২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

অহমিকা ও জেদ ধ্বংস ডেকে আনে

-

আমার বাড়ি সান্তাহার রেলওয়ে জংশনের সন্নিকটে হওয়ায় স্কুল জীবন থেকে মওলানা ভাসানী, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, শেখ মুজিবসহ অনেক বড় বড় নেতা ও ব্যক্তির সাথে মেশার এবং তাদের নিকটবর্তী হওয়ার সুযোগ পাই। সান্তাহার রেলওয়ে জংশন বগুড়া জেলার আদমদীঘি থানার অন্তর্ভুক্ত একটি রেলওয়ে জংশন। পঞ্চাশের দশকে দেশে সড়ক যোগাযোগ ছিল না বললেই চলে। রেলপথ ও নৌপথই ছিল আন্তঃজেলার সাথে একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম।
মওলানা আবদুুল হামিদ খান ভাসানী (হুজুর) তখন বেশির ভাগ সময় বাস করতেন তার স্ত্রী আলেমা ভাসানীর বাপের বাড়ি পাঁচবিবি বড্রগেজ রেলপথ স্টেশনের নিকটবর্তী বীরনগর গ্রামে যা স্টেশন থেকে চার মাইল মেঠোপথে। ঢাকা থেকে বাহাদুরাবাদ ঘাট হয়ে নৌপথে রেলওয়ে ফেরি দিয়ে যমুনা নদী অতিক্রম করে ফুলছড়ি ঘাটে এসে মিটার গেজ রেলে বোনারপাড়া স্টেশন হয়ে, সান্তাহার এসে প্রায় দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর পার্বতীপুরগামী ট্রেনে করে পাঁচবিবি স্টেশনে নেমে হেঁটে অথবা গরুর গাড়ি করে বীরনগর পৌঁছতে হতো। হুজুর উচ্চ রক্তচাপের রোগী হওয়ায় তাকে আমি প্রথম শ্রেণীর বিশ্রামাগারে নিয়ে সেবা শুশ্রƒষা করতাম এবং অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন, থ্রি-স্টার হোটেলের মতো রেস্টুরেন্ট নিয়ে খাবার খাইয়ে পাঁচবিবিগামী ট্রেনে উঠিয়ে দিতাম। অনেক সময় তার তাগাদায় হুজুরের সাথে বীরনগর গ্রামেও যেতাম। সেটা ১৯৪৮-৪৯ সালের কথা, তখন আমি অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। এমনিভাবে অনেক বড় বড় রাজনৈতিক নেতার সেবা করার এবং ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ আমার ঘটেছে। হুজুর আমাকে তার ছেলে বাবুর মতো ছেলে হিসেবে গণ্য করতেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ার সময় ১৯৫৬-৫৯ সালে দৈনিক প্রায় পাঁচ-ছয় ঘণ্টা হুজুরের সাথে থাকতাম। আমার পাঞ্জাবির পকেটে আলাপাতা ও চুনের ডিব্বা থাকত। ইশারা করলেই তার হাতে দিতাম। ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে ন্যাপ গঠন করার পর তার সাথে পশ্চিম পাকিস্তান সফর করেছি। সেই সুবাদে মওলানার ‘লাড়কা’ বা পিএস হিসেবে ‘সিন্ধুগান্ধী’ আবদুল মজিদ সিন্ধি, ‘সীমান্ত গান্ধী’ খান আবদুল গাফ্ফার খান, পাঞ্জাবের নেতা মিয়া ইফতিখার উদ্দিন, বিশিষ্ট আইনজীবী মাহমুদ আলী কাসুরী প্রমুখ নেতার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে আমাদের সান্তাহারের বাসা ছিল উত্তরবঙ্গে প্রচারের প্রাণকেন্দ্র। ১৯৬২ সালে লন্ডনে যাই ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য। সেখানে অনেক ‘সিলেটি’ কল্যাণ সংস্থার সাথে পরিচয় হলো। তাদের ইমিগ্রেশন সমস্যা, পাউন্ড ঢাকায় সরাসরি পাঠানোর সমস্যা, বাসাবাড়ি সমস্যা ইত্যাদি কাজে জড়িত হয়ে পড়ি। উল্লেখ্য, লন্ডনে স্থাপিত ও তদানীন্তন ছাত্র সংস্থা পাকিস্তান স্টুডেন্টস ফেডারেশনের (পিএসএফ) সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হই এবং ১৯৬৬-৬৭ সালে এর সভাপতি নির্বাচিত হই। আমার আগে পিএসএফের প্রধান ছিলেনÑ যথাক্রমে ব্যারিস্টার এম আমির-উল ইসলাম (১৯৬২-৬৩), ব্যারিস্টার মাহমুদুর রহমান (১৯৬৩-৬৪), ব্যারিস্টার আবদুল সালাম তালুকদার (১৯৬৪-৬৫), ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত (১৯৬৫-৬৬) এবং সরফুল ইসলাম খান (১৯৬৬-৬৭)। আমার সময়টা ছিল ঘটনাবহুল আইয়ুব মোনায়েম খানের শাসন কাল।
ঢাকায় যখন কোনো প্রতিবাদ সভা করা যেত না, যখন কোনো সমাবেশ মিছিল করা যেত নাÑ তখন আমরা পিএসএফের তরফ থেকে অনেক সভা-সমাবেশ করেছি। ফলে ১৫ নং চেশাম প্লেসে অবস্থিত পিএসএফ অফিসে লন্ডনের পাকিস্তানের হাইকমিশনার আগা হিলালির নির্দেশে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়। এর গুঞ্জন চলাকালে অফিসের সাইক্লোস্টাইল মেশিন আমরা গোপনে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের গাড়িতে করে নিয়ে যাই এবং সেখান থেকেই আইয়ুব মোনায়েম খানের অপশাসনের প্রতিবাদ জানাই।
১৯৬৬ সালের অক্টোবর/নভেম্বর মাসে হাইকমিশনার আগা হিলালি ফোন করে জানান যেÑ Mr. Z. A. Bhutto, the ousted Foreign Minister, is in London. you may arrange a public meeting for him ভুট্টোর লন্ডনের ফোন নম্বর না দিয়ে শুধু সাবেক রাষ্ট্রদূত জে এ রহিম সাহেবের প্যারিসের একটা ফোন নম্বর দিলেন। জে এ রহিম (যিনি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ভায়রাভাই) অনেক প্রশ্নের পর ভুট্টোর লন্ডনের একটি নম্বর দিলেন। জানাশোনা পরিচয় কিছুই নেই তার সাথে। পিএসএফের প্রেসিডেন্ট আমি এটা শুনেই তিনি লাফিয়ে উঠে বললেন, আসো, আমরা সামনাসামনি কথা বলব।’ তার গোপন ‘আখড়া’য় গেলাম। ভুট্টো আগে থেকেই জানতেন, পিএসএফ একটি প্রতিবাদমুখী ও আয়ুববিরোধী সংস্থা। খুব ভয়ে ভয়ে কথা বলছিলেন। আইয়ুবের ছেলে গওহর আইয়ুব নাকি তাকে হত্যার করার জন্য একটি স্কোয়াড তৈরি করেছে। তার প্রবল ইচ্ছা লন্ডনে একটি জনসভায় আয়ুববিরোধী ক্ষোভ প্রকাশ, পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা বর্ণনা করার এবং নিজের সাফাই গাওয়ার। অনেক কথা ইংরেজিতে ও উর্দুতে হলো, কত লোক হবে, কোথায় সভা হবে, তিন দিনের মধ্যে কি করে জনাকীর্ণ সভার ব্যবস্থা করব, এসব নিয়ে। যখন দৃঢ়তার সাথে বললাম, Holborn Conway Hall এ সভা হবে এবং হাজার হাজার কাশ্মিরি ও পাকিস্তানি সারা ব্রিটেন থেকে আসবে, তখন তিনি উৎসাহবোধ করে সম্মতি দিলেন। নির্দিষ্ট দিন, তারিখ ও সময়ে হাজার হাজার লোকের সমাবেশে প্রায় দেড় ঘণ্টা বক্তৃতা করলেন। তখন থেকে আমার ওপর তার খুব আস্থা ও বিশ্বাস জন্মে যায়। পরে একপর্যায়ে জাতিসঙ্ঘে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে এবং আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতিবাদ ও গালাগালি করে লম্বা বক্তৃতা দেয়ার পর দেশে ফেরার সময় লন্ডনে এসে আমার সাথে যোগাযোগ করেন। অনেক তর্ক-বিতর্ক হলো। শুধু তার ইগোর একটি বাক্য দিয়ে বলতে চাই যে, তার ইগো বা অহংবোধ, স্বার্থপরতা, অদূরদর্শিতা, অগভীর চিন্তা, ক্ষমতার লোভ, অহঙ্কার ও শেখ মুজিবকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ফল হচ্ছে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। প্রায় ১০-১২ মিনিট এক নিঃশ্বাসে বিড়বিড় করেই তিনি বলেছেনÑ Dog drinker Yahya, ambitious Gauhar Ayub, Punjabi clique, Mujib did not keep his word, আমি এসব শুনে যাচ্ছিÑ কথা না বলায় তিনি বলেন, সরফ, খামুশ কিঁউ হো- কুছতো কহো, Accse me, charge me। তখন আমি বললাম If you would have sat on the left side of the Speaker for a few months, Pakistan would have been saved. পাঁচ-ছয় সেকেন্ড চুপ থাকার পর তার হাত থেকে ছোট্ট গ্লাসটি মাটিতে পড়ে যায়। বললেন, ‘কিয়া ইয়ার, ম্যায় ও জাহিলকো Prime Minister মানে?’। কিন্তু তার এই ইগোতেই বাংলাদেশের জন্ম এবং ইগোর জন্য তাকে অস্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয় পরবর্তীকালে।
ইগোর পরিণতি ভালো হয় না। প্রায় সব ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ইগো বা অহঙ্কার ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে এবং তার পরিণতিতে দল, দেশ, জাতি, রাষ্ট্র ধ্বংসের দিকে ধাবিত হতে পারে। এক ভুট্টোর ইগোর পরিনামে তিনটি রাষ্ট্রে এক ভয়াবহ টানাপড়েন শুরু হয়েছে। কিন্তু তখন ছিল বন্দুকযুদ্ধ মাত্র। কিন্তুএখন ঘরে ঘরে আণবিক অস্ত্র মওজুদ আছে এবং তৈরি হচ্ছে। এখন তো বোতাম টেপার যুগ। বিশ্বে বিভিন্ন রাষ্ট্রে ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক অবরোধ এবং ক্ষমতাধরদের মধ্যে কে শীর্ষে, কে শ্রেষ্ঠ, কে প্রথম এ নিয়ে প্রতিযোগিতা এ দিকে প্রায়ই নিউজ হেডলাইন এ দিকে হচ্ছে: পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ, ইরান-যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ, চীন-ভারত যুদ্ধ, সৌদি-হুতি যুদ্ধ, ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ কি আসন্ন? এই ইগোর দরুন ধৈর্যহারা হয়ে কে কখন তাদের বাটনে প্রথম চাপ দেবে, তা নিয়ে বিশ্ব আতঙ্কিত। আবার এশিয়ার ব্যাপারে অনেক বিশেষজ্ঞ মাত্রচিত্র বদলের কথা প্রকাশ্যে বলছেন। অতএব, সাধু
সাবধান! হ
লেখক : সিনিয়র আইজীবী, সুপ্রিম কোর্ট, বাংলাদেশ


আরো সংবাদ



premium cement