১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পাকিস্তানের রাজনৈতিক ধাঁধা

-

পাকিস্তানের রাজনীতিতে যেন ‘বিনা মেঘে বৃষ্টি’ আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু সম্ভবত সেখানে এসে যাচ্ছে একেবারে ঘূর্ণিঝড়, যাতে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যেতে পারে। ফলে অদ্ভুত বৈপরীত্য দেখা দিয়েছে। যেমন অসময়ে কিলিয়েও কাঁঠাল পাকানো যায় না, এমনকি ফল পাকানোর ওষুধ দিয়েও না, সেই অবস্থা এটা। আসলে সব কাজে টাইমিং বা সময় একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর!
সীমাহীন অব্যবস্থাপনায় ডুবে থাকা পাকিস্তানের অর্থনীতি ও শাসনব্যবস্থাকে টেনে তুলতে আশার আলো দেখিয়ে সাবেক ক্রিকেটার প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ভূমিকা রাখতে শুরু করেছিলেন। এর মধ্যে কাশ্মিরে নরেন্দ্র মোদির শাসিত ভারত ‘দখলদার বাহিনী’ হিসেবে হাজির হওয়ায় এ ইস্যুতে আন্তর্জাতিক স্তরে কাশ্মিরের পক্ষে লড়ার জন্য দৃশ্যত এই প্রথম পাকিস্তান এমন এক নেতা পেয়েছে যিনি সৎ হিসেবে পরিচিত, আধুনিক রাষ্ট্রের অলিগলি চেনাজানা, উদ্যোগী নেতা। ইমরানের জাতিসঙ্ঘ-বক্তৃতার প্রশংসা করেনি বা তাকে স্পর্শ করেনি, এমন সংবেদনশীল মানুষ কমই পাওয়া যাবে এবার। আমরা ‘মুখের ওপর কঠিন সত্য ছুড়ে দেয়া’ বলি যেটাকে, ওই বক্তৃতা তেমন। তাই প্রতিপক্ষ ভারত এই বক্তৃতার বিরোধিতায় না গিয়ে পাশ কাটিয়ে ‘মোকাবেলা’ করার পথ ধরেছিল।
এক দিকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে তাদের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছাড়া আর কোনো জাতীয় নেতা ইমরানের পর্যায়ে পপুলার নন বলে তার ভক্তদের দাবি। অথচ আমেরিকার স্বার্থে ওয়ার অন টেররে ব্যবহৃত হতে হতে পাকিস্তান বলতে গেলে, নিজের জাতীয় স্বার্থ পূরণের অবস্থায় নেই। এই দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় রাজনীতিবিদরা ভেবেছিলেন, তাদের আর কী করার থাকতে পারে। আমেরিকার ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে তারা ভেবেছেন, দায়িত্ব পালন করা হয়ে গেছে। এ ছাড়া তাদের যেন কোনো কাজ-ভূমিকা নেই। আর তাতে স্বভাবতই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙে ছারখার। এই চরম হতাশার মাঝে গত বছর ‘আশা-ভরসার এক নেতা’ ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরানের উত্থান ঘটতে দেখেছিল পাকিস্তান। বলাই বাহুল্য, তারা কেউই আশা করেনি যে, ইমরানের হাতে কোনো চেরাগ আছে এবং সেটা ঘষা দিলে অথবা ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে ইমরান স্রেফ হাত বুলিয়ে দিয়েই সব কিছু আবার ঠিক করে ফেলবেন।
তারা এতটুকু অন্তত বুঝতে পারা ‘পাবলিক’। তাই আশা ছিল একজন ন্যূনতম সৎ লোক, যার বিদেশে চুরির অর্থ রাখার অ্যাকাউন্ট নেই, যিনি সৎভাবে ও ঈমানের সাথে নতুন নতুন উদ্যোগে আন্তরিক চেষ্টা করবেন অর্থনীতিকে পতিত অবস্থা থেকে উঠিয়ে আনার জন্য। এমনই আশার আলো দেখিয়ে উঠে এসেছিলেন ইমরান। পাকিস্তানের অর্থনীতি যত নিচে ডুবে ছিল এখনো তার রেশ কাটেনি। তাতে ইমরানের সরকার অনেক ইতিবাচক সিদ্ধান্ত ও সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিয়ে ফেললেও তার সুফল পেতে কিছুটা সময় লাগবে।
পাকিস্তান আসলে বিদেশী স্বার্থে দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহৃত হয়ে চলেছিল। আর এই সুযোগে দেশী শাসক-চোরদের হাতে লুটের শিকার হয়ে পাকিস্তান ফোকলা হয়ে গিয়েছিল। সরকার চালানোর মতো যে নগদ কিছু বৈদেশিক মুদ্রা লাগে, সে খরচের মাত্র তিন মাস ভার বইবার বা সরকার চালানোর মতো সক্ষমতাও সে দেশের ছিল নাÑ এমন অবস্থায় ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন হয়েছিল। আর তাতেই ইমরান খান নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। অবশ্য এই অভিযোগও ছিল এবং এখনো আছে যে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তাকে ক্ষমতা পেতে অন্যায় প্রভাব খাটিয়েছে। আবার এর পাল্টা সাফাইও অনেকে দেয় যে, সেনাবাহিনী ঠিকই বুঝেছিল এই ফোকলা হয়ে পড়া পাকিস্তানের অর্থনীতি ও জনজীবনকে টেনে তুলতে হলে নতুন মুখ ও নতুন উদ্যোগ লাগবেÑ এই বিবেচনায় তারা ইমরানকে অপেক্ষাকৃত যোগ্য লোক হিসেবে দেখেছিল। পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনী ‘হাত ঢুকিয়ে থাকা’Ñ এটা বহু পুরনো সত্য হলেও একমাত্র সত্য নয়। অন্তত আরো তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য হলোÑ এক. কোল্ড ওয়ারের জমানায় (১৯৫৩-৯১) আমেরিকা নিজ ব্লকের খুব কম রাষ্ট্রকেই সেনাসরকার ছাড়া চালাতে পেরেছিল। দুই. কাশ্মির ইস্যুর কারণে জন্ম থেকেই ছোট অর্থনীতির হলেও দক্ষ সেনা আর ব্যাপক খরচের সংস্থান করতে হয়, এমন দেশ হতে হয়েছে একে। তাতে বাহিনীর পেছনে সরকারি সমর্থন যে মাত্রায় দরকার, সেই প্রয়োজন নিজেরাই সরকারে থাকলে পাওয়া যাবে বলে সেনারা মনে করত। তাই রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা যাই হোক না, তাদের ব্যাপক অপব্যবহারের বড় বড় নেতিবাচক ভূমিকাই অনেক বেশি; আর তিন. বাস্তবতা হলো, ১৯৭৯ সালে ইরান বিপ্লব আর এর প্রতিক্রিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান দখলÑ আর তা থেকে শেষে মার্কিন বিদেশনীতিতে আমেরিকার স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থপূরণের প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান আর ‘নিজের জন্য’ থাকতে পারেনি; আমেরিকার এক হাতিয়ার হয়ে আছে পাকিস্তান।
তাই সব মিলিয়ে পাকিস্তানের বড় বড় ব্যর্থতা আর চরম হতাশার মধ্যেও এখন ইমরানই বেশি আশা-ভরসার প্রতীক। মনে হয়, ২০ বছর পরে পাকিস্তান এই প্রথম নিজের জন্য নিজে কিছু করার চেষ্টা করছে, পাকিস্তানের পাবলিক পারসেপশন এখন এটাই।
এরই মধ্যে এখন বৈপরীত্য হলো একটা নাম চার দিকে ছড়িয়ে পড়েছেÑ ‘মাওলানা ফজলুর রহমান’। অতীতে পাকিস্তানের ‘ইসলামী’ রাজনীতিকে কিছু কমন ইস্যুতে (জিয়াউল হকের আমল থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে) একটা জোটে সবাইকে আনার ক্ষেত্রে তার বড় ভূমিকা ছিল, এ কথা অনেকে বলে থাকেন। কিন্তু তাতে আসলেই ‘ইসলামী রাজনীতি’ কিছু এগিয়েছিল কি না অথবা ইসলামী নাম দিয়ে বসলেই তা ভালো কিছু হওয়ার গ্যারান্টি নয়, এমন বোঝার ক্ষেত্রে বহু কিছু বাকি থেকে যায়Ñ এ বিষয়গুলো পুনর্মূল্যায়ন করা বা ফিরে দেখা দরকার। পাকিস্তানে এখন যেসব রাজনীতিবিদ দুর্নীতির দায়ে জেলে অথবা দুর্নীতি করার অভিযোগে ‘দুর্নীতিবিরোধী ইসলামী আইনে’ ব্যাপক সংখ্যায় যারা গত নির্বাচনে দাঁড়ানোর ব্যাপারে, আদালতের রায়ে আনফিট হয়ে গেছিলেনÑ এসব ক্ষেত্রে তারা নিজেদের তৈরি ‘ইসলামী আইনে’ নিজেরাই ফেঁসে গেছেন, অস্পষ্ট আইন তাদেরই বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল। এসব আইন তৈরি করার ক্ষেত্রে ফজলুর রহমানসহ পাকিস্তানের ‘ইসলামী’ রাজনীতির নেতারা ভূমিকা রেখেছিলেন। নওয়াজ শরিফ বা ভুট্টোর দল পরবর্তীকালে তা সংশোধনের (সংসদীয় একটা কনস্টিটিউশনাল ভিউ কমিশন গঠিত হয়েছিল ২০১০ সালে ১৮তম সংশোধনী আনতে) সুযোগ পেয়েও নেয়নি; বরং নওয়াজের দল বাধা দিয়েছিল। অথচ পরবর্তী সময়ে এর প্রথম শিকার হয়েছিলেন নওয়াজ নিজেই। আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন, জিয়াউল হকের আমলের ৬২ ও ৬৩ ধারা, যা দাবি করেÑ জনপ্রতিনিধিকে ‘সাদিক’ বা সত্যবাদী ও ‘আমিন’ বা বিশ্বস্ত হতে হবে। অন্যথায় হাইকোর্টের বিচারক তাকে অযোগ্য ঘোষণা করতে পারবেন। আর গত নির্বাচনে পরোক্ষে সেনাবাহিনী এই আইন ব্যবহার করেই মুসলিম লিগ ও পিপলস পার্টির বহু (কমপক্ষে ৭০ জন) সম্ভাবনাময় প্রার্থীকে নির্বাচনে দাঁড়াতে দেয়নি, অর্থাৎ দৃশ্যত অযোগ্য করে দিয়েছিল। কাজেই কোনটা ইসলামী আইন আর সেটি কার জন্য অথবা কার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল এর এক ব্যাপক ও প্রকৃত মূল্যায়ন কি তারা এখন করবেন? এমন কোনো ইচ্ছার কথা আমরা শুনিনি।
এখন মাওলানা ‘ফজলুর রহমানের আন্দোলন’ হচ্ছে কেন? এর অর্থ ও তাৎপর্য কী? একটা অনুমান হলো, পাকিস্তান তার অর্থনীতি ও শাসনব্যবস্থার সঙ্কট থেকে বের হওয়ার পথ পেয়েছে; যদিও বের হয়ে যায়নি, এটা হতে সময় লাগবে। এই অর্থে ইমরানের সরকার কিছুটা থিতু হয়ে বসতে শুরু করেছে। কিন্তু মাওলানা ফজলুর রহমানসহ রাজনীতিক যারা বিরোধী দলে আছেন, বিশেষত যারা জেলে আছেন অথবা গত নির্বাচনে যারা অযোগ্য বিবেচিত হলে দাঁড়াতেই পারেননি বা পরাজিত হয়েছেনÑ তারা এখন খুবই খারাপ অবস্থায় আছেন। তারা নিজেদের জন্যও কিছু সুবিধার অর্থে কিছু আনুকূল্য ভাগ চাইছেন সরকারের কাছে। তবে বিরোধীরা যে খারাপ অবস্থায় আছেন, সেটা অবশ্য ইমরানের কৃতিত্ব নয়; বিরোধীদের নিজেদের ব্যর্থতা এটা। এরা সবাই পুনরায় বিরোধী রাজনীতিতে সক্রিয় তৎপর হতে চাইছেন। কিন্তু নিজ মুরোদে তা নিশ্চিত করতে পারছেন না। কিন্তু তারা একটা ‘তৃতীয় পক্ষ’ পেয়ে গেছেন এবং নিয়েছেন, যা তাদেরকে সরকারের সাথে দর কষাকষিতে সহায়তা করতে পারে।
লক্ষণীয়, মাওলানা ফজলুর রহমানকে সামনে রেখে নওয়াজ ও ভুট্টোর দল দুটো তার আন্দোলনকে বাইরে থেকেই সমর্থন দিয়েছে। অর্থাৎ এটা মূলত একা এই মাওলানার আন্দোলন। কোনো ‘ইসলামী রাজনীতির’ যে দায়দায়িত্ব, তাতে নওয়াজ-ভুট্টোরা নিজেকে জড়াচ্ছেন না। আর মূলত ফজলুর রহমানের প্রতিই সৌদি সরকারের সমর্থন। যুবরাজরা কেন তাকে সমর্থন করতে আগ্রহী?
এখনকার সৌদি আরবের বিরাট সঙ্কট কেবল রাজতন্ত্র টিকানো নয় অথবা ইরানি হুমকি থেকেই কেবল বাঁচানো নয়। বলা হচ্ছে, আগামী ২০ বছরের মধ্যে চলতি দুনিয়া আর ফসিল ফুয়েল বা মাটির নিচের তেল ব্যবহার করে চলতে পারবে না। বিকল্প ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে বিশ্ব চলে যাবে ধীরে ধীরে হলেও। বিদ্যুৎ বা ব্যাটারিচালিত যানবাহন আবিষ্কার বা চালুর পক্ষে ব্যাপক বিনিয়োগ দেখলে, এ ব্যাপারে কিছুটা অনুমান করা যেতে পারে। তাই সৌদি আরব এই পরিবর্তনের আগেই নিজের ব্যবসা-বিনিয়োগ সব কিছুকে আর তেল বিক্রিনির্ভর নয়, অন্যান্য ব্যবসা-বিনিয়োগের ওপর নির্ভরশীল করে নিতে চায়। এ লক্ষ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে পৌঁছতে চায় বলে দেশটা বিরাট কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। কিন্তু এটা খুবই ঝুঁকিবহুল সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা। প্রথম কারণ, এটা ‘বুড়ো বয়সে’ এসে শুরু করা হয়েছে। যেমন সৌদিদের চেয়ে দশ ভাগের এক ভাগেরও কম পুঁজি নিয়ে, আমিরাতের দুবাই একা অন্যান্য ব্যবসায় ঢুকে গেছে গত শতকেই। যেমনÑ ২০০০ সালে দুবাই এক নম্বর এয়ারলাইন্স কোম্পানি (এমিরেটস) আর বিরাট এয়ারপোর্ট (দুবাই) চালু করে ফেলেছে। এ দিকে সৌদিরা একালে এসে তা-ও বিদেশে বিনিয়োগ নিয়ে যেতে চাইছে। সৌদিরা এ বছর পাকিস্তানে ২০ বিলিয়ন আর ভারত প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ নিয়ে গেছে, যার বড় অংশ তেল শোধনাগারে। এ ছাড়া একটা বড় সমস্যা হলো তাদের ‘রাজাগিরি’ স্বভাবÑ ফিউডাল বা সামন্ততান্ত্রিক, বোকা রাজার স্বভাব; তাই সব কিছুকে খাশোগির ন্যায় টুকরা করে কেটে ফেলার মতো সহজ মনে করেÑ এর সম্ভাবনা কিন্তু সব সময়। কাজেই তাদের রাজত্ব টিকানোর ভয়ও সব সময়। এ কালে আধুনিক রাষ্ট্র অর্থ খরচ করে অন্য রাষ্ট্রের ওপর প্রভাব বাড়ানোর জন্য যাতে অন্তত ব্যবসা-বাণিজ্যে সুবিধা হয়। অভিযোগ, সৌদিরা অর্থ খরচ করে নিজের রাজত্ব টিকানোর জন্য। আর এক রাজতন্ত্রী কিন্তু ‘স্মার্ট’ ব্যবসায়ী হলো কাতার, যে ট্যাংকার-জাহাজে ভরে গ্যাস রফতানি আর অ্যালুমিনিয়াম নিজের খনি থেকে তুলে তা থেকে অন্তত ছয় ধরনের ফিনিশড প্রোডাক্ট উৎপাদন করে রফতানি করে এমন হাইটেক বিজনেস করে চলেছে। সৌদি আরব তাদেরকে হুমকি দিয়ে বসে। আর তাতে কাতার তুরস্কের সাথে চুক্তি করে তুর্কি সেনাবাহিনীর স্থায়ী ঘাঁটি গড়ে তুলেছে খোদ রাজধানী দোহায়। এতে কী লাভ হলো সৌদিদের? এটা কেন তারা আগে বোঝেননি? এর নিট ফলাফল হলো, শুধু ইরানই নয়; তুরস্কও সৌদি আরবের আর এক বড় প্রতিপক্ষ তৈরি করল।
রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের অর্থ না থাকুক; তবু অনেক দেশের চেয়ে পাকিস্তান অনেক বিকশিত ও উন্নত। দেশটা একটা মডার্ন রিপাবলিক। ন্যাটো সদস্য তুরস্কের সাথে পাকিস্তানের এখন প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত অস্ত্র বা উপকরণ বিনিময় বেচাবিক্রিতে সম্পর্ক গভীর। এ দিকে ইমরানের উদ্যোগের কারণে ইরান-পাকিস্তান অস্পষ্ট সম্পর্ক এখন ধোয়ামোছা করার ফলে খুবই ঘনিষ্ঠ। এর আগের প্রধানমন্ত্রীরা ভাবতেন কোনো কোনো রাজতান্ত্রিক দেশের ওপর নির্ভর করে থাকা আর ইরানকে খামাখা উপেক্ষায় ফেলে রাখা, এটাই একমাত্র কূটনীতি। ইমরান প্রমাণ করে দেখিয়েছেন, তিনি ২০ বিলিয়ন সৌদি বিনিয়োগও আনতে পারেন, তার অনুদানের কিছু মিলিয়ন ডলারও আনতে পারেন আবার যুবরাজ এমবিএসের বিশেষ বন্ধু হতে পারেন। তদুপরি, ইরানের সাথে সম্পর্কের জট খুলে তাদেরও ঘনিষ্ঠ হতে পারেন। শুধু তাই নয়, এমনকি ইরান-সৌদি বিরোধে মধ্যস্থতাকারী হওয়ার চেষ্টাও করতে পারেন। পাকিস্তানের পটেনশিয়াল কী ছিল তা কি এখন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী নওয়াজ শরিফ কিংবা অক্সফোর্ডের গ্র্যাজুয়েট বেনজিরের উত্তরসূরি দেখতে পাচ্ছেন?
এ কালের কূটনৈতিক সম্পর্কের ধরন আলাদা। এটা আর কোল্ড ওয়ারের যুগ নয়। এ কালে চীন-ভারত প্রচণ্ড বিদ্বেষপূর্ণ প্রতিযোগিতা করবে আবার একই সময়ে প্রচণ্ড সহযোগিতা করবে, স্থায়ী কিছু বোঝাবুঝির ভিত্তিও তৈরি করবে। সবই চলবে ইস্যুভিত্তিক, একেকটা ইস্যুতে একেক রকম কৌশল। দু’টি দেশের মধ্যে কোনো ইস্যুতে মারামারি, আবার কোনো ইস্যুতে সহযোগিতা।
খুবসম্ভবত যুবরাজের ধারণা, ইমরানের তুরস্ক ঘনিষ্ঠতাকে একটা ছেঁটে দেয়া বা সাইজ করার জন্য একটু চেষ্টা করা যাক। কোনো চাপ সৃষ্টির সুযোগ পাওয়া যায় কি না, চেষ্টা করে দেখা যাক। মাওলানা ফজলুর রহমানকে ‘ব্যাক’ করার ফলাফল এমনটাই হয়ে যেতে পারে। এতে যুবরাজকে ইমরানের পাল্টা যুক্তি হবে, আপনি তো আমার পাশাপাশি ভারতে বিনিয়োগ দিয়েছেন। আর দুবাইকে দিয়ে মোদির ‘কাশ্মির দখল’কে সমর্থন দেয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। এখন ইমরান যুবরাজ বা মাওলানার চাপ উপেক্ষা করে উঠে দাঁড়াতে পারেন কি না অথবা কতটা পারেন, সেটিই দেখার বিষয়। অবশ্য মাওলানা ফজলুর রহমানদের ‘হেরে যাওয়ার’ সম্ভাবনা বাড়ছে।
কারণ, প্রথমত ইমরানের বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠানোর জন্য এটা উপযুক্ত সময় নয়। না দেশের ভেতরে না আন্তর্জাতিক জগতে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমেরিকার তেমন কোনো অভিযোগ-অনুযোগ নেই। আবার জাতিসঙ্ঘে বক্তৃতা দিয়ে এখন ইমরান যেন ‘হিরো’। মুসলমানরা ও যারা সাধারণভাবে ন্যায়বিচারের দুনিয়ার পক্ষে, তারা সবাই ইমরান তাদের কথাই বলেছেন বলে মনে করছেন। এ ছাড়া, দেশের ভেতরে তিনি আশা-ভরসা ও ভালো দিনের প্রতীক। এই সময়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তোলা আর তা প্রতিষ্ঠা করা খুব কঠিন। বিশেষ করে যখন কোনটা ‘ইসলামী’ রাজনীতি বা স্বার্থ তা অস্পষ্ট।
সম্ভবত প্রকৃতিও বিরুদ্ধে। সমুদ্রে নিম্নচাপ ঘূর্ণিঝড় হিসেবে দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে রাস্তায় যেখানে আন্দোলনকারীরা ১ তারিখ থেকে বসে আছেন, তা বৃষ্টির পানিতে সয়লাব। ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানতে পারে। কর্মসূচি শেষ ঘোষণা করার আগেই এগিয়ে আসছে প্রকৃতির আক্রোশরূপী ‘বুলবুল’! হ
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement