২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কাশ্মিরে দখলদারিত্ব, উত্তর-পূর্বে উত্তেজনা ও বৈশ্বিক জনমত

অবলোকন
-

ভারতনিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসন বিলুপ্ত করে দখলদারিত্বের এলাকা হিসেবে মোদি সরকার এটিকে কেন্দ্রীয় শাসনের আওতায় এনেছে। আর এ জন্য ভারতকে কতটা মূল্য দিতে হবে, এ নিয়ে বেশ হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে দেশটির ভেতরে ও বাইরে। ভারতীয় লোকসভা ও রাজ্যসভায় সরকারের এই পদক্ষেপের সমালোচনা করছেন বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা। সমালোচনা হচ্ছে বৈশ্বিক ফোরামগুলোতেও। পাকিস্তানের আহ্বানে ও চীনের জোরালো সমর্থনে বিষয়টি নিয়ে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ জরুরি বৈঠকে বসেছে।

সব বিশ্বশক্তি এক পক্ষে!
জরুরি বৈঠকে নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্য দেশই ভারত ও পাকিস্তানকে ‘পরস্পরের সাথে আলোচনা করে’ এই সঙ্কটের সুরাহা করতে বলেছে। অথচ ভারত সর্বশেষ পদক্ষেপের পরে বলে আসছিল যে, এটি ভারতের একান্তই অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ নিয়ে অন্য কারো সাথে আলোচনার কোনো অবকাশ নেই। এর সাথে রাশিয়া প্রথম দিকে একমত পোষণ করলেও শেষ পর্যন্ত মস্কোও পাকিস্তানের সাথে আলোচনা করে এই সঙ্কট নিরসন করতে বলেছে নয়াদিল্লিকে।
কাশ্মির ইস্যু নিয়ে মোদি সরকার দেশটির অভ্যন্তরে হিন্দুত্ব জাগিয়ে তোলার ব্যাপারে কিছুটা সফল হলেও বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে তেমন কোনো সাড়া পাচ্ছে না। এর আগে ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) জরুরি অধিবেশনে কাশ্মিরে ভারতের একতরফা পদক্ষেপে নিন্দা ও উদ্বেগ জানানো হয়েছে। ইসলামী দেশগুলোর মধ্যে ইরান ও আরব আমিরাত থেকে দিল্লি কিছুটা সমর্থন আশা করেছিল। আমিরাতের রাষ্ট্রদূত প্রথম দিকে এটি ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে উল্লেখ করেছিলেন, কিন্তু পরে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওআইসির অবস্থানকে গ্রহণ করে নেয়। অন্য দিকে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কঠোর ভাষায় কাশ্মির পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের সমালোচনা করেছে। দেশটির প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতারা ক্রমেই এই ইস্যুতে সোচ্চার হতে শুরু করেছেন।
কাশ্মির ইস্যু নিয়ে শুধু দক্ষিণ এশিয়াতেই নয়, বিশ্বব্যাপী যে ঝড় উঠতে পারে তার লক্ষণগুলো সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। ভারতের কাশ্মির পদক্ষেপের দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে বিশ্ব মিডিয়ায় কাশ্মির নিয়ে ভারতের পদক্ষেপের চুলচেরা বিশ্লেষণ এবং এর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। আমেরিকান ফরেন পলিসি সাময়িকীতে এ নিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
এই সাময়িকীর মতে, সাম্প্রতিক দু’টি ঘটনা সম্ভবত মোদি সরকারকে এ সময়ে কাজটি করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। এর প্রথমটি ছিল মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাশ্মির বিরোধে মধ্যস্থতার প্রস্তাব। দ্বিতীয়টি হলো, দ্রুত অগ্রগতিশীল আফগানিস্তান শান্তি প্রক্রিয়া। এটি ইসলামাবাদের বিশেষ সহযোগিতায় এগিয়ে যাচ্ছিল, যার পরিণামে আফগানিস্তানে রাজনৈতিক সমঝোতা হয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। আর এটি তালেবানকে সরকারে একটি বিশিষ্ট ভূমিকায় নিয়ে আসবে, যার প্রতিটি উন্নয়ন পাকিস্তানের হাতকেই কার্যত শক্তিশালী করতে পারে। কাশ্মির নিয়ে নাটকীয় পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমে নয়াদিল্লি ইসলামাবাদকে এ ব্যাপারে কিছুটা হলেও পিছিয়ে রাখতে সক্ষম হবে বলে ভারতের নীতিপ্রণেতাদের ধারণা। এর মাধ্যমে বাইরের মধ্যস্থতার প্রতি নয়াদিল্লির সম্পূর্ণ অনাগ্রহের বিষয়ে ওয়াশিংটনের কাছে একটি জোরালো বার্তাও দিতে চাইতে পারে ভারত।
ফরেন পলিসি সাময়িকীর মতে, ঘরোয়া রাজনীতিও মোদির এ কাজের পেছনে ভূমিকা রেখেছে। সদ্যনির্বাচিত বিজেপির প্রথম দিকের পদক্ষেপটি তার মর্যাদা বাড়াবে এবং ভোটভিত্তির কাছ থেকে বাড়তি সমর্থন জোগাতে পারে। আর এ ধরনের সমর্থন ক্রমবর্ধমান কর্মসংস্থানসঙ্কটকে কাটাতে সরকার যে লড়াই করে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে সম্ভাব্য হতাশা এবং ক্ষোভকে আড়াল করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, এটি কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয় যে, বিজেপি তার পূর্ববর্তী মেয়াদের পর তার ‘সমর্থক ঘাঁটি’ থেকে সমর্থন