২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

স্ম র ণ : বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ইউসুফ চৌধুরী

-


চট্টগ্রামের দৈনিক পূর্বকোণ সম্পাদক শ্রদ্ধেয় আলহাজ মরহুম ইউসুফ চৌধুরী সম্পর্কে কিছু লিখতে বারবার বিবেকের তাগাদাবোধ করছিলাম। তিনি আমার মায়ের জেঠাত বোনের স্বামী। নানাবাড়ির সব মা-খালার মধ্যে খালুজান সবার বড় জামাতা এবং সবার প্রিয়জন ছিলেন। মরহুমা জোহরা বেগম ও ইউসুফ চৌধুরী দম্পতির তিন পুত্র তসলিম, জসিম, বাচ্চু (ডা: রমিজ)। চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার সুলতানপুর গ্রামে আমাদের নানাবাড়ি। তাদের বাড়িতে বহুবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। মরহুম ইউসুফ চৌধুরীর বাড়ি একই গ্রামে অবস্থিত। এই সুন্দর গ্রামটি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত বিধায় সুপরিচিত। আম্মার মুখে ছোটবেলা থেকে মরহুমের তিন ছেলের প্রশংসা শুনতাম। তাদের প্রেরণায় দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকায় নিয়মিত লেখালিখি শুরু করি। ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি সফল ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও সমাজসেবক ইউসুফ চৌধুরীর নাম। ১৯৪৫ সালে সামান্য মূলধন নিয়ে বইয়ের ব্যবসা শুরুর মাধ্যমে সততা, নিষ্ঠা, কঠোর পরিশ্রম, ত্যাগ, বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তাÑ সর্বোপরি আল্লাহর রহমত তার জীবনকে সাফল্যের শিখরে নিয়ে যায়। শিক্ষার প্রতি অনুরাগ থেকেই তিনি বইয়ের ব্যবসায় জড়িত হন। চট্টগ্রামের প্রেস, প্রকাশনা ও মুদ্রণ শিল্পে তার সুনাম দীর্ঘ দিনের। আধুনিক প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রি, ওষুধ শিল্পসহ চট্টগ্রামের বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান তিনি গড়ে তোলেন। সিগনেট প্রেস, নিউজফ্রন্ট ও ইউসুফ চৌধুরী এ তিনটি নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমার পিতা অ্যাডভোকেট মরহুম আবু মোহাম্মদ য়্যাহ্য়্যা থেকে শুনেছি, ছাত্রজীবনে তিনি ‘নিউজফ্রন্ট’ থেকে বই কিনতেন ও ভাড়ায় আনতেন। রিডার্স ডাউজেস্টসহ পৃথিবীর বহু নামী-দামি ম্যাগাজিন ইউসুফ চৌধুরীর নিউজফ্রন্টে পাওয়া যেত। যেমনÑ পাকিস্তানের করাচি থেকে প্রকাশিত ডন গ্রুপের পত্রিকা ‘ইলাস্ট্রেটেড উইকলি’, ভারতের স্টেটসম্যান পত্রিকা, ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘ডন’ গ্রুপের নিউজ, পাকিস্তান অবজারভার প্রভৃতি পত্রিকার তিনি এজেন্ট ছিলেন। নিউজফ্রন্ট ছিল বিজ্ঞজনদের মিলনমেলা। ইউসুফ চৌধুরী ১৯৫৪ সালের মুদ্রণশিল্প সিগনেট প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি পেঙ্গুইন ও পেলিকান প্রকাশিত পেপার ব্যাক বইপত্র আমদানি শুরু করেন। মুদ্রণ শিল্প থেকে আধুনিক সংবাদপত্র শিল্পের সফল নায়ক ইউসুফ চৌধুরী। স্মর্তব্য, ১৯৩৩ সালে কবি নজরুল তৃতীয়বারের মতো চট্টগ্রাম এসে তাদের বাড়িতে অবস্থান করে দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত এক সাহিত্য সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। সম্মেলনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ছিল কবিগান ও আবৃত্তি। নজরুল স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহ্যবাহী ‘হাজী বাড়ি’তে ১৯২২ সালে ইউসুফ চৌধুরীর জন্ম। তিনি ১৯৪৩ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। চল্লিশের দশকে সক্রিয়ভাবে ঐতিহাসিক পাকিস্তান আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। সাহিত্যসংস্কৃতির পাদপীঠ রাউজান দৈনিক আজাদী সম্পাদক আলহাজ প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ, দৈনিক পূর্বকোণ প্রতিষ্ঠাতা ইউসুফ চৌধুরীর মতো বহু ব্যক্তিত্বের জন্মভূমি। সুপরিচিত সিগনেট প্রেস দেশের মুদ্রণ শিল্পে একটি অতি পরিচিত নাম। এর সাফল্য হিসেবে ঘটে দৈনিক পূর্বকোণের মতো আধুনিক সংবাদপত্র শিল্পের উত্থান। ইউসুফ চৌধুরী সফল ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সংবাদপত্র শিল্পের নায়ক ও সর্বোপরি মানবদরদি ব্যক্তি ছিলেন। একাধিক শিল্পের প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি কঠোর পরিশ্রম ও সাধনা করেছেন। তার জীবন ও কর্ম, ব্যবসায় উদ্যোগ ও ব্যবহারিক ব্যবস্থাপনাকে ‘কেস স্টাডি’ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত শিল্পোদ্যোক্তা পরিচিতি বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আর্থিক সঙ্কট থাকা সত্ত্বেও যোগ্যতায় ও শ্রম সাধনায় কিভাবে একজন মানুষ অসাধারণ ব্যবসায়িক সাফল্য অর্জন করতে পারে, ইউসুফ চৌধুরী তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। চট্টগ্রাম শহরের সমবায় সমিতি সদনের সামনে মাসিক ১৮ টাকায় ছনের তৈরি দোকান ভাড়া নিয়ে ২০০০ টাকা পুঁজি বিনিয়োগে মনোহারী দোকান শুরু করেছিলেন। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন দেশী-বিদেশী পত্রিকার এজেন্সি নেয়া, মাসিক ৯ টাকা ভাড়ায় পাশে নিউজফ্রন্ট প্রতিষ্ঠা, ২০ জন লোক নিয়ে সিগনেট প্রেস প্রতিষ্ঠা, ১৯৬০ সালে চার লাখ টাকা ঋণ নিয়ে মেশিনারি আমদানি, জুবিলী রোডে বুক সোসাইটি ভবন ভাড়ায় নিয়ে প্রেস প্রতিষ্ঠা, ১৯৬০ সালে বিদেশ থেকে এনে প্রিন্টিং ও কাটিং মেশিন চালু, সম্ভাবনাময় লেখকদের বই ছাপানো ও প্রকাশনা ব্যবসা, ১৯৬৭ সালে প্যাকেজিং ব্যবসার সম্প্রসারণ, ১৯৬৯ সালে চার লাখ টাকা ঋণ নিয়ে মেশিনারি আমদানি, বুক সোসাইটি ভবন ভাড়ায় নিয়ে প্রেস ও প্যাকেজিং ইউনিট প্রতিষ্ঠা, ১৯৮৪ সালে এক কোটি টাকা বিনিয়োগে বিসিক শিল্প নগরীতে সিগনেট বক্স ইন্ডাস্ট্রি স্থাপন, ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে দৈনিক পূর্বকোণ প্রকাশ তার সাফল্যের শিখরে ওঠার নজির। তিনি উপলব্ধি করেন যে, সফল উদ্যোক্তার কয়েকটি গুণ অপরিহার্য। সেগুলো হলো প্রতিষ্ঠানের ঘনিষ্ঠ তত্ত্বাবধান, ব্যবসায়িক সুযোগ-সুবিধা পূর্বানুমান করার ক্ষমতা, ব্যবসায় সম্প্রসারণের পরিকল্পনা, যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে কর্মচারী নিয়োগ, বিপণনের জন্য সঠিক পদ্ধতির ব্যবহার ইত্যাদি। এসব গুণ তার ছিল। তিনি উল্লেখ করেছেন, সফল উদ্যোগের পথে অন্যতম অন্তরায় হলো সঠিক পরামর্শ ও নির্দেশনার অভাব। একাধারে বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন এ দুর্লভ ব্যক্তিত্বের বর্ণাঢ্য জীবনালেখ্য সংক্ষেপে শেষ করা যাবে না। তার বাবাও একজন সমাজকর্মী ও ধর্মানুরাগী ছিলেন। তার তিন পুত্র যথাক্রমে প্রকৌশলী তসলিম, জসিম (এমবিএ), ডা: রমিজ (বাচ্চু)। তাদের উচ্চ শিক্ষিত করে আদর্শ যোগ্য মানুষ হিসাবে গড়ে তোলেন। পুত্রবধূদের কন্যাতুল্য স্নেহ মমতা করেন। ধনাঢ্য পরিবারের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাদের সহজ সরল কর্মঠ জীবনযাপনে অভ্যস্ত করেন। তার জীবনের সব সাফল্যের পেছনে স্ত্রীর অবদান ও প্রেরণাকে সর্বদা স্বীকার করতেন। সবার সুখে দুঃখে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। মুদ্রণ ও সংবাদপত্র শিল্পে পাশাপাশি তিনি বৃহত্তর চট্টগ্রামের উন্নয়ন, ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আন্দোলন, মৎস্য ও কৃষিসম্পদ উন্নয়ন খাতে ব্যাপক অবদান রাখেন। বৃদ্ধ বয়সেও তিনি নিয়মিত অফিস করতেন, জনসংযোগ রক্ষা করতেন, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সময় দিতেন। আলেমদের শ্রদ্ধা করতেন। আরাম আয়েশে দিন কাটানোর সুযোগ থাকলেও তিনি সময়ানুবর্তিতা বজায় রেখে কাজের মধ্যে সময় কাটাতেন বেশি। গ্রাম উন্নয়ন ও সমাজসেবায় তিনি যুবকদের উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি সংবাদপত্রসেবীদের জন্য ছিলেন এক বিশাল বটবৃক্ষ তুল্য। ইউসুফ চৌধুরী তার প্রতিষ্ঠানগুলোতে বহু মানুষের কর্মসংস্থান করেছেন। দরিদ্র মানুষের সেবায় এবং মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানায় তিনি ব্যাপক দানখয়রাত করতেন।
ইউসুফ চৌধুরীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের রাউজান হাজী বাড়িতে আগমনের ৬৭তম বার্ষিকীতে বাড়ির সামনে, রাস্তা ও স্কুলের পাশে স্থাপিত হয়েছে ‘নজরুল স্মৃতিফলক’। তা ছাড়া চট্টগ্রামের আনাচে কানাচে তিনি ডেইরি ফার্ম ও ডেইরি আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি ছিলেন আধুনিক চট্টগ্রামের স্বপ্নদ্রষ্টা। ওমরাহ্ পালন করতে গিয়ে গত ৯ সেপ্টেম্বর পবিত্র মক্কায় হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন। বুধবার সকালে পবিত্র কাবা শরিফে মসজিদুল হারামে ফজরের নামাজের পর জানাজা শেষে তাকে মক্কায় জান্নাতুল মাওয়ায় দাফন করা হয়। এ শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। মহান স্রষ্টা তাকে জান্নাতবাসী করুন। আমিন। হ
লেখক : আইনজীবী, সুশাসন ও মানবাধিকার কর্মী

 


আরো সংবাদ



premium cement