২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ব্যঞ্জনে প্রয়োজন নতুন ব্যঞ্জনা

বৃত্তের বাইরে
-

বাঙালিমাত্রই রসনাবিলাসী। রসনা তৃপ্তির হাতিয়ার ব্যঞ্জন। মানে রান্না করা তরকারি। স্বাদের ব্যঞ্জন রান্না করতে বাঙালি কুলবধূরা আবহমানকাল থেকে প্রচুর মসলা ব্যবহার করে আসছেন। আর যাবতীয় মসলার মধ্যে পেঁয়াজের কদর আকাশছোঁয়া। বেশি বেশি পেঁয়াজ দিয়ে সালুন রান্নায় বাঙালি নারীদের ঝোঁক লক্ষণীয় মাত্রায় বিদ্যমান। তবে গত ২৯ সেপ্টেম্বর পড়শি দেশ ভারত বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতারি বন্ধের ঘোষণা দেয়ায় দর একলাফে কেজিপ্রতি ৩০ টাকা বেড়ে যায়। ক্রিকেটীয় ভাষায় বললে বলতে হয়, গত রোববার ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে দাম হয় কেজিপ্রতি ২৫০-২৬০ টাকা। পেঁয়াজ সঙ্কটে গৃহিণীরা পড়েছেন বিপাকে। প্রতিটি রান্নাঘরে হাহাকার রব উঠেছে। রন্ধনশিল্পীদের মুখে কালো মেঘের আছর পড়েছে।
পেঁয়াজের প্রতি গৃহিণী আর রসনাবিলাসীদের এত পক্ষপাতিত্বের কারণ এর বিশেষ স্বাদ। এ ছাড়া ঝোল তৈরিতে বিশেষত্ব। রান্নার সময় গোশত কিংবা মাছে পেঁয়াজের রস মিশে যে স্বাদ হয়, তাতেই পেঁয়াজের এত কদর। পেঁয়াজের দাম ঊর্ধ্বমুখী নয়, সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে প্রায়। কেজিপ্রতি ২৫০-২৬০ টাকা হওয়ার পর অনেক পরিবারই পেঁয়াজের ব্যবহার অনেক কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। পেঁয়াজ ছাড়া রান্নার কথা বাঙালিরা চিন্তাও করতে পারেন না। বিশেষভাবে গোশত ও মাছ রান্নায় আদা, রসুন হয়তো বাদ দেয়া চলে; কিন্তু পেঁয়াজ থাকতেই হবে। এটি আমাদের খাদ্যসংস্কৃতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ব্যবহারের ফলে বিশেষ গোলাকৃতির এ সবজিটি বাঙালির রান্নায় একটি বাধ্যতামূলক উপাদানে পরিণত হয়েছে।
তরকারিতে পেঁয়াজ ব্যবহার করা হয়নি, এটি বলে না দিলে কেউ সহজে টের পাবেন না। কিন্তু যে মুহূর্তে জানা যায়, রান্নায় পেঁয়াজ ব্যবহার করা হয়নি, তখন আর তরকারিটি আগের মতো মজা লাগবে না। বাঙালিরা ঐতিহ্যগতভাবে যেসব রান্না জানেন, তাতে বড় কোনো ধরনের পরিবর্তন মেনে নিতে চান না। বাঙালির রসুইখানায় পেঁয়াজের সগৌরব উপস্থিতি কত দিন থাকবে তা বলা মুশকিল। গোশতের তরকারির ঘন ঝোল তৈরিতে পেঁয়াজের বদলে আলুর পেস্ট, কালো জিরা, পাঁচফোড়ন, সরষে বাটা কিংবা পোস্তবাটার ব্যবহারে আগ্রহী হবেন, এমন লোকের সংখ্যা কমই। পরিবর্তনটা হয়তো ঘটবে খুবই ধীরে। কয়েক জেনারেশন ধরে এটি ঘটতে পারে। পেঁয়াজের দাম আগেও বেড়েছে। তখন রান্নায় পেঁয়াজ ব্যবহার কমানো হতো। কিন্তু একেবারে বন্ধ করে দেয়া হতো না কখনই। আর সে কারণে বোধহয় বাঙালির রসুইখানায় পেঁয়াজের দাপট টিকে থাকবে দীর্ঘ দিন।
রান্নার অনুষঙ্গ হিসেবে আমাদের দেশে পেঁয়াজের বেশ কদর। তবে শুধু রান্না নয়, কাঁচা বা সালাদ হিসেবেও পেঁয়াজ খেতে বেশ স্বাদের। ভর্তা বা আচার সুস্বাদু করতেও ব্যবহার করা হয় পেঁয়াজ। পেঁয়াজ আমাদের নিত্যদিনের খাবারের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলেও এর সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা অনেকেরই নেই। পেঁয়াজ সম্পর্কে কিছু চমকপ্রদ তথ্য দেয়া যায়Ñ এটি সবজি ভাবা হলেও আসলে একটি মসলাজাতীয় উদ্ভিদ। এর বৈজ্ঞানিক নাম এলিয়াম সোপা। পেঁয়াজ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই উৎপাদিত হয়। তবে সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হয় ভারত ও চীনে। বাংলাদেশে শীতপ্রবণ অঞ্চলগুলোতে পেঁয়াজ বেশি জন্মায়। এলিসিনের মাত্রা বেশি হওয়ায় বাংলাদেশের পেঁয়াজ ঝাঁজাল হয় বেশি। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। পেঁয়াজের মূল উপাদান পানি, কার্বোহাইড্রেট ও ফাইবার। তবে পেঁয়াজে পানির পরিমাণ সবচেয়ে বেশিÑ প্রায় ৮৫ শতাংশ। এ ছাড়াও পুষ্টিগুণ বলতে গেলে, ভিটামিন- সি, বি ও পটাশিয়াম থাকে। ডায়েটারি ফাইবার থাকে প্রচুর পরিমাণে, যা প্রায় ১২ শতাংশ। পেঁয়াজের মধ্যে কোনো ফ্যাট নেই। রান্নায় পেঁয়াজের সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে, এটি রান্নার অন্যান্য উপকরণের স্বাদ অনেক বেশি বাড়িয়ে দেয়। পেঁয়াজে যেহেতু সালফার উপাদান থাকে, তাই এটি রান্নায় এক ধরনের ঝাঁজাল স্বাদ যোগ করে। খোলা রান্না করলে বা কেটে খোলা রাখলে পেঁয়াজের খাদ্যগুণ নষ্ট হয় না। তবে সালফার কম্পোনেন্ট কমে আসে। রান্নার পর খোলা অবস্থায় রাখলে কোনো সমস্যা হয় না। পুষ্টিবিদরা বলেন, বেশিক্ষণ ধরে রান্না করা হলে ভিটামিন ও পটাশিয়াম কমে আসতে পারে। এ ছাড়া বাকি সব খাদ্য উপাদান নষ্ট হয় না। পেঁয়াজের ভলাটাইল কম্পাউন্ড যা এলিসিন নামে পরিচিত, এটি পেঁয়াজের ঝাঁজের জন্য দায়ী। আর কাটার সময় এটি চোখে লাগে বলেই চোখ জ্বালাপোড়া করে এবং পানি পড়ে। ঐতিহাসিকভাবে পেঁয়াজের রয়েছে ঔষধি ব্যবহার। প্রাচীন আমলে কলেরা এবং প্লেগের প্রতিরোধক হিসেবে ব্যবহার করা হতো পেঁয়াজ। এলিসিন হলো অ্যান্টি-ফাঙ্গাল এবং অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান।
বাঙালির পেঁয়াজপ্রীতির কারণ যেমন ব্যাখ্যাতীত, তেমনি পেঁয়াজের ইতিহাসও কুয়াশার চাদরে ঢাকা। উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে ইরান, পশ্চিম কিংবা মধ্য এশিয়া পেঁয়াজের উৎপত্তিস্থল। এর ব্যবহার যে প্রাচীন তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। খ্রিষ্টের জন্মের ৫০০০ বছর আগে চীনে এর ব্যবহার ছিল। প্রাচীন মিসরেও রাজার দেহ মমি করার আগে চোখের কোটরে পেঁয়াজের বিচি ঢুকিয়ে দেয়া হতো বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। পেঁয়াজের উপকারিতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ভেষজশাস্ত্রে পেঁয়াজের গুণগান করা হয়েছে। এটি পৌরুষত্ব বাড়াতে পারে বলে এর নানা রকম ঔষধি ব্যবহার রয়েছে। দেহ শীতল রাখার স্বার্থে সনাতন ধর্মাবলম্বী বিধবাদের পেঁয়াজ-রসুন পরিহার করার উপদেশ দেয়া হয়েছে।
