২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

আবরার, ক্ষমা করো, পুত্র

চলতে ফিরতে দেখা
-

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদকে গত ৬ অক্টোবর শাসকদলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের ২৩-২৪ জন ঘাতক সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে রাত ৩টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে। এই কাজে তারা ব্যবহার করেছে ক্রিকেটের স্টিক ও স্কিপিংয়ের দড়ি। লোহার রড ব্যবহারেরও অভিযোগ আছে। এই খুনিরা সর্বশক্তি দিয়ে অবিরাম আবরারের পায়ের পাতা থেকে সারা শরীরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পিটিয়েছে। পেটাতে পেটাতে কেউ ক্লান্ত হয়ে গেলে, সে জিরানোর জন্য বিরতি নিয়েছে। অন্য দুর্বৃত্তরা তখন পেটাতে শুরু করেছে। যারা পিটিয়েছিল, তারা খানিকটা বিরতি দিয়ে ফিরে এসে পিটিয়েছে। এভাবে ছয় ঘণ্টা অবিরাম তাকে নির্যাতন করা হয়েছে। ছাত্রলীগের দাবি, তার সঙ্গে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সংযোগ রয়েছে। সেই কারণে তাকে ‘ট্রিটমেন্ট’ দেয়া হয়েছে। লক্ষণীয়, ছাত্রলীগ অনেক সময়ই ভিন্নমতের কাউকে পেটানোর বৈধতার পক্ষে, অভিযোগ হিসেবে তার ‘শিবিরসংশ্লিষ্টতা’ তুলে ধরার চেষ্টা করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সবাই যেন এই অলিখিত কানুন মেনে নিয়েছে যে, কেউ শিবির হলে তাকে পিটিয়ে হাত পা ভেঙে ফেলা যায়; এমনকি হত্যা করা যায়। আর যদি সে বেঁচেও যায়, তাকে তুলে দেয়া যায় পুলিশের হাতে এবং পুলিশও অত্যন্ত নির্বিকারভাবে সেই ঘাতকদের কাছ থেকে মুমূর্ষু ছাত্রকে নিজ দায়িত্বে নিয়ে নেয়। কিন্তু যারা বিনা দোষে পিটিয়ে মুমূর্ষু করে নিয়ে এলো, সেই অপরাধীদের কখনো ধরার চেষ্টা করে না।
ছাত্রলীগের দৃষ্টিতে আবরারের প্রধান দোষ ছিল, ফেসবুকে তার দেয়া একটি স্ট্যাটাস। তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া। সেখান থেকে দেয়া সে স্ট্যাটাসটি ছিল শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভারত সফরকালে সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কয়েকটি চুক্তি’ নিয়ে।
আবরার তার স্ট্যাটাসে বলেছিল,
‘১. ’৪৭ এ দেশভাগের পর দেশের পশ্চিমাংশে কোনো সমুদ্রবন্দর ছিল না। তৎকালীন সরকার ছয় মাসের জন্য কলকাতা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ করল। কিন্তু দাদারা নিজেদের রাস্তা নিজেদের মাপার পরামর্শ দিছিল। বাধ্য হয়ে দুর্ভিক্ষ দমনে উদ্বোধনের আগেই মংলা বন্দর খুলে দেয়া হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ ইন্ডিয়াকে সে মংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য হাত পাততে হচ্ছে। ২. কাবেরি নদীর পানি ছাড়াছাড়ি নিয়ে কানাড়ি আর তামিলদের কামড়াকামড়ি কয়েক বছর আগে শিরোনাম হয়েছিল। যে দেশের এক রাজ্যই অন্যকে পানি দিতে চায় না, সেখানে আমরা বিনিময় ছাড়া দিনে দেড় লাখ কিউবিক মিটার পানি দেবো। ৩. কয়েক বছর আগে নিজেদের সম্পদ রক্ষার দোহাই দিয়ে উত্তর ভারত কয়লা-পাথর রফতানি বন্ধ করেছে অথচ আমরা তাদের গ্যাস দেবো। যেখানে গ্যাসের অভাবে নিজেদের কারখানা বন্ধ করা লাগে, সেখানে নিজের সম্পদ দিয়ে বন্ধুর বাতি জ্বালাব। হয়তো এ সুখের খোঁজেই কবি লিখেছেনÑ ‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি/এ জীবন মন সকলি দাও,/তার মত সুখ কোথাও কি আছে/আপনার কথা ভুলিয়া যাও।’
সে কেন ভারতবিরোধী স্ট্যাটাস দিলো এই প্রশ্ন তাকে করা হয় পেটানোর সময়। যে চুক্তি বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী, যে চুক্তি পড়শিকে দাসখত লিখে দেয়ার শামিল, যে চুক্তি বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে বিঘিœত করে, দেশে এখন এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যে, তার বিরুদ্ধে কেউ টুঁ শব্দটিও করতে পারবে না। ছাত্রলীগ সেই স্ট্যাটাস দেখেই আবরারকে ‘শিবির’ ঘোষণা দিয়ে শায়েস্তা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল।
ভারত বাংলাদেশকে তিস্তার পানি না দিলেও আমাদের নিজস্ব ফেনী নদী থেকে ভারতকে বিপুল পরিমাণ পানি তুলে নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। ভারত বাংলাদেশকে অভিন্ন নদীগুলোর পানির ন্যায্য হিস্যা দেয় না। বাংলাদেশের অনুমোদন ছাড়াই ভারত পাম্প বসিয়ে ফেনী নদী থেকে পানি তুলে নিচ্ছে অনেক আগে থেকেই। বাংলাদেশ তার প্রতিবাদ করাই ছিল দায়িত্ব। তা না করে ফেনী নদীর পানি ভারতের ব্যবহারের জন্য উজাড় করে দেয়া হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে যেকোনো বিবেকবান মানুষ দেশের স্বার্থের কথা চিন্তা করে প্রতিবাদ করতেই পারে। বিভিন্ন সংগঠন ও রাজনৈতিক দল এই চুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ শুরু করেছে। শুধু পানি নয়, বাংলাদেশ ভারতে তরলীকৃত গ্যাস সরবরাহ করবে। প্রতিবাদের মুখে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ নিজস্ব প্রাকৃতিক গ্যাস ভারতে সরবরাহ করবে না। তরলীকৃত গ্যাস আমদানি করে ভারতে সরবরাহ করা হবে। এর জন্য বাংলাদেশকে ব্যয় করতে হবে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। কেন? বাংলাদেশের কী দায়! দেশের মানুষ বলছে, বাংলাদেশ থেকে ভারত শুধু নেয়, দেয় না কিছুই; দেয়নি কিছুই। তার পরও কেন ভারতকে এই তোষামোদি করতে হবে? এ অবস্থায় ছাত্রলীগের ২৩-২৪ জন মিলে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করল। তবে কি বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র নয়? তবে কি তাদের কাছে বাংলাদেশের স্বার্থ সবচেয়ে বড় নয়?
ভারত বাংলাদেশের সীমান্তে বঙ্গোপসাগর এলাকায় বসাচ্ছে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ছয়টি রাডার। এর মাধ্যমে তারা গোটা বাংলাদেশ এবং উপকূলবর্তী এলাকার সব জাহাজ চলাচলের ওপর নজরদারি করতে পারবে। প্রধানত চীনের নৌ চলাচলের ওপর নজর রাখার জন্যই এ চুক্তি করিয়ে নেয়া হয়েছে। চীনের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের। এখন তা তুঙ্গে। ফলে এমন অপরিণামদর্শী চুক্তি বাংলাদেশের জন্য কূটনৈতিক সঙ্কটের সৃষ্টি করবে। কোনো দেশপ্রেমিক মানুষই এই চুক্তি মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। সরকার গত ১০ বছরে ভারতকে দিয়েছে ট্রানজিট, বন্দর। ব্যবহার করতে দেয়া হয়েছে সড়কপথ নৌপথ রেলপথ। এখন ভারত আগরতলা বিমানবন্দর সম্প্রসারণের জন্য চাইছে বাংলাদেশের ভূমিও। ফলে বলা যায়, আগ্রাসনের মুখে বাংলাদেশ।
ছাত্রলীগ যে দানবের সংগঠনে পরিণত হয়েছে, প্রায় সে কথা স্বীকার করে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নিজেও। ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের টেন্ডারের বখরা চেয়েছিল। তখন তিনি নিজেই সেটা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তখন ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে তাদের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। তারা ওই ৮৬ কোটি টাকা ‘ন্যায্যভাগ (ফেয়ার শেয়ার)’ দাবি করার আগেই ঈদের বখশিশ হিসেবে ভিসির কাছ থেকে নিয়েছিল এক কোটি ৬০ লাখ টাকা। তাদের সরিয়ে দেয়া হলো বটে, তবে ওই দু’জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির কারণে দায়ের করা হলো না কোনো মামলা। জানা গেল, ছাত্রলীগের তারও আগের সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম ব্রিটেনে ১০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে তিনটি কোম্পানি খুলেছেন। বিজনেস ভিসায় এখন তিনি লন্ডনে। ছাত্র সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ১০ কোটি টাকা কিভাবে আয় করলেন, আওয়ামী লীগের কেউ সে প্রশ্ন তুললেন না। এখানে বিচারহীনতার সংস্কৃতিরই জয় হলো। ইতোমধ্যে আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত বর্ণনা, খুঁটিনাটি, ভিডিও ফুটেজ, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির আলামত উঠে এসেছে। সেখানে পৈশাচিকতার আলামতই ফুটে উঠেছে।
ক্ষমতাসীনমহল পুরনো নিয়মে একই কোরাস গাইছে, ‘কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়’, ‘আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে’ এমন গৎবাঁধা কথা। কিন্তু আইন যে তার নিজস্ব গতিতে চলছে না, সেটি আবরার হত্যাকাণ্ডের সময় ও তার পরে আমরা উপলব্ধি করতে পেরেছি। আইনকে নিজস্ব গতিতে চলার জন্য এই সরকারের আমলে সবসময় সবুজ সঙ্কেতের দরকার হয়। এবারো এটাই হয়েছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি এখন সর্বত্র। তাই খুনিরা পার পেয়ে যায়; চাঁদাবাজরা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে; ক্ষমতার অপব্যবহারকারীরা কখনো প্রশ্নের সম্মুখীন হয় না এবং ব্যাংক লুটেরারা সাজা পায় না।
আওয়ামী লীগ দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকার ফলে এবং শাস্তিহীনতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠায় চার পাশে দানবের উত্থান ঘটেছে। শাসক মহলে সবাই এ কথা জানে যে, তারা যত অপরাধই করুক না কেন, শেষ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে না। আবরার ফাহাদকে খুনের পরিকল্পনা করেছিল, ছাত্রলীগের মেসেঞ্জার গ্রুপ। বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন ৫ অক্টোবর ১২:৪৭ মিনিটে বুয়েট শাখার ছাত্রলীগের সাহিত্য সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনিরকে নির্দেশ দেন। রবিন বার্তা পাঠান ’১৭-র আবরার ফাহাদ। মেরে হল থেকে বের করে দিবি। এর আগেও বলেছিলাম। তোদের তো দেখি, কোনো বিগার নাই। শিবির চেক দিতে বলেছিলাম।’ জবাবে মনিরুজ্জামান বলেন, ‘ওকে ভাই।’ পরে মেহেদী উত্তেজিত হয়ে একটি অশ্লীল শব্দসহ বলেন, ‘ভাই দুই দিন সময় দিলাম।’ এরপর মেসেঞ্জারে মেহেদী লেখেন, ‘দরকার হলে ১৬ ব্যাচের মিজানের সঙ্গে কথা বলিস। ও শিবির ইনেভোমেন্ট (ইনভলভমেন্ট)-এর ব্যাপারে আরো কিছু ইনফো দেবে।’ মিজান আবরারের রুমমেট। তারা দু’জন শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষে থাকতেন। মেসেঞ্জার গ্রুপের কথোপকথনে শিউরে ওঠার মতো আরো তথ্য। ঘটনার রাতে আরেকজন লেখেন, ‘আবরার ফাহাদকে ধরছিলি তোরা।’ উত্তরে একজন লেখেন, ‘হ’। প্রথমজন আবার জানতে চান, ‘বের করছস’। দ্বিতীয়জন জানতে, ‘হল থেকে নাকি স্বীকারোক্তি’। এর উত্তরে আরেকজন বলেন, ‘মরে যাচ্ছে’। অন্যজন বলেন, ‘মাইর বেশি হয়ে যাচ্ছে।’ উত্তরে আরেকজন বলেন, ‘ওহ! বাট ওরে লিগ্যালি বের করা যায়।’ আবরারকে ধরে আনার আগে মেসেঞ্জার গ্রুপের একটি স্ক্রিনশটে একটি কথোপকথন উঠে আসে। মনির লিখেছে, ‘নিচে নাম সবাই।’ ‘ওকে ভাই’ বলে, পরপর দু’জন পোস্ট করেছে। আবরারকে যখন নির্যাতন করা হয়, তখন একই গ্রুপের একজন জানতে চান, আবরার কি হলে আছে? আবু নওশাদ সাকিব ও শামসুল আলম নামে দু’জন বলে, ‘হ ভাই, ২০১১ তে আছে।’ এই ২০১১ নম্বর রুমই ছাত্রলীগের টর্চার সেল।
আবরারকে নির্যাতনের প্রস্তুতি ও নির্যাতনের পরের ঘটনার বিবরণ দেন প্রত্যক্ষদর্শী বুয়েট ছাত্র আশিকুল ইসলাম বিটু। বিটু বলেন, জেমি আর তানিমকে ফোন দেয় মনির। বলে, আবরারকে ডেকে ২০১১ নম্বর রুমে আনতে। পরে দু’জন আবরারের ফোন ও ল্যাপটপ চেক করতে দেখি। কোথায় আবরার লাইক দেয় বা কমেন্ট করে অথবা কাদের সঙ্গে মেসেঞ্জারে কথা বলে, এগুলো নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল। এরপরে রুম থেকে বের হয়ে যাই। পরে ১২টা ৩০ মিনিটের দিকে আবার রুমে আসি আমার ল্যাপটপ ও বই নিতে। আমি রুমের ভেতরে ঢুকে দেখলাম, আবরার একদম মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। সেখানে আবরারের ব্যাচেরও সাত-আটজন ছিল। পরে রুম থেকে বের হয়ে সকালকে প্রশ্ন করি, এ অবস্থা কিভাবে হলো? তখন মনির উত্তর দিলো, ‘অনিক ভাই মাতাল অবস্থায় একটু বেশি মারছে।’ তখন ওখানে থাকা আমার জন্য ভালো হবে না ভেবে, ওখান থেকে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে আসি।’ বিটু আরো বলেন, এমন মারধরের ঘটনা অনেক সময়ই হলে হয়। ওকে মেডিক্যালে নিয়ে গেলে হয়তো বাঁচানো যেত।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গত ১০ বছরে ছাত্রলীগ এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। বহু আগেই তারা অন্য ছাত্রসংগঠনগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দিয়েছে। এখন হলে থাকতে হলে ছাত্রলীগকে ট্যাক্স দিয়েই থাকতে হয়। দলের ‘বড়ভাইয়েরা’ ছোটভাইদের কমন রুমে জড়ো করে। তার পর ‘নানা অপরাধে’ তাদের চড়থাপ্পড় মারা হয়। কখনো কখনো অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে অশ্লীল গান কবিতা আবৃত্তি করতে বাধ্য করা হয়। এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার শাস্তিও দেয়া হয়। ছাত্রলীগের চড়থাপ্পড়ে এক বুয়েট ছাত্রের কানের পর্দা ফেটে সে বধির হয়ে গেছে। ছাত্রলীগের এই নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে গত পাঁচ বছরে কমপক্ষে ৩০ জন ছাত্র প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে গেছে।
এ দিকে বুয়েট শাখার ছাত্রলীগের নেতা ইফতি মোশাররফ ওরফে সকাল, ১০ অক্টোবর মহানগর হাকিম খন্দকার ইয়াসীন হাসান চৌধুরীর কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদকে ক্রিকেটের স্টাম্প আর প্লাস্টিকের মোটা দড়ি (স্কিপিং রোপ) দিয়ে বেধড়ক পিটিয়েছিলেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। একপর্যায়ে অসুস্থ হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়েন তিনি। তাকে মাটি থেকে তুলে আবারো পেটাতে থাকেন তারা। ঘণ্টা কয়েক পর বমি করতে শুরু করেন আবরার। তিনবার বমি করার পর নিস্তেজ হয়ে যান। ইফতি বলেন, ৪ অক্টোবর বুয়েট শাখার ছাত্রলীগের মেহেদী হাসান ওরফে রবিন শেরেবাংলা হল ছাত্রলীগের মেসেঞ্জার গ্রুপে একটি নির্দেশ দেন। তাতে সাড়া দেন, বুয়েট শাখার ছাত্রলীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক অমিত সাহা। আবরার তখন বাড়িতে থাকায় তিনি ইফতিকে বলেন, ওকে বাড়ি থেকে ফিরতে দেন। ইফতি আদালতে বলেন, ৬ অক্টোবর রাত ৮টার কিছু পর আবরারকে ২০১১ নম্বর কক্ষে নিয়ে আসা হয়। আবরারের দু’টি মোবাইল ও ল্যাপটপও সাথে আনা হয়। সেখানে তার রুমমেট ছাত্রলীগের উপদফতর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ একটি মোবাইল এবং তৃতীয়বর্ষের তাবাখ্খারুল ওরফে তানভীর আরেকটি মোবাইল চেক করেন। দ্বিতীয়বর্ষের মুনতাছির আল জেমী আবরারের কাছ থেকে তার পাসওয়ার্ড নিয়ে ল্যাপটপ খুলে চেক করেন। তখন মেহেদী হাসান ও ছাত্রলীগের ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক ২০১১ নম্বর কক্ষে আসেন। বুয়েটে কারা কারা শিবির করে, তা বের করার জন্য মেহেদী অন্যদের নির্দেশ দেন। এ সময় মেহেদী আবরারকে বেশ কয়েকটি চড় মারেন। ওই কক্ষে তখন ক্রিকেটের কোনো স্টাম্প ছিল না। বাইরে থেকে কেউ একজন স্টাম্প নিয়ে আসে। ইফতি আবরারের কাছ থেকে কথা বের করার জন্য স্টাম্প দিয়ে তাকে চার-পাঁচটি আঘাত করেন। এতে স্টাম্পটি ভেঙে যায়। তখন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার স্টাম্প দিয়ে আবরারের হাঁটু, পা ও পায়ের তালুতে মারতে থাকেন। এতে আবরার উল্টোপাল্টা কিছু নাম বলতে শুরু করেন। তখন মেফতাহুল আবরারকে চড় মারেন এবং স্টাম্প দিয়ে হাঁটুতে বাড়ি দেন। এ সময় মেহেদী মুঠোফোনে বুয়েট শাখার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাসেলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ইফতি বলেন, রাত সাড়ে ১০টার দিকে তিনি ক্যান্টিনে খেতে যান। মিনিট বিশেক পর ফিরে এসে দেখেন, আবরার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি মেঝেতে শুয়ে আছেন। তিনি তখন আবরারকে ধমক দিয়ে উঠিয়ে দাঁড় করান। কয়েকটি চড় মারেন। তৃতীয়বর্ষের মুজাহিদুর রহমান স্কিপিং রোপ দিয়ে আবরারকে মারেন। ইফতি আবার স্টাম্প দিয়ে আবরারের হাঁটু ও পায়ে আঘাত করেন। তাবাখ্খারুল তখন চড়থাপ্পড় মারেন। ইফতি আদালতে বলেন, রাত ১১টার দিকে অনিক সরকার আবার কক্ষে আসেন। হঠাৎ অনিক স্টাম্প দিয়ে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে আবরারকে এলোপাতাড়ি শতাধিক আঘাত করেন। অনিক খুবই অনিয়ন্ত্রিতভাবে আবরারকে মারতে থাকেন। তার মারা দেখে সবাই ভয় পেয়ে যান। রাত আনুমানিক ১২টার পর অনিক আবরারকে মারা থামিয়ে কক্ষের বাইরে যান। ইফতি বলেছেন, তখন আবরার অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তিনি জানান, তার খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তখন ইফতি আবরারের মাথার নিচে দু’টি বালিশ দেন। এর কিছুক্ষণ পরে আবরার বমি করেন। মুঠো ফোনের বিষয়টি অনিককে জানানো হলে, তিনি আবরারকে গোসল করিয়ে হাতে পায়ে মলম লাগিয়ে দিতে বলেন। এ সময় আবরার দ্বিতীয়বার বমি করেন। তখন আবরারের কক্ষ থেকে তার কাপড় চোপড় নিয়ে আসা হয়। মেহেদী আবরারকে ডেকে বলেন, ও নাটক করছে। ইফতি বলেন, এরপর আবরারকে ২০০৫ নম্বর কক্ষে শুইয়ে দেয়া হয়। এ সময় অমিত খুদে বার্তা পাঠালে তিনি সব কিছু জানতে চান এবং আবরারকে আরো মেরে তথ্য বের করতে বলেন। আবরারের অবস্থা খুব খারাপ জানালে অমিত তাকে হল থেকে বের করে দিতে বলেন। এর কিছুক্ষণ পর মেহেদী ও অনিক ২০০৫ নম্বর কক্ষে আসেন। আবরারকে দেখে বলেন, ‘ও ঠিক আছে।’ এরপর তারা চলে যান। ইফতি বলেন, এ সময় আবরার আবার বমি করেন। মেহেদী তখন আবরারকে পুলিশের হাতে দেয়ার জন্য নিচে নামাতে বলেন। ১৭ ব্যাচের ছেলেরা আবরারকে নিচে নামানোর চেষ্টা করেন। ব্যর্থ হলে, তোশকসহ আবরারকে ধরে দোতলা ও নিচতলার সিঁড়িতে নামিয়ে রাখেন। তখন আবরার বলছিলেন যে, তার খুব খারাপ লাগছে। সাধারণ সম্পাদক রাসেল তখন নিচে নেমে হলের প্রধান ফটকে পুলিশের সঙ্গে কথা বলছিলেন। এ সময় মুনতাসির দৌড়ে এসে বলেন, আবরারের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। ইফতি তাকে মালিশ করতে বলেন। ইসমাইল ও মনির তখন অ্যাম্বুলেন্সে ফোন দেন। অ্যাম্বুলেন্স আসতে দেরি হওয়ায় অমিত বাইক নিয়ে বুয়েট মেডিক্যালের চিকিৎসক নিয়ে আসেন। চিকিৎসক আসার পরপরই অ্যাম্বুলেন্স আসে। চিকিৎসক সিঁড়িতে আবরারকে দেখে বলেন, ও মারা গেছে। সেখান থেকে ইফতি একটি কক্ষে এসে শুয়ে থাকেন। সেখান থেকে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে।
২০১১ নম্বর কক্ষে এই ভয়াবহ নির্যাতনের ঘটনা তার আশপাশে কেউ টের পায়নি, এমন নয়। হয়তো তাদেরই কেউ চকবাজার থানা পুলিশকে ফোন করেছিল। পুলিশ এসেছিল। কিন্তু রাসেল পুলিশকে হলের ভেতরে ঢুকতে দেননি। তাদের বসিয়ে রেখেছিলেন হলের গেস্টরুমে। শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছিলেন, ছাত্রলীগ নেতারা তাদের যথাযথ সম্মান না দেয়ায় শিক্ষার্থীদের হামেশাই মারধর করতেন। ‘সম্মান না দেয়া’ মানে হলো, উঠে না দাঁড়ানো, সালাম না দেয়া ইত্যাদি। তাদের চলাচলের পথে সঙ্গে ব্যবহার করতেন প্রটোকল। সামনে পেছনে থাকত মোটরসাইকেলের বহর। তারা নেতাদের চলাচলের জন্য রাস্তা পরিষ্কার রাখত। ছাত্রলীগ নেতাদের প্রত্যেকেরই বাড়ি, গাড়ি ও কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আছে। তা ছাড়া দলের মিছিলে না গেলেও তাদের টর্চার সেলে নির্যাতন করা হতো। সবচেয়ে লঘু শাস্তি ছিল চড়থাপ্পড় মারা।
এই পরিস্থিতি একদিনে সৃষ্টি হয়নি। এটা এ কারণে সৃৃষ্টি হয়েছে যে, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কমপক্ষে ১৫১টি হত্যাকাণ্ড হয়েছে। কিন্তু তার কোনোটিরই বিচার হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যাপকভাবে দলীয়করণের ফলে তারা হয় ক্ষমতাসীনদের হাতে জিম্মি ছিলেন, অথবা শাসক মহলের কর্মকাণ্ডের প্রতি মৌন সমর্থন জানিয়েছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় বা হল প্রশাসনকে ক্ষমতাসীনদের কথায় উঠবস করতে হয়েছে। পুলিশও তাদের কাছে অসহায়। সে কারণে যে পুলিশ সদস্যরা হলে এসেছিলেন, তারা হলে ঢুকতে পারেননি; উপরের নির্দেশের অপেক্ষায় ছিলেন। পুলিশ যখন প্রথম এসেছিল তখন যদি তারা জোর করে ঢুকতে পারত কিংবা উপরের নির্দেশ পেত তা হলে হয়তো আবরারকে বাঁচানো সম্ভব ছিল। অর্থাৎ আইন নিজস্ব গতিতে চলেনি। আইন চলেছে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদকের ইচ্ছা অনুযায়ী। ছাত্রলীগের ছেলেরা উৎসবের মতো করে আবরারকে পিটিয়েছে। আবরারের সুরতহাল রিপোর্টে ডাক্তার লিখেছেন, অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ ও মাত্রাতিরিক্ত ব্যথায় আবরারের মৃত্যু হয়েছে। এখানে লক্ষণীয়, ছাত্রলীগের ঘাতকরা আবরারের সারা শরীরে আঘাত করলেও তারা মাথায় কোনো আঘাত করেনি। মাথায় আঘাত করলে হয়তো অনেক আগেই আবরার সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলতেন এবং মাত্রাতিরিক্ত ব্যথা অনুভব করতে পারতেন না। ছাত্রলীগের ঘাতকরা চেয়েছিল, সে যেন ব্যথা অনুভব করতে পারে। যেন দীর্ঘক্ষণ সে বেঁচে থাকে।
এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অদ্ভুত আচরণ করেছে। এ ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ক্যাম্পাসে আসেননি। তার অধস্তনদের ‘ম্যানেজ’ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আসেননি ক্যাম্পাসে আবরারের জানাজায়। তিনি আবরারের কবর জিয়ারত করতে তার কুষ্টিয়ার গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন। দেখা করতে গিয়েছিলেন তার বাবা-মায়ের সাথে। কিন্তু গ্রামবাসীর বাধায় তা পারেননি। যখন ভিসির পদত্যাগের প্রশ্ন উঠল, তখন তিনি বললেন, কেন পদত্যাগ করব? আমি তো কোনো দোষ করিনি। কিন্তু তিনি ও তার সহকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে অবস্থানরত একজন ছাত্রের জীবনের নিরাপত্তার মৌলিক অধিকার রক্ষা করতে পারেননি। সে দায় তিনি নেবেন না কেন?
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিভাবকরা তার সন্তানদের পাঠান নিরাপদে লেখাপড়া করার জন্য। লাশ হওয়ার জন্য নয়। সে দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেই নিতে হবে। যে ঘাতকরা এই খুনের সঙ্গে জড়িত তাদের ব্যাকগ্রাউন্ডও ভালো। কিন্তু বুয়েটে পড়তে এসে তারা কেন অমানুষ হলো? এর জবাব কর্তৃপক্ষকে দিতে হবে। আমরা তাদের মধ্যে কেন মানবিকতার বিকাশ ঘটাতে পারলাম না, সে প্রশ্ন বিবেকের কাছে করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও বিডিআরসি ছাত্রদের অভিযোগ দাখিল করার ওয়েবসাইটটি বন্ধ করে দিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে সেটা খতিয়ে দেখা হবে। আমরা বলছি, সে কারণ নিহিত আছে বিচারহীনতার মধ্যেই। যদি প্রথম থেকেই টর্চার সেল, কমন রুম নির্যাতনÑ এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যেত তাহলে আবরারের মৃত্যু হতো না।
যেকোনো অভিভাবক তার সন্তানকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতে অন্তত ১০ বার ভাববেন, সন্তান প্রাণ নিয়ে বাঁচতে পারবে তো! প্রত্যেক অভিভাবক নিজ সন্তানের জায়গায় আবরারকে ভাববেন। সে কারণেই আমরা আবরারের কাছে কেবল ক্ষমা প্রার্থনাই করতে পারি। বলতে পারি, হে পুত্র, ক্ষমা করো। আমরা এ দেশে বিচারের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি আজো। হ
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
ৎবুধিহংরফফরয়ঁর@ুধযড়ড়.পড়স


আরো সংবাদ



premium cement