২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভারতের একটি রাজনৈতিক পর্যালোচনা

-

সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে রাজনৈতিক উত্তেজনা চরমপর্যায়ে পৌঁছেছে। কাশ্মির ইস্যুকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনার পারদ প্রতিনিয়ত ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন দৃশ্যত সুস্থির হলেও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় কিছুটা অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে। উন্নয়নমুখী বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যয়ের খাতে আর্থিক অসঙ্গতি দৃষ্টিকটুভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে, রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য খাতে আর্থিক চরম অব্যবস্থাপনার কথা পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে। অন্যদিকে, ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় ক্ষেত্রে অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে। এ কথা সত্য, ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে দু’জন নেতার রাজনৈতিক প্রভাব বা জনপ্রিয়তা নজিরবিহীন বলে প্রতীয়মান। প্রথমত, মহাত্মা গান্ধী ভারতীয় রাজনীতিতে সর্বোচ্চ নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত। মূলত তিনি জাত, বর্ণ ও ধর্মীয় বৈষম্যের ঊর্ধ্বে উঠে ঐক্যের ভিত্তিতে অখণ্ড ভারতবর্ষের স্বাধীনতা কামনা করেছিলেন। ভারতের সব ধর্ম ও বর্ণের লোক তার মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে ব্রিটিশদের বিতাড়িত করে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে সচেষ্ট ছিলেন। গান্ধী ধর্মনিরপেক্ষবাদে বিশ^াসী ও রক্ষণশীল ছিলেন। ভারতবর্ষে তার মতো জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিকাশ ঘটেনি আর। তার পরও তিনি আর স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে পারেননি। কংগ্রেসের কিছু রাজনৈতিক নেতার বর্ণবাদী সাম্প্রদায়িক আচরণের কারণে ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দল জাতীয় কংগ্রেস দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। নিখিল ভারত মুসলীম লীগ নামে ১৯০৬ সালে ভারতীয় মুসলমানের স্বার্থ রক্ষার্থে পৃথক রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ স্বতন্ত্রভাবে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়। আন্দোলনের ফলে ঔপনিবেশবাদী ব্রিটিশ শাসকেরা ভারতবর্ষ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। একই সাথে, দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে: ভারত ও পাকিস্তান। পরে ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রধানমন্ত্রী নেহরুর মতো জনপ্রিয় নেতৃত্বের অভাব দেখা দেয়। এ কারণে আঞ্চলিকতার প্রভাব বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। ফলে ভারতের জাতীয় পর্যায়ের বড় দল হলেও কংগ্রেস সরকার গঠনে আঞ্চলিক দলগুলোর ওপর ক্রমান্বয়ে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এ দিকে ভারতের রাজনীতিতে বিজেপি বা ভারতীয় জনতা পার্টির উত্থান হিন্দুত্ববাদী আদর্শ প্রসারের প্রেক্ষাপটে ব্যাপকতা লাভ করে। কংগ্রেসের প্রচারিত ধর্মনিরপেক্ষবাদী আদর্শ বিজেপির সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদী আদর্শের কাছে ক্রমান্বয়ে পশ্চাৎপসারণ করতে থাকে। কয়েক বছর আগে বিজেপির নেতৃত্বে নরেন্দ্র মোদির আবির্ভাবের পর ভারতীয় জাতীয় রাজনীতি চরমভাবে হিন্দুত্ববাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে জাতীয়তাবাদের নামে। এ কথা সত্য যে, মহাত্মা গান্ধীর পরে ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে মোদির মতো এত বেশি জনপ্রিয়তা আর কেউ অর্জন করতে পারেননি। বিগত সময়ে ভারতের রাজনীতিতে যেসব শক্তিশালী নেতৃত্বের আবির্ভাব ঘটেছিল, তাদের মধ্যে অনেকেই আঞ্চলিক নেতা। মারাঠাদের অতীত নেতা শিবাজী, শিখ সম্প্রদায়ের বিরাট নেতা রণজিৎ সিংহ ছিলেন আঞ্চলিক নেতা। অপর দিকে নরেদ্র মোদি কূটকৌশল ও দূরদর্শিতার মাধ্যমে আঞ্চলিকপর্যায় থেকে উঠে এসে ভারতের জাতীয় রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। বিগত ১৯১৪ সালের নির্বাচনে হিন্দুত্ববাদী আদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি রামমন্দির নির্মাণ এবং অযোধ্যার ও গুজরাটের সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ডের ইস্যুকে নির্বাচনী প্রচারণায় প্রাধান্য দিয়েছিলেন। হিন্দুত্ব উসকে দিতে তার কৌশল কাজে লেগেছিল। ফলে বিজেপি নির্বাচনে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিল এবং নরেন্দ্র মোদি প্রথমবারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরে ১৯১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি শক্তিশালী ভারত গঠন ও কাশ্মির ইস্যুকে কৌশলগতভাবে সামনে নিয়ে আসেন। নির্বাচন সামনে রেখে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। এই প্রেক্ষাপটে মোদিমহলের প্রচারণায় প্রভাবিত জনসাধারণ ‘শক্তিশালী’ ভারত গঠনের লক্ষ্যে মোদির প্রতি সমর্থন দেয়। নির্বাচনে কংগ্রেসকে পরাজিত করে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি পুনরায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। তিনি দ্বিতীয়বারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন। ক্ষমতাসীন হয়ে তিনি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মির রাজ্যের বিশেষ মর্যাদার ৩৭০ ও ৩৫ এর ‘ক’ ধারা বাতিল করে দিয়েছেন। ভারতীয় কাশ্মিরকে তিনি দুই ভাগে ভাগ করে কেন্দ্রের শাসনাধীনে আনয়ন করেন। ভারতের উপজাতীয় জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত রাজ্যগুলোতে সাংবিধানিক ৩৭১ ধারার শাসন চালু আছে। সেসব রাজ্য বিশেষত মিজোরাম, অরুণাচলসহ অনেক রাজ্যে কাশ্মিরের সাংবিধানিক অধিকার হরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করা হয়। তারা তাদের বিশেষ সাংবিধানিক অধিকার হরণের শঙ্কায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন। এ রাজ্যগুলোর আস্থা অর্জনের লক্ষ্যে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ বলেছেন, সংবিধানের ৩৭১ ধারা বাতিল করা হবে না। উপরন্তু তিনি ভারতের জাতীয় নাগরিকপঞ্জির তালিকা প্রণয়নের মাধ্যমে রাজ্যগুলো থেকে ‘বহিরাগত’দের বিতাড়নের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিজেপি উপজাতীয়দের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করছেন মূলত মুসলিমদের হঠানোর মধ্য দিয়ে। অনেক ধর্ম, বর্ণ ও ভাষাভাষী মানুষের বাস ভারতে। নানা কারণে এক প্রদেশের লোক অন্য প্রদেশে গমনাগমন করে থাকে। সর্বোপরি ‘সপ্ত কন্যা’ খ্যাত উত্তরপূর্ব ভারতের পার্বত্য রাজ্যগুলোতে আদিবাসী বেশি। হিন্দু ও মুসলিম কম। আগে সেখানে জনসংখ্যার হার ছিল কম। সে কারণে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে অনেকে এ সব রাজ্যে চাকরি ও ব্যবসার কারণে বসতি স্থাপন করেছেন। কাশ্মির ইস্যুকে কেন্দ্র করে উপজাতীয় রাজ্যগুলোর রাজনীতি উত্তপ্ত হওয়ায় বিজেপি ওইসব রাজ্যে এনআরসি বা জাতীয় নাগরিক পঞ্জি নামে ‘জনসংখ্যার তালিকা’ প্রকাশ করার বিতর্কিত প্রক্রিয়া শুরু করেছে। মূলত রাজ্যগুলোতে নিজস্ব ভোট ব্যাংক তৈরির এবং হিন্দুত্ববাদী আদর্শ প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে বিজেপি সরকার এ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
বর্তমান ভারতের রাজনীতির সাম্প্রতিক গতিধারা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে চলেছে। ভারতের সংবিধানরচয়িতা দলিত নেতা ড. বি আর আম্বেদকর দলিতদের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের দাবি তুলেছিলেন। তবে গান্ধী সুকৌশলে দলিত সম্প্রদায়কে ‘হরিজন’ আখ্যা দিয়ে তাদের রাজনৈতিক দাবিকে অবদমিত করেছিলেন। আগামী দিনে ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র আদর্শ যত দুর্বল হবে, হিন্দুত্ববাদ তত বেগবান হবে। এ প্রতিক্রিয়ায় মুসলমান ও দলিতদের সাথে কথিত জাতীয়তাবাদীদের দূরত্ব অথচ বৃদ্ধি পাবে। অথচ দলিত ও মুসলমান জনসংখ্যা ভারতের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। তদুপরি উ: পশ্চিম ভারতের শিখেরা একাধিকবার স্বাধিকার আন্দোলনে সোচ্চার হয়েছে। সে কারণে ভারতের হিন্দুত্ববাদী উগ্র চেতনা দেশটির জাতীয় ঐক্য ও স্থিতিশীলতাকে কতদিন টিকিয়ে রাখতে পারবে তা অনিশ্চিত। হ


আরো সংবাদ



premium cement