২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

  নৈতিকতার সেকাল একাল

-

৭ সেপ্টেম্বর রাত ৯টায় গ্রাম থেকে ফোন। এক যুবক ফোন করে, আঙ্কেল আপনাকে যে একবার এলাকায় আসতে হয়। কারণ জানতে চাইলে বলে, ‘এলাকাটা দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন ঘটছে নতুন নতুন কাণ্ড। কী ধরনের কাণ্ড? উত্তর, সব নারীঘটিত। একটাও প্রকাশ করার মতো নয়। আপনি এলেই শুনতে পারবেন।’ যুবকটি আরো বলল, আপনারা যখন গাঁয়ের নেতৃত্বে ছিলেন, তখন এমন ছিল না।
যুবক প্রকাশ করতে না চাইলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কৃপায় হাঁড়ির খবরসহ কোনো কিছুই অপ্রকাশিত থাকে না। শুধু আমাদের এলাকা নয়, দেশের ৬৮ হাজার গ্রামের প্রায় সবখানেই এগিয়ে রয়েছে ‘নারীঘটিত কাণ্ড’। শহর ছেড়ে গাঁয়েও ছড়িয়ে পড়ছে অনৈতিকতা।
কয়েক দশক আগেও গ্রাম নিয়ে গর্ব করতাম। অজপাড়াগাঁ হলেও গ্রাম নিয়ে তা করার মতো যথেষ্ট কারণ ছিল। বাইরে থেকে পাত্রীর খোঁজে প্রথম স্থানে ছিল আমাদের এলাকা। গত দুই দশকের কর্মকাণ্ডে এখন এলাকার পরিচয় দিতেও সঙ্কোচ বোধ হয়। এ জন্য দায়ী কে?
গত ৮ সেপ্টেম্বর নয়া দিগন্তে ‘নৈতিক মান উন্নয়ন প্রসঙ্গে’ এক প্রবন্ধে মোহাম্মদ ফজলুল হক নৈতিক স্খলনের জন্য মানবতা, চেতনাবোধ, উদারতা, ধর্মীয় জ্ঞান ও পারিবারিক সুশিক্ষার অভাবকে দায়ী করে এর পরিণাম সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমাদের তরুণ ও যুবসমাজ দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। তারাই দেশ ও জাতির কাণ্ডারি। সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারলে তারাই আদর্শের ভিত্তিতে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তারা যদি এই উপযুক্ত সময়ে বিপথগামী হয়, তাহলে দেশ অনিবার্যভাবে ধ্বংসের দিকে পা বাড়াবে। সুতরাং তাদের গড়ে তোলাতেই রয়েছে জাতির কল্যাণ। সর্বকালের, সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব এ বিষয়টিতে সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণে একটি অসভ্য, বর্বর ও উচ্ছৃঙ্খল জাতিকে বিশ্বের বুকে একটি শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে উপহার দিতে সক্ষম হয়েছেন।’
এক সময় আমাদেরও ছিল একটি অখণ্ড গ্রাম। গাঁয়ের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে হেঁটে যাওয়া যেত। গাঁয়ে উঠানের ওপর দিয়ে হাঁটাচলার সময় পরস্পর সালামসহ সৌহার্দ্য বিনিময় ছাড়াও পড়শির সাথে ছিল পড়শির শতবর্ষের বন্ধন। ছিল অনেক যৌথ পরিবার। নদীভাঙনের ফলে পড়শির সাথে ছিন্ন হয়ে গেছে শত বছরের সৌহার্দ্য।
নতুন বসতি গড়তে গিয়ে নতুন পড়শির সাথে সৌহার্দ্য-সদ্ভাব গড়ে ওঠার আগেই শুরু হয় অঘটন। দিন যত যাচ্ছে ততই বাড়ছে ব্যক্তিচিন্তা। এ কারণে ভাঙছে যৌথ পরিবার। তার সাথে ভাঙছে পারিবারিক মূল্যবোধও। লজ্জা, সঙ্কোচ ও মানসিক অস্বস্তি অনৈতিকতার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করত। একসময় নারীঘটিত অনৈতিক কর্মকাণ্ডের দায় পরিবারকে বহন করতে হতো বংশপরম্পরায়।
শৈশবের ঘটনা। মুন্সীগঞ্জ সিরাজদি খান এলাকায় সম্পর্কিত বড়ভাই বিয়ে করেছিলেন তার ছাত্রীকে। স্বেচ্ছায় বিয়ে করা ছাত্রীর বয়স ছিল কম। মামলায় হাজত খাটতে হয়েছিল ভাইসহ তার পরিবারের কয়েকজনকে। লোকলজ্জায় নতুন বউসহ পরিবার থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল ভাইকে। ‘ক্যামন সাহসী মেয়ে!’ একনজর দেখার জন্য গয়না নৌকা করে পরিবারের বড়দের সাথে গিয়েছিলাম আমি নিজেও। ওদের ছায়া মাড়ানোও যেন পাপ। বাড়ি থেকে বেশ দূরে একটা খালি ভিটায় ঘর তুলে একঘরে হয়ে থাকত নবদম্পতি।
