১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কিছু বই জ্ঞানের ধারক, কিছু উদ্দেশ্যের বাহক

-

অনেক ঐতিহাসিকের মতে, ভারতে বৈদিক যুগের (১৫০০ থেকে ২০০ খ্রিষ্টপূর্ব) মাঝামাঝি সময়ে ধর্মমতে ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্বের বিরুদ্ধে ক্ষত্রিয়দের উত্থানের কারণে রচিত হয়েছিল উপনিষদ; অর্থাৎ ব্রহ্মবিদ্যা। কিন্তু তৎসত্ত্বেও পরবর্তী সময়ে সেই ক্ষত্রিয়দেরই মহাবীরের জৈন ও সিদ্ধার্থ গৌতমের বৌদ্ধ ধর্ম পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে আবির্ভূত হয়। ফলে সনাতন ধর্মের (হিন্দু) প্রাধান্য রক্ষার্থে সংস্কৃত ভাষায় পর্যায়ক্রমে রচিত হলো মোট ৩৬ খানা পৌরাণিক কাহিনীসংবলিত গ্রন্থ। এর ১৮ খানার নাম মহাপুরাণ এবং অবশিষ্টগুলো উপপুরাণ, যা লেখা হতে থাকে ভারতে মুসলিম রাজত্ব প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক প্রধান, ড. অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তার ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’, প্রথম খণ্ডের ৬২০ পৃষ্ঠায় এই পুরাণ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘ইহাতে অনেক অলৌকিক, অসম্ভব, অবাস্তব, অনৈতিহাসিক কথা থাকিলেও তদানীন্তন সমাজ জীবনের অনেক ঐতিহাসিক উপাদানও ইহার মধ্যে নিহিত আছে। পুরাণের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যÑ বৈদিক সংস্কৃতির অবসানের পর বৌদ্ধ প্রভাবের ফলে ব্রাহ্মণ্যমতাশ্রয়ী হিন্দু সমাজে যে শূন্যতা সৃষ্টি হইল, এই পুরাণগুলি সেই শূন্যতাকে অনেকাংশে পূর্ণ করিতে পারিয়াছিল।’ এ ছাড়াও জনৈক বিশ্ববসু তার ‘জ্ঞান-বিজ্ঞানের হাজার জিজ্ঞাসা’ নামক বইয়ের ১০ পৃষ্ঠায় আরো স্পষ্ট করে লিখেছেন, “পুরাণে বিচিত্র সব ব্যাখ্যায় বিশ্বজগতের বহু বিচিত্র ঘটনাবলির হরেক রকম কারণ দেখানো হয়েছে। মনগড়া চমকপ্রদ কল্পনারঙিন গল্পের পর গল্পে যেসব ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে, তাদেরই নাম ‘পৌরাণিকী’ কথা। একেকটা জাতের সব রকম পৌরাণিকী কথার সমষ্টির নাম পুরাণ।”
প্রায় দেড় হাজার বছরব্যাপী এই পুরাণ দিয়ে জনমনে জন্মানো অনেক ভ্রান্ত বিশ্বাসের অনুকূলে, শত বছর আগেও লেখা প্রায় বইপত্রে দেয়া হতো পুরাণের উদ্ধৃতি, যা বর্তমানে সহসা লেখা বা দেয়া হয় না। কিন্তু সেকালে এই পুরাণ লেখার মূল কারণগত উদ্দেশ্যের চর্চা এ কালেও উপমহাদেশে বেশ প্রবহমান। অনেকসময়ই দেখা যায়, তর্কে হারার সম্ভাবনায় কেউ কেউ পুরাতন বই বা জাতীয় কোনো দৈনিকের তারিখ ও পৃষ্ঠা উল্লেখ করে মনগড়া তথ্য উপস্থাপন করে থাকেন। এমন লেখা সংবাদপত্রে কখনো কখনো যেমন পাওয়া যায়, তেমনি টিভি টকশোতেও মাঝে মধ্যে শোনা যায় এ ধরনের বক্তব্য।
ড. দীনেশচন্দ্র সরকার তার ‘পাল-পূর্ব যুগের বংশানুচরিত’ নামক বইয়ের ২২১ পৃষ্ঠায় সংযোজনে লিখেছেন, ‘প্রাচীন যুগে কামরূপের রাজগণ সৈন্য সামন্ত হাতিঘোড়া নৌকায় চাপায়ে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়তেন এবং গঙ্গা বেয়ে বিহারের দিকে চলে যেতেন। ভাস্করবর্মা ২০ হাজার হস্তী এবং সৈন্যাদি ৩০ হাজার নৌকায় চড়িয়ে ঐরূপে রাজমহলে হর্ষবর্ধনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন।’ কিন্তু, পাঁচ হাজার কেজি বা সাড়ে পাঁচ টন ওজনের একেকটা এশিয়ান হাতীর কতটা নৌকায় চড়িয়ে বঙ্গোপসাগর হয়ে দীর্ঘ নৌপথের ওই যাত্রা তখন সম্ভব ছিল, যখন খোদ ব্রহ্মপুত্র নদকেই ‘সমুদ্র’ বলা হতো? অর্থাৎ, এটা বিকৃত তথ্য। মূল তথ্য প্রসঙ্গে R.C.Majumdar Zvi The History of Bengal, Part one, Page-78- এ লিখেছেন হস্তীসহ ২০ হাজার সেনাদল নিয়ে ভাস্করবর্মার অগ্রসর হওয়া এবং তার ৩০ হাজার নৌকা গঙ্গা বেয়ে একই গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা করার কথা।
বেশ কিছু অনৈতিহাসিক, মনগড়া ও ভ্রান্ত তথ্যে ২০১১ সালে প্রকাশ হয়েছে ‘পটুয়াখালী জেলার ইতিহাস।’ এর প্রথমে দেয়া বেশ কিছু ছবির পরেই ৪৯ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, ‘ভূতত্ত্ববিদদের কাছে বাংলাদেশে সবচেয়ে পুরনো ভূ-ভাগের বয়স প্রায় তিন লক্ষ বছর। পটুয়াখালীর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন ভূ-খণ্ডটি হলো বাকলা। ভূতাত্ত্বিকদের দৃষ্টিতেÑ বাকলার বয়স প্রায় ৫০ হাজার বছর, সে হিসাবে পটুয়াখালীর ইতিহাস রচিত হওয়ার কথা ছিল ৫০ হাজার বছরের।’ বইটির ৫৪ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, ‘আরোঙ্গজেব ১৬৮৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন।... প্রাচীনকাল থেকে চন্দ্রদ্বীপে যারা রাজত্ব করেছেন, তারা মুঘল এবং তৎপূর্ববর্তী মুসলিম শাসকদের বশ্যতা স্বীকার করেছেন।’ ৫৭ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, ‘মূলত ইংরেজদের বঙ্গভঙ্গের কারণ ছিল বাংলার মানুষের একতা নষ্ট করা।’ ৬৭ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘প্রাচীনকালে ‘বাঙ’ জাতির আধিপত্য ছিল এ দেশে। এ নামের পরিবর্তিত রূপই ‘বাংলাদেশ।’ অন্য তথ্যমতে, নুহ আ:-এর পুত্রের নাম ছিল ‘বঙ্গ’। তার শাসিত রাজ্যের নাম বঙ্গ। এখান থেকে বঙ্গ, অতঃপর বাংলাদেশ নামের উৎপত্তি। আরেকটি তথ্যমতে, ‘বাং বা বান থেকে বাঙ্গালা, সেখান থেকে বাংলা/ বাংলাদেশ নাম হয়েছে।’ ৭৮ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘বৌদ্ধ ধর্মের উত্থানের প্রথম স্তর মনে করা হয় পাল বংশের উত্থানকে, দ্বিতীয় স্তর মনে করা হয় সেন বংশের উত্থানকে।’ পুুরাণের আদলে বর্তমান যুগেও যে আমরা বই লিখি, এটা তারই প্রমাণ। ৪০০ টাকা মূল্যের ৩২৮ পৃষ্ঠার এই বইটির মাত্র ৩০ পৃষ্ঠা পড়ে আরো পড়ার আগ্রহ হারিয়ে অনুরূপ আরো তিন বইয়ের সাথে ফেলে রেখেছি। আফসোস যে, জ্ঞানেও ভেজাল। উপরোল্লিখিত বিষয় সর্বস্বীকৃত ঐতিহাসিক তথ্য পরবর্তী লেখায় দেয়ার আশা রাখি। হ

 

 


আরো সংবাদ



premium cement

সকল