তবে এত কিছুর পরও পেঁয়াজ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন উইলিয়াম শেক্সপিয়ারও। ৪০০ বছরেরও বেশি আগে ‘আ মিডসামার নাইটস’ নাটকে তিনি ঠিকই পেঁয়াজ না খেতে উপদেশ দিয়েছিলেন। শেক্সপিয়ারের সেই উপদেশ শুনলে আজ আর হয়তো পেঁয়াজের দরদাম নিয়ে নাকাল হতে হতো না আমাদের। পেঁয়াজের ঝাঁজের চেয়ে এখন বাজারের ঝাঁজ নিয়েই আলোচনা বেশি। এ সুযোগে অনেকেই পেঁয়াজ ছাড়া রান্নার রেসিপি খুঁজছেন, রান্নাবান্নায় পারদর্শী ব্যক্তিরা সামাজিক মাধ্যমে পেঁয়াজবিহীন রান্নার রেসিপিও দিতে শুরু করেছেন। বেশ কিছু তরকারি রান্নায় পেঁয়াজ ব্যবহার না করে কিন্তু তার স্বাদ কোনো অংশেই কম হয় না বলে রন্ধনশিল্পীরা বলছেন। যেমন, বালতি গোশতÑ এ কারিটি পেঁয়াজ ব্যবহার না করেই তৈরি করা যায়।
রন্ধনশৈলী পটীয়সীরা বলছেন, আমাদের দেশে পেঁয়াজ ছাড়া রান্নার কথা চিন্তাই করা যায় না। অথচ পেঁয়াজ ছাড়াও রান্না সুস্বাদু হতে পারে, যদি সেই কৌশল জানা থাকে। তারা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে পেঁয়াজের লাগামছাড়া দাম দেখে হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। সেক্ষেত্রে প্রয়োজন পেঁয়াজবিহীন রান্নার সঠিক কৌশলটি জেনে নেয়া। পেঁয়াজের বিকল্প কী হতে পারে, রসুনের ব্যবহারের দিকে একটু জোর দেয়া। গরম তেলে রসুন ও শুকনো মরিচের ফোড়ন দারুণ সুবাস তৈরি করে। ডাল কিংবা বিভিন্ন ধরনের ভাজি এভাবে রান্না করা যাবে। পেঁয়াজের বদলে ¯িপ্রং অনিয়ন কিংবা পেঁয়াজকলি রান্নায় ব্যবহার করলে তরকারিতে পেঁয়াজের স্বাদ ও গন্ধ পাওয়া যাবে। সয়াবিন তেলে রান্না না করে অলিভ অয়েল ব্যবহার করতে পারেন। এ তেল খাবারের স্বাদ বাড়াবে। পেঁয়াজের বদলে বেল পেপার কিংবা ক্যাপসিকাম ব্যবহার করতে পারেন। ক্যাপসিকাম খাবারের স্বাদ বাড়ায়। ভাজি, মাছ বা গোশতের ঝোলে ক্যাপসিকামের ঝাঁজাল স্বাদ ও গন্ধ কিন্তু দারুণ। গোশত কিংবা মাছের ঝোল ঘন করতে পেঁয়াজের বদলে পরিমাণমতো পেঁপে বাটা ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে মাছ-গোশতের আঁশটে গন্ধ দূর হবে ও ঝোলও ঘন হবে। রান্নায় টমেটো বাটার ব্যবহার খুব সহজেই যেকোনো খাবার সুস্বাদু করে তুলতে পারে। যেকোনো ধরনের খাবার রান্নাতেই টমেটো মানিয়ে যায়। যদিও পেঁয়াজ আমাদের বিপুল জনগোষ্ঠীর অবিচ্ছেদ্য সংস্কৃতির অংশ। তবু পকেটের কথাও তো ভাবতে হবে। কথায় আছে, প্রতিকূলতার মাঝেও টিকে থাকার যুৎসই কৌশল উদ্ভাবন করা। যাতে অস্তিত্ব বিপন্ন না হয়। যোগ্যরাই টিকে থাকে। ফলে আমাদেরও রান্নার উপকরণ, উপাদান, কৌশল, রান্নার আইটেম ও স্বাদের নিজস্বতা অক্ষুণœ রেখে ব্যঞ্জনে আনতে হবে নতুন ব্যঞ্জনা। হ
camirhamza@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement