা ছাড়িয়ে যান। মনে রাখা ভালো ‘বাজারের দৈনন্দিন লেনদেন সবসময় আত্মস্বার্থনির্ভর’। অর্থনীতি শাস্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডাম স্মিথ যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন, ‘সাধারণ নিয়মে বাস্তবিক পক্ষে কোনো ব্যক্তির যেমন জনস্বার্থকে উন্নীত করার কোনো অভিপ্রায় থাকে না, তেমনি সে এটাও জানে না যে তার কর্মপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে সে জনস্বার্থ উন্নীত করছেন কি না। প্রত্যেক ব্যক্তির অভিপ্রায় হলো তার নিজ অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধান; নিজের লাভ-মুনাফা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকা। এসব কাজ সমাজের জন্য যে খারাপ তা-ও নয়। বরং দেখা যায়, একজন ব্যক্তি যখন নিজের স্বার্থ অন্বেষণ করেন, একই সাথে তিনি সমাজের স্বার্থও উন্নীত করছেন, যদিও এটা তার জানা নেই অথবা তার কোনো অভিপ্রায় ছিল না।’
নৈতিকতা, নৈতিক আচার-ব্যবহার সমাজে কোনো একক গোষ্ঠীর বিষয় নয়। ব্যবসায়ী গোষ্ঠীসহ দেশের সামাজিক গোষ্ঠীগুলোর নৈতিক চরিত্রের মান সেই দেশের রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের চরিত্রের কাঠামোতে নিহিত থাকে। অতএব, ব্যবসায়ীদের ঘাড়ে সব দোষ চাপালে পেঁয়াজের উৎপাদন বা সরবরাহ কোনোটাই বাড়বে না। বরং সরবরাহ বিঘিœত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। সেই সাথে দাম আরো বেড়ে যেতে পারে। এক-এগারো সরকারের সময়কালে ব্যবসায়ীদের অযাচিত ধরপাকড় ও জেলজুলুমের পরিণতি তাই হয়েছিল। এখনো তাই হচ্ছে। অযাচিত জরিমানার সাথে সাথে প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে পেঁয়াজের দাম বেড়ে চলেছে। যা হোক, এবার আমি এই প্রতিপাদ্যের মূল বিষয়ে ফিরে যাই।

চাহিদা বনাম সরবরাহ
জনসংখ্যা ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি বাংলাদেশে পেঁয়াজের চাহিদা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। বিবিএস-এর আয় ও ব্যয় জরিপ (২০০২-২০০৭-২০১২) অনুযায়ীÑ মাথাপিছু পেঁয়াজ ব্যবহারের পরিমাণ ২০০২ সালে ছিল ৫.৬ কেজি, যা ২০০৫ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৬.৮ কেজি এবং ২০১২ সালে ৮.২ কেজি। অর্থাৎ এই সময়কালে বছরপ্রতি পেঁয়াজের ব্যবহার বেড়েছে প্রায় ৪ শতাংশ। ২০১৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ওঋচজও) বিশ্লেষণ করে বলেছে, ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে পেঁয়াজের চাহিদা হবে ২১ লাখ টন এবং প্রতি বছর চাহিদা বাড়বে ৫ শতাংশ হারে। আইএফপিআরআই বিশ্লেষণে আরো বলছে, শহরের বাসিন্দারা গ্রামের মানুষের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি পেঁয়াজ খায়। গ্রামে অকৃষি কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতা, নদীভাঙন, শহর-গ্রামে আয়ের বৈষম্য বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণে ২০১৩ সালের তুলনায় বর্তমানে নগরায়ন দ্রুত হারে বাড়ছে। অতএব, নগরায়ন বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে মাথাপিছু পেঁয়াজের চাহিদা আরো বেশি হারে বাড়বে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান যেমন, বিবিএস কর্তৃক দেশে উৎপাদনের পরিমাণ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের আমদানির পরিসংখ্যান থেকে ধারণা করা যায় যে, ২০১৮ সালে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ৩০ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ৯ লাখ টন বেশি এবং মাথাপিছু পেঁয়াজের চাহিদা বেড়েছে ৬ শতাংশ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের প্রাক্কলন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আমদানি তথ্য মতে, ২০১৮ সালে স্থানীয় পর্যায়ে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ২৩.৩০ লাখ টন ও আমদানি হয়েছে প্রায় ১১ লাখ টন, সর্বমোট ৩৪.৩০ টন। কিন্তু বিবিএসের খানা জরিপ (২০১৮) অনুযায়ী, ২০১৮ সালে স্থানীয় পর্যায়ের উৎপাদন হয়েছে ১৮.৩০ লাখ টন, এর সাথে আমদানিকৃত ১১ লাখ টন যোগ করলে, মোট চাহিদার পরিমাণ দাঁড়ায় ২৯.৩০ লাখ টন। সরকারের এ দু’টি সংস্থার হিসাবকে আমলে নিয়ে আমরা ধারণা করতে পারি, ২০১৮ সালে পেঁয়াজের সর্বনিম্ন চাহিদা ছিল ৩০ লাখ টন।
বছরে ৬ শতাংশ চাহিদা বৃদ্ধির হিসাবকে আমলে নিলে, ২০১৯ সালে পেঁয়াজের চাহিদা হবে ৩২ লাখ টন। এখানে বলে রাখা ভালো যে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যানের তারতম্য; পণ্যের উৎপাদন, আমদানি, চাহিদা ও সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে ধান্ধা সৃষ্টি করে। তাতে সরবরাহ বিঘিœত হয় এবং বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। পণ্যের বাজারমূল্য কী হবে, সেটা মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাজার নির্ধারণ করে। পণ্যের প্রকৃত মূল্য হলো; ‘যে মূল্য দিয়ে ভোক্তা পণ্য কিনতে রাজি হয়।’ তবে বাজারে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না থাকলে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে এবং মূল্য ওঠানামা করে। অতএব, আমরা যদি সঠিক মূল্যে সঠিক পরিমাণ পেঁয়াজ সরবরাহ করতে চাই তাহলে ভোক্তার পছন্দমতো জাতের পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়াতে হবে। বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণ জমিতে পেঁয়াজ চাষ করা সত্ত্বেও একর প্রতি ফলন কম হওয়ার কারণে চাহিদা ও উৎপাদনের মাঝে ফাঁরাক দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।

কৃষি অধিদফতর ও বিবিএসের
পরিসংখ্যানের ফারাকÑ কারণ
সাধারণত মৌসুম শুরুর আগেই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর পেঁয়াজসহ বহু কৃষিপণ্য চাষাবাদের জমির আয়তন ও সম্ভাব্য উৎপাদনের পরিমাণ নির্ধারণ করে থাকে। মোট পেঁয়াজ উৎপাদন নিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অনুমান সর্বদাই বিবিএসের চেয়ে ৫০০ থেকে ৭০০ টন বেশি হয়ে থাকে। পার্থক্যের অনুমেয় কারণগুলোর মাঝে; চাষাবাদের জমি ও ফলনের পরিমাণ নির্ণয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সত্যিকারের কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে কি না আমার জানা নেই। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর তাদের মাঠপর্যায়ের অফিস থেকে সরেজমিন তথ্য সংগ্রহ করে। জমি চাষাবাদের পরিমাণ নিয়ে তেমন কোনো বিতর্ক না থাকলেও, সমস্যা হলো মোট উৎপাদিত পরিমাণ নিয়ে। কৃষকরা পেঁয়াজ উৎপাদনে নানা ধরনের বীজ বপন করে এবং ভিন্ন ভিন্ন চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরণ করে। এ কারণে একরপ্রতি উৎপাদনের পরিমাণ সমান নয়। তা ছাড়া মোট উৎপাদনের কিয়দংশ কখনোই বিক্রির জন্য বাজারে আসে না। কৃষকরা তিনটি কারণে উৎপাদিত পেঁয়াজের কিয়দংশ সংরক্ষণ করে থাকে। যেমনÑ পরের মৌসুমে ‘মুড়িকাটা’ পদ্ধতিতে পেঁয়াজ উৎপাদনের জন্য। নতুন করে কন্দ উৎপাদনের জন্য যা দিয়ে পরবর্তী মৌসুমে বীজ উৎপাদন করবে। বীজ উৎপাদনের জন্য কন্দ সংরক্ষণ করা ও বীজ উৎপাদনের জন্য যে জমি চাষ করা হয় সে জমি থেকে কন্দ উৎপাদন হয় না। কেননা বীজ পারিপক্ব হওয়ার পর যখন সংগ্রহ করা হয় তখন কন্দ পচে যায়। এসব জমি পেঁয়াজ চাষের জন্য ব্যবহার করা হলেও এই পেঁয়াজগুলো কখনোই বিক্রয়ের জন্য বাজারে আসে না।

বীজ উৎপাদনে জমি ও কন্দের ব্যবহার
সাধারণত ১০ থেকে ১২ শতাংশ চাষকৃত জমিতে পেঁয়াজের চাষ করা হয় ‘মুড়িকাটা পদ্ধতিতে’। প্রতি একর জমি চাষে ৪৫০ কেজি কন্দের প্রয়োজন হয়। অতএব ৫০-৬০০০০ একর জমি চাষে কৃষকদের প্রায় ২৭০০০ থেকে ৩০০০০ টন কন্দের প্রয়োজন হয়, যা কৃষক সংরক্ষণ করে রাখেন। খুব জরুরি প্রয়োজন না হলে এই পেঁয়াজ বিক্রি করে না। এই সময়কার মতো যদি কখনো পেঁয়াজের মূল্য বেড়ে যায় তখন তাৎক্ষণিক মুনাফা লাভের জন্য কিছু অংশ বাজারে বিক্রি করে দেয়।
বাংলাদেশে ৮০০ থেকে ৯০০ টন পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন করা হয়। প্রতি একর জমিতে প্রায় ১৫০ কেজি বীজ উৎপাদিত হয়। সেই হিসাবে প্রতি টন বীজ উৎপাদনে ৬ থেকে ৭ একর জমি প্রয়োজন হয়। অতএব, পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনে ৬-৭০০০ একর জমি ও ৩৫০০ থেকে ৪০০০ টন কন্দ প্রয়োজন। তাই বলা যেতে পারে যে এই ৬০০০ একর জমি পেঁয়াজের জন্য চাষ করা হয় না। অথবা বলা যায় যে বছরে প্রায় ৩০০০০ টন কন্দ আসলে উৎপাদন হয় না।
পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনের জন্য পেঁয়াজের কন্দ প্রয়োজন হয়। অন্যান্য ফসলের মতো বীজ থেকে পেঁয়াজের বীজ উৎপাদন করা যায় না। এই বীজ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন দুই বছরের চক্র। বিষয়টি আরো বোধগম্য করা যায় এভাবে যে এক মৌসুমে বীজ রোপণ করে কন্দ উৎপাদন করা হয়। পরের মৌসুমে আবার কন্দ রোপণ করে বীজ উৎপাদন করা হয়। বাংলাদেশে এখন কৃষকরা নিজ ব্যবহারের জন্য প্রায় ৮০০ থেকে ৯০০ টন বীজ উৎপাদন করে। তবে ধারণা করা যায় যে অদূর ভবিষ্যতে ধান বা ভুট্টার মতো যখন ভালো মানের হাইব্রিড পেঁয়াজের বীজ সহজেই পাওয়া যাবে, তখন কৃষকরা বীজ থেকে কন্দ ও কন্দ থেকে পেঁয়াজ উৎপাদন আস্তে আস্তে বন্ধ করে দেবে। এর ফলে পেঁয়াজ চাষ করার জন্য ২৫ শতাংশ জমি বেশি পাওয়া যাবে, যা বর্তমানে কন্দ ও বীজ উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

চাষাবাদ পদ্ধতি
চাষাবাদের পদ্ধতি এবং বীজের গুণমানের কারণেও একর প্রতি উৎপাদনে পরিমাণগত পার্থক্য হয়ে থাকে। ব্রহ্মপুত্র নদীর দুই পাশে আমদানিকৃত বীজ ছিটিয়ে চাষ করা হয়। এ পদ্ধতির চাষাবাদে উৎপাদনের পরিমাণ রোপণ পদ্ধতির চেয়ে কম হয়। এসব পেঁয়াজের মান ভিন্ন এবং সর্Ÿোচ্চ ৬ থেকে ৮ সপ্তাহ পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।

বীজের মান ও বিভক্ত কন্দ
কৃষকের নিজস্ব বীজ দিয়ে উৎপাদিত পেঁয়াজের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ হয় বিভক্ত কন্দ। এই বিভক্ত কন্দের পরিমাণ প্রায় তিন থেকে চার লাখ টন, যা কখনোই পেঁয়াজ হিসেবে বাজারে আসে না। সাধারণত কৃষকরা নিজগৃহে এই কন্দ ব্যবহার করে অথবা কিয়দংশ নষ্ট হয়ে যায়।
অন্য দিকে কেবল ২০ শতাংশ জমিতে ভালো মানের বীজ বপন করে থাকে। এই জমিতে উৎপাদনের পরিমাণ তুলনামূলক বেশি। গড়ে একর প্রতি ৪ টনের পরিবর্তে ৫ থেকে ৬ টন উৎপাদিত হয়। তা ছাড়া উন্নতমানের বীজ দিয়ে উৎপাদিত পেঁয়াজে বিভক্ত কন্দের পরিমাণ কম। অতএব, প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে বিক্রয়যোগ্য পেঁয়াজের উৎপাদন ১৫ থেকে ১৬ লাখ টনের বেশি হয়নি।

পেঁয়াজ সংরক্ষণ
পেঁয়াজের ক্ষেত্রে অন্যতম একটি সমস্যা হচ্ছে কন্দে পানির পরিমাণ অনেক বেশি। জমি থেকে সংগ্রহ করায় সময় পেঁয়াজ বেশ ভেজা থাকে। যখন এগুলো কৃষকের বাড়িতে সংরক্ষিত অবস্থায় শুকাতে থাকে তখন ৫ থেকে ১০ শতাংশ ওজন কমে যায়। কৃষকের বাড়িতে যত বেশি দিন রাখা হয়, ততই ওজন কমতে থাকে এবং পেঁয়াজের ওপরের ছিলকার কয়েক স্তর শুকিয়ে পড়ে যায়। এ কারণেও পেঁয়াজের ওজন সামান্য কমে যায়। পাশাপাশি কৃষকের বাড়িতে সংরক্ষণকালে স্বল্প পরিমাণে পেঁয়াজ পচেও যায়।

অগ্রিম বৃষ্টি
আরেকটি বড় সমস্যা হলো ফসল তোলা হয় এপ্রিল-মে মাসে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আজকাল অগ্রিম বৃষ্টি নিয়মে পরিণত হয়েছে। বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা দেখা দিলে কৃষক পেঁয়াজ পরিপক্ব হওয়ার আগেই তুলে ফেলতে বাধ্য হয়। অন্যথায় কন্দের ভেতর পানি প্রবেশের আশঙ্কা থাকে। তাতে পেঁয়াজ সংরক্ষণের মেয়াদ কমে যায় ও তাড়াতাড়ি পচে যায়।
পরিশেষে সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, মানভেদে আলাদাকরণ এবং কৃষকের বাড়ি থেকে স্থানীয় বাজার, সেখান থেকে আড়তদার ও পাইকারি বাজার হয়ে খুচরা বিক্রেতা থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে নানা পর্যায়ে পরিবহনকালে নড়ানড়িতে কিছু পরিমাণে পেঁয়াজ নষ্ট হয়।
উপরি উক্ত সব বিষয় যেমনÑ চাষ পদ্ধতি, বীজের মান, পেঁয়াজ চাষের জন্য কন্দের ব্যবহার, বীজ উৎপাদনে কন্দের ব্যবহার, বিভক্ত কন্দ, সংরক্ষণকালীন সময়ে ওজন কমে যাওয়া, ওপরের ছিলকা শুকিয়ে যাওয়া, পচে যাওয়া, স্থানান্তরের সময় অপচয় ইত্যাদি বিষয়কে ধর্তব্যে আনলে বাংলাদেশের বর্তমান ৫ লাখ একর আবাদকৃত পেঁয়াজের জমিতে মোট উৎপাদন ও বাজারকৃত পেঁয়াজের হিসাব দাঁড়াবে নিম্নরূপÑ
কন্দ দ্বারা চাষকৃত ৬০০০০ একর জমিতে পেঁয়াজের উৎপাদন একরপ্রতি ৩.৫ টনের বেশি হবে না। অর্থাৎ ২১০০০০ টন উৎপাদনের হিসাব থেকে কমে যাবে। ৮০০ টন বীজ উৎপাদনে ৭০০০ একর জমি চাষ করা হয়। বীজের জন্য চাষকৃত জমিতে বিক্রয়যোগ্য পেঁয়াজ উৎপাদিত হয় না। অর্থাৎ আরো ৩০০০০ টন পরিসংখ্যান থেকে কমে যাবে। ১০ থেকে ১২ শতাংশ জমিতে বীজ ছিটিয়ে চাষ করা হয়। এই জমিতে পেঁয়াজের ফলন কম, মান ভালো নয় এবং সংরক্ষণ করা যায় না। এগুলোর তোলার সাথে সাথেই বিক্রি করে দিতে হয়।
অতএব, মুড়িকাটা পদ্ধতিতে চাষের জন্য কন্দের ব্যবহার, ছিটানো পদ্ধতিতে চাষের জমিতে কম উৎপাদন, বীজ উৎপাদনের জন্য জমির আবাদ যা থেকে পেঁয়াজ উৎপাদন হয় না এবং বীজ উৎপাদনে কন্দের ব্যবহার ইত্যাদি সব যদি একত্রে হিসেবে আনা হয় তাহলে দেখা যায়, মাত্র চার লাখ একর জমিতে বিক্রয়যোগ্য পেঁয়াজের চাষ করা হয়। এর সাথে যোগ হবে বীজের গুণগতমানের নিরিখে বিভক্ত কন্দ, যেগুলো বাজারজাতকৃত পেঁয়াজ থেকে বাদ যাবে। এসব একত্রে হিসেবে আনলে বাংলাদেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের পরিমাণ ১৩ লাখ টনের বেশি হবে না।
উপরি উক্ত কারণগুলোর কারণেই হয়তো বাংলাদেশে পেঁয়াজ উৎপাদনে বিবিএস ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উৎপাদনের হিসাবে পার্থক্য দেখা যায়। তবে সমস্যাটি হচ্ছে বাস্তবসম্মত উৎপাদন, সরবরাহ ও চাহিদার পরিসংখ্যান। জানা না থাকলে বাজারের চাহিদা মেটাতে সময়োপযোগী আমদানি করা বেশ কঠিন। অবাস্তব পরিসংখ্যান সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়তা না করে এক ধরনের বাধা সৃষ্টি করে, যা বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। অপর দিকে অস্থিরতা মানেই দাম কম বা বেশি।

হিমাগার
অনেকের ধারণা, হিমাগার তৈরি করে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা হলে এক দিকে পেঁয়াজ পচে যাবে না, অন্য দিকে চাষিরা পেঁয়াজ উত্তোলনের সময় বিক্রি না করে, সারা বছর ধরে তা বেশি লাভে বিক্রি করতে পারবেন। পেঁয়াজে উচ্চমাত্রায় পানি থাকার কারণে বাস্তবে তা সম্ভব নয়। ভারত, মিয়ানমার ও পাকিস্তানে বিভিন্ন ধরনের কৃষি পরিবেশগত অঞ্চল এবং পর্বত প্রায় উঁচু ও সমতল ভূমি রয়েছে। এ কারণে ওইসব দেশের কৃষক বছরজুড়ে কোনো-না-কোনো স্থানে পেঁয়াজ উৎপাদন করতে পারেন। বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে চাহিদা মেটানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে উচ্চ ফলনশীল ও ভোক্তার পছন্দযায়ী সঠিক জাতের পেঁয়াজ উৎপাদন, যা স্বাভাবিক তাপমাত্রায় কৃষকের বাড়িতে ৮ থেকে ১০ মাস পর্যন্ত রাখা যায়। মাত্র বোরো মৌসুম পেঁয়াজ উৎপাদনে উপযুক্ত বিধায় সাধারণ তাপমাত্রায় ৮ থেকে ১০ মাস সংরক্ষণের উপযোগী জাত বাংলাদেশের জন্য জরুরি বিষয়।
ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পেঁয়াজ সাধারণত সবজি হিসেবে বিবেচিত। অপর দিকে বাংলাদেশে পেঁয়াজ প্রধানত মসলা হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশী ভোক্তাদের কাছে সোনালি রঙের ও তীব্র ঝাঁজসমৃদ্ধ (প্রতি গ্রামে ১৭-১৮ মুমো) পেঁয়াজ পছন্দনীয়। আমদানি করা পেঁয়াজের এ স্তরের ঝাঁজ নেই। ভোক্তার পছন্দ অনুযায়ী বাজারে পেঁঁয়াজের দাম নির্ধারিত হয়। সাধারণত বাজারে পেঁঁয়াজের দুই ধরনের দাম থাকেÑ স্থানীয় পেঁয়াজের দাম সব সময় আমদানিকৃত পেঁয়াজের চেয়ে বেশি থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, বর্তমানে (অক্টোবরে) বাজারে দেশী পেঁয়াজের দাম প্রতি কেজি ২০০ টাকা। অপর দিকে আমদানিকৃত পেঁয়াজের দাম প্রতি কেজি ১৬০ টাকা। অন্য দিকে ভোক্তার পছন্দ ছাড়াও কৃষকদের পছন্দ হচ্ছে কম পানিসমৃদ্ধ এবং ন্যূনতম ৮ থেকে ১০ মাস সংরক্ষণ করা যায়, তেমন জাতের পেঁয়াজ। স্থানীয় তাহেরপুরী জাতের পেঁয়াজে এসব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। তবে এই জাতের পেঁয়াজ আকারে ও ফলনে খুব কম।

উৎপাদনশীলতা
বাংলাদেশে ১৯৯৫ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত পেঁয়াজের আবাদি জমি ও মোট উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় একই জায়গায় স্থবির ছিল। এই সময়কালে গড়ে ৯০০০০ একর জমিতে পেঁয়াজ চাষ করা হতো এবং উৎপাদন হতো মাত্র ১৩০০০০ টন থেকে ১৪০০০০ টন। একরপ্রতি ফলন ১.৫ টন থেকে ১.৬ টন মাত্র।
২০০৪ সাল থেকে কিছুটা ভালো জাতের তাহেরপুরী বীজ পাওয়া গেলে আবাদের পরিমাণ ও একর প্রতি ফলন বেড়ে যায়। ২০০৯ সাল পর্যন্ত পেঁয়াজের আবাদ প্রায় ৩০০ শতাংশ বেড়ে ৯০০০০ একর থেকে ২৭০০০০ একরে উন্নীত হয়। অন্য দিকে একই সময় উৎপাদন বেড়েছে ৫০০ শতাংশ। মোট উৎপাদন ১৫০০০০ টন থেকে বছরে ৭৫০০০০ টনে উন্নীত হয়। পাশাপাাশি এই ছয় বছরে একরপ্রতি ফলন ১০ শতাংশ বেড়ে ১.৬০ টন থেকে প্রতি একরে ২.৯৯ টনে উঠে আসে।
২০০৯ সাল থেকে কৃষকের হাতে তাহেরপুরী জাতের আরো উন্নত বীজ আসে। ফলে প্রতি একরে ফলন আরো বৃদ্ধি পায়। চাষিরাও দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে পেঁয়াজের উৎপাদন বৃদ্ধি করেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০০৯ সালে পেঁয়াজ আবাদ করা হয়েছিল ২৭০০০০ একর জমিতে, যা ২০১৮ সালে ১৮৫ শতাংশ বেড়ে ৫০০০০০ একরে দাঁড়ায়। এ সময় পেঁয়াজ উৎপাদন ৯০০০০০ টন থেকে ২০৫ শতাংশ বেড়ে ১৮৩০০০০ টনে এসে দাঁড়ায়। উপরি উক্ত সময়ে একরপ্রতি গড় ফলন ২.৯৯ টন থেকে বছর প্রতি ৫ শতাংশ বেড়ে প্রতি একরে ৪.০৯ টনে উঠে আসে। উন্নতমানের বীজ ব্যবহারে ফলন বেশি হওয়ায় কৃষকরা লাভবান হন ও পেঁয়াজের আবাদ বাড়িয়ে দেন। তবে ২০১৮ সাল থেকে পেঁয়াজের আবাদ ও একরপ্রতি ফলন কমে যাওয়ার একটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
২০১৯ সাল থেকে তাহেরপুরী জাতের উচ্চফলনশীল হাইব্রিড বীজ পাওয়া যাচ্ছে। আবাদি জমির পরিমাণ না বাড়ালেও উচ্চফলনশীল জাতের এ পেঁয়াজ রোপণ করা হলে একরপ্রতি ফলন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে বলে আশা করা যায়। এর ফলে দেশে পেঁয়াজের একরপ্রতি ফলন ও মোট উৎপাদন যথেষ্ট পরিমাণে বেড়ে যাবে। হ [চলবে]
লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ, সাবেক সভাপতি, এফবিসিসিআই

 


আরো সংবাদ



premium cement

সকল