আমি যখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র, তখন আইয়্বূ আলী নামে সুদর্শন এক সহপাঠী ছিল। সুন্দর করে বাঁশি বাজানোসহ গানও গাইতে পারত মিষ্টি সুরে। একদিন স্কুলে বিরতির সময় পুঁথিপাঠের মতো সুর করে,
‘গেরাম রাইপুরাতে, ২
আছে তাতে আলতু মিয়া নাম,
তাহার একটি মেয়ে ভাইরে রূপে চমৎকার।
নামটি আনোয়ারা, ২
রূপে খাড়া তরল আলতা গায়।’
পাঠ করতে শুরু করে দেয়। বাবা-মায়ের অমতে বিয়ে করার রোমাঞ্চকর কাহিনী। রাইপুরা গ্রামের আলতু মিয়ার মেয়ে আনোয়ারা বাবা-মায়ের অমতে এক যুবকের সাথে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। ‘ভয়ঙ্কর’ এই কাহিনী নিয়ে এক কবি বই ছাপিয়েছেন। বাজারে বাজারে বিক্রি করা হয় সে বই। এক আনা দাম। কার আগে কে কিনবে, হুলস্থুল কাণ্ড। হুলস্থুল কাণ্ড কেন হবে না, বাবা-মায়ের অমতে বিয়ের ঘটনা দু’চার-দশ গাঁয়ে কয়টা ঘটে?
মোবাইলের সহজলভ্যতায় এখন আর চিঠি লিখে উত্তরের অপেক্ষায় ডাকপিয়নের পথ চেয়ে থাকতে হয় না। কাজের বুয়ার কোমরেও থাকে মোবাইল। এই ছোট্ট যন্ত্রটির উপকার যেমন বলে শেষ করা যায় না, অপকারও বলে শেষ করা যায় না।
এক সময় গাঁয়ের বেকার যুবকেরা ‘উত্তর ভাটি’ ধান কাটতে যেত। ৪০০-৫০০ মণ মালবাহী দৈত্যাকারের নৌকা নিয়ে যেত বৃহত্তর সিলেটের হাওর এলাকায় ধান কাটতে। ফিরে আসত দেড়-দুই মাস পর। এক মাস যেতে না যেতেই নতুন বউয়েরা ঘোমটার ফাঁক দিয়ে তাকাতে শুরু করত নদীর দিকে। স্বামী বাড়ি এলে নতুন বউয়ের দেখা করা দূরের কথা, গুরুজন ঘুমিয়ে পড়ার আগে কথা বলারই সুযোগ ছিল না। এখন ধানের ব্যবসা নেই। বেকার যুবসম্প্রদায়ের প্রায় সবাই বিদেশ। এলপি গ্যাসের চুলায় রান্না। স্বামীর সাথে ২৪ ঘণ্টা মোবাইল যোগাযোগসহ বিদেশে থেকে প্রেরিত টাকা ও মালামাল উত্তোলনের জন্য মাঝে মধ্যে যেতে হয় শহরে। স্বামীর সাথে কথা বলার পাশাপাশি সুযোগ নেয় পাড়া-পড়শিসহ জানা-অজানা বন্ধুবান্ধবও। পতিহীন পতœীর দিকে সবাই বাড়িয়ে দেয় ‘সাহায্যের হাত’। কামারের হাঁপরের উষ্ণতা যেভাবে কঠিন লৌহখণ্ডকে গলিয়ে ফেলে, সেভাবে সাহায্যকারীদের সুললিত কথার উষ্ণতায় কোমল নারীহৃদয় গলতে থাকে মোমের মতো। অনেক সহজ-সরল নারীর হৃদয় গলে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। তাই অনেকেই বিপথে পা বাড়ায়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতিটি ধারকই যেন এক-একজন ইন্টারন্যাশনাল রিপোর্টার। ঘরের রান্নার ছবিও মুহূর্তে ছড়িয়ে দেয় বিশ্বে। এমন কিছু ছবি ও ঘটনা রয়েছে, যা শিশুসহ অপরিণত বয়সের ছেলেমেয়েদের মনে জানার আগ্রহ সৃষ্টি করে। বিষয়গুলো ভাইরাল হয়ে কোমলপ্রাণে ভাইরাস আকারে সংক্রমিত হতে শুরু করে। যেমনÑ এবার জামালপুরের ডিসির ভিডিও।
প্রযুক্তির আরেক বিস্ময় ইন্টারনেট। গ্রহ-নক্ষত্রের দূরত্বের হিসাব যেমন মিলিয়ে শেষ করা যায় না, তেমনি শেষ করা যায় না নেটের বিস্ময়ের হিসাবও। বিশ্বের সব সংস্কৃতির আধার এই ইন্টারনেট। হাতের মুঠোয় থাকা যন্ত্রটি অনেকটা আলাদিনের চেরাগের দৈত্যের মতো কাজ করে। ‘সামনে চাই’ বলে বাটন টিপলে পলকের মধ্যে চোখের সামনে চলে আসবে বিদেশী সংস্কৃতিসহ ইংল্যান্ডের রানীর শয়নকক্ষও।
যুবসমাজ আগের অবস্থায় ফিরে না আসার ‘কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে দিয়েছে’ ইন্টারনেটের অপসংস্কৃতি। এক দেশে যা সংস্কৃতি, অপর দেশে তা অপসংস্কৃতি। অপসংস্কৃতি বানের পানির মতো ঢুকছে আমাদের চিরায়ত ধর্ম, পরিবার ও সামাজিক সংস্কৃতিতে। এ বিষয়ে বেইজিংয়ের চীন যৌনবিদ্যা সংগঠনের মহাসচিব হু পাচিং বলেন, ‘আগে সমাজের মধ্যে ন্যায় ও অন্যায়বোধ ছিল। এখন আমরা যা চাই, তা-ই করতে পারি।’ চায়না টুডে পত্রিকার এক প্রবন্ধে প্রকাশ, ‘বিয়ের বাইরে যৌনসম্পর্ক করার প্রতি সমাজ আরো বেশি প্রশ্রয়ী হয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে যেন, প্রত্যেকে তাদের কাপড় খুলে নিয়ে যৌনতাকে কোনো কিছু বিক্রয় করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।’
সম্প্রতি ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ার পোস্ট বলেছে, ‘প্রায় এক প্রজন্ম আগেও এ ধরনের কাজগুলো দেখে অনেক লোক ক্রুদ্ধ হতো, যাদের নীতিবোধ ছিল। আজকে আমরা কল্পনাসাধ্য প্রতিটি দিক থেকে যৌনচিত্রগুলো দ্বারা জর্জরিত আর পর্নোগ্রাফি সমাজে ব্যাপকভাবে গৃহীত।’ সেই সংবাদপত্র আরো বলেছে, এসব বিষয়বস্তু আগে কেবল ১৮ বছরের বেশি বয়সী পাঠকদের জন্য নিরাপদ বলে মনে করা হতো, সেগুলো এখন পরিবারিকভাবে দেখা স্বাভাবিক হয়ে পড়েছে আর পর্নোগ্রাফি তা প্রায়ই সরাসরি ছোটদের লক্ষ্যবস্তু বানায়।’
মিরপুর পুলিশ স্টাফ কলেজে একটি আলোচনা সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘অনেককেই দেখি সারা দিন ফেসবুকে থাকে। ফেসবুকে আসক্তি হয়ে গেছে। তারা সারা দিনই ফেসবুকে থাকে। গতকাল এক ছাত্রনেতা এসে আমাকে বলছিল, গুলশান মসজিদের ইমাম তার বয়ানে বলেছেন, এটা সোস্যাল মিডিয়া না, সোস্যাল কোকেন। এ সোস্যাল কোকেন থেকে আমাদের রক্ষা পেতে হবে।’ সত্যিই যেন অঘোষিত এক মাদক। মাদক ছাড়া চলে, কিন্তু মোবাইল ছাড়া চলে না এক মুহূর্ত। ছয় মাসের শিশুর কান্না থামানো থেকে শুরু করে ষাট বছরের বৃদ্ধের হাতে মোবাইল চাই। মোবাইল, নেট ও বিদেশী নাটক-সিরিয়ালের মাধ্যমে বানের পানির মতো হু হু করে অপসংস্কৃতি প্রবেশ করছে আমাদের সমাজে।
নিউ ইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিন এক প্রবন্ধে বলেছিল : ‘কিছু কিশোর-কিশোরী তাদের যৌন অভিজ্ঞতাগুলো সম্বন্ধে এতটাই নির্দ্বিধায় কথা বলে থাকে, যেন তারা রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাদ্যতালিকা নিয়ে কথা বলছে।’ টুইনস নিউজ থেকে জানা যায়, কাঁচা হাতে একজন অল্পবয়স্ক মেয়ে এক হৃদয়বিদারক বার্তা লিখেছিল : ‘আমার মা আমাকে বাইরে গিয়ে ছেলেদের সাথে ডেটিং এবং যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে চাপ দিচ্ছে। আমার বয়স মাত্র ১২ বছর, দয়া করে আমাকে সাহায্য করুন!’
গত কয়েক দশকে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে খুব দ্রুত নৈতিক অধঃপতন ঘটেছে। তা দেখে এক সময়ের চীনা প্রবচনÑ Money is lost, nothing lost; Health is lost, something is lost; Character lost, everything is lost.Õ স্বয়ং চিনেই উল্টে গিয়ে শুরু হয়েছেÑ Character lost, nothing lost; Health lost, something lost; Money lost, everything lost.
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক


আরো সংবাদ



premium cement