১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দুর্নীতির মহোৎসব

-

দেশে দুর্নীতি এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীন। রাষ্ট্রের সব সেক্টরেই চলছে দুর্নীতির মহোৎসব। দুর্নীতিবাজরা এখন রাজরাক্ষস ‘কালকেতু’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। জাতি হিসেবে আমাদের যতটুকু অর্জন তার সবই ম্লান করে দিচ্ছে সর্বনাশা দুর্নীতি। আমাদের দেশ ২০০৫ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল প্রকাশিত তালিকায় বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল, যা বহির্বিশে^ আমাদের সম্মানহানি ঘটিয়েছে। কিন্তু যাদের কারণে আমরা এ খেতাব পেয়েছিলাম তারা কিন্তু সব সময়ই অধরাই থেকে গেছে। মূলত ভোগবাদী মানসিকতা, অনিয়ন্ত্রিত উচ্চাভিলাষ এবং ক্ষেত্রবিশেষে অভাব দুর্নীতির পেছনে দায়ী বলে মনে করা হয়। তবে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ভোগবাদী মানসিকতা ও আত্মপূজাই এ জন্য প্রধানত দায়ী। কিন্তু এ অশুভ বৃত্ত থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারছি না।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে অনিয়ম ও দুর্নীতি অতীতের সব সীমা অতিক্রম করেছে। বর্তমান সরকারের আমলে দুর্নীতি যেভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে, তা আর কখনো দেখা যায়নি। সাবেক অর্থমন্ত্রীর ‘স্পিডমানি’ আর সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর ‘সহনীয় মাত্রা’ এবং সেতুমন্ত্রীর ‘ছিঁচকে তত্ত্ব’ তার বাস্তব প্রমাণ। বস্তুত, রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলোÑ দুর্নীতিসহ সব অপরাধপ্রবণতা নিয়ন্ত্রণে রাখা। কিন্তু দেশে অনিয়ম-দুর্নীতি সর্বনাশা রূপ নিলেও সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি নিয়ে রহস্যজনকভাবে নীরব থাকছেন। রূপপুরের ‘বালিশ’, ফরিদপুরের ‘পর্দা’ আর চট্টগ্রামের ‘টিন’ কেলেঙ্কারি সে দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে। রেলওয়ে প্রকল্পের চার লাখ ২০ হাজার টাকা বেতনের সৌভাগ্যবান ক্লিনারের কথাও কারো অজানা নয়। তার সাথে যুক্ত হয়েছে সরকারি ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও জাবি ভিসির প্রীতি ম্যাচ। গণমাধ্যমে ইতঃপূর্বে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে যে, এই ‘ত্রয়ী’র কারণেই জাবিতে দুর্নীতির মহোৎসব শুরু হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করেই এতে ছন্দপতনও ঘটেছে।
মনে করা হচ্ছে ভাগবাটোয়ারা নিয়ে মনোমালিন্য হওয়ায় এমনটি হয়েছে। আর স্বার্থের দ্বন্দ্বের কারণে ছিটকে পড়তে হয়েছে ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতাকে। বিষয়টি নিয়ে একে অপরকে দোষারোপ করলেও কেউ যে ধোয়া ‘তুলসী পাতা’ নন তা এর মধ্যেই প্রমাণ হয়েছে। ইতোমধ্যে শোভন-রাব্বানীর বিদায় নিশ্চিত হলেও জাবি ভিসি ফারজানা ইসলাম নাকি বিদায়ের প্রহর গুনছেন বলে শোনা যাচ্ছে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে অনিয়মের মাধ্যমে ছাত্র ভর্তির অভিযোগ উঠেছে খোদ ভিসির বিরুদ্ধে। এর আগে ডিআইজি প্রিজন পার্থ গোপাল বণিক ঘুষের ৮০ লাখ টাকাসহ হাতেনাতে গ্রেফতার হয়েছেন, যা আমাদের অবক্ষয়ের প্রান্তিকতা, দুর্নীতি এবং দুর্নীতিবাজদের সরব ও নির্বিঘœ পদচারণার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
সব সরকারই দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ক্ষমতায় আসে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, শেষ পর্যন্ত তাদের দুর্নীতিবাজ তকমা নিয়ে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়। বর্তমান সরকারের গত মেয়াদের শেষপর্যায়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইনে একটি অসাংবিধানিক ও বৈষম্যমূলক ধারা সংযুক্ত করা হয়। এতে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণে দুদকের জন্য সরকারের পূর্বানুমতি নেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। হয়রানিমূলক বা রাজনৈতিক বিবেচনা ছাড়া এরূপ পূর্বানুমতি প্রাপ্তি যে অকল্পনীয়, তা নিয়ে কেউই সন্দেহ পোষণ করেন না।
মূলত সদিচ্ছার অভাব, নেতিবাচক রাজনীতি ও সুশাসনের অনুপস্থিতির কারণেই এ ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন প্রায় শূন্যের কোঠায়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচকের ০-১০০ স্কেলে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ ২৭ পয়েন্ট পেয়েছে, যা বৈশ্বিক গড় ৪৩-এর তুলনায় অনেক কম। বাদ নেই রাষ্ট্রের সেবা খাতও।
দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতা শুধু আর্থসামাজিক উন্নয়নকেই ব্যাহত করছে না বরং রাজনৈতিক অঙ্গনে সহিংসতা এবং অস্থিতিশীলতার ব্যাপকতর বিস্তার ঘটিয়ে সুশাসন ও জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাও তিরোহিত হচ্ছে।
‘জাতীয় খানা জরিপ ২০১৭’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রাষ্ট্রীয় সেবা পেতে হলে ঘুষ দিতে হয়। এ দিক থেকে সবার শীর্ষে রয়েছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। দ্বিতীয় ও তৃতীয়তে আছে যথাক্রমে পাসপোর্ট ও বিআরটিএ। তবে টাকার অঙ্কে সবচেয়ে বেশি ঘুষ নেয় বিআরটিএ। বিভিন্ন ধরনের সেবা পেতে বছরে ঘুষ দিতে হয় ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। দেশের আইনশৃঙ্খলা সংস্থা, পাসপোর্ট ও বিআরটিএ, ভূমি অফিস, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, পুলিশ স্টেশন, আদালতপাড়া থেকে শুরু করে সবখানেই অনেকটা রাখঢাক না রেখে প্রকাশ্যেই ঘুষ গ্রহণের মহড়া চলছে।
জরিপের তথ্য মতে, ২০১৭ সালে সার্বিকভাবে দেশের ৬৫ দশমিক ৫ শতাংশ খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে। ১৬ সেবা খাতের মধ্যে সর্বোচ্চ ৭২ দশমিক ৫ শতাংশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায়, পাসপোর্ট ৬৭ দশমিক ৩ শতাংশ এবং বিআরটিএতে ৬৫ দশমিক ৪ শতাংশ এবং বিচারিক সেবায় ৬০ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। ২০১৭ সালে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার প্রশাসন, ভূমি, কৃষি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, বিচারিক সেবা, বিদ্যুৎ, ব্যাংকিং, বিআরটিএ, কর ও শুল্ক, এনজিও, পাসপোর্ট, বীমা, গ্যাস সেবা খাতে এ জরিপ করেছে টিআইবি। প্রাপ্ত তথ্য মতে, ২০১৬ সালে সার্বিকভাবে ঘুষ দিতে বাধ্য হওয়া খানার হার ৪৯ দশমিক ৮ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ঘুষ গ্রহণকারী তিনটি খাত হচ্ছেÑ বিআরটিএ (৬৩ দশমিক ১ শতাংশ), আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা (৬০ দশমিক ৭ শতাংশ) ও পাসপোর্ট সেবা (৫৯ দশমিক ৩ শতাংশ)। ২০১৭ সালে খানাপ্রতি গড়ে পাঁচ হাজার ৯৩০ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ঘুষ আদায়কারী খাত হলোÑ গ্যাস (৩৩ হাজার ৮০৫ টাকা), বিচারিক সেবা (১৬ হাজার ৩১৪ টাকা) ও বীমা খাত (১৪ হাজার ৮৬৫ টাকা)। ২০১৫ সালের তুলনায় এই ঘুষের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যহারে বেড়েছে গ্যাস, কৃষি ও বিচারিক খাতে। আর কমেছে শিক্ষা, পাসপোর্ট ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান খাতে।
রাষ্ট্রের এমন কোনো বিভাগ নেই যেখানে দুর্নীতির উপস্থিতি নেই। বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সর্বসাম্প্রতিক টিআইবির প্রতিবেদনে। সম্প্রতি ভূমি নিবন্ধনে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটির এ প্রতিবেদনে ভূমি নিবন্ধনের ক্ষেত্রে নানা অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে, যা আত্মসচেতন মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। এতে বলা হয়েছে, এ খাতে দুর্নীতি রোধের চেষ্টা করা হলেও দুর্নীতি কমেনি, বরং বেড়েছে। দলিল নিবন্ধনে দুর্নীতি এখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। এ সেবায় ক্রমাগত দুর্নীতি বেড়েই চলেছে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, দেশব্যাপী কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া দেশের সব ‘দলিল লিখন’ অফিসের ঘুষ লেনদেন বিষয়টি এখন স্বাভাবিক চিত্র। গবেষণাপত্রে বলা হয়, একটি দলিলের নকল তুলতে সেবাগ্রহীতাদের গুনতে হয় এক থেকে সাত হাজার টাকা। আর দলিল নিবন্ধনের জন্য দলিল লেখক সমিতিকে চাঁদা দিতে হয় পাঁচ শ’ থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়াও, ভূমির আকার ও এলাকা ভেদে এ টাকার পরিমাণ অনেক সময় বেশিও হয়ে থাকে। আর দলিল নিবন্ধনের ক্ষেত্রে নিয়ম বহির্ভূতভাবে গুনতে হয় এক হাজার থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত।
মূলত ঘুষ ছাড়া রাষ্ট্রের কোনো সেবা পাওয়া খুব সহজসাধ্য নয়; বরং প্রায় ক্ষেত্রে তা অনেকটাই বাধ্যতামূলক হয়ে গেছে, যা আমাদের জাতিসত্তাকে হীনবল করতে করতে এখন রীতিমতো অস্তিত্ব সঙ্কটেই ফেলে দিয়েছে। দুর্নীতি দমনে প্রতিষ্ঠিত ‘দুর্নীতি দমন কমিশন’ ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ‘আইনশৃঙ্খলাবাহিনী’র বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ দেশ ও জাতির জন্য কোনো ভালো খবর নয়। আর অপরাধ দমনে দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো নিজেরাই যদি অপরাধপ্রবণতা, দুর্নীতি ও অনিয়মের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে, তাহলে জাতি হিসেবে আমাদের গন্তব্য কোথায়Ñ তা ঠাওর করা মোটেই কষ্টসাধ্য নয়। হ
ংসসলড়ু@মসধরষ.পড়স


আরো সংবাদ



premium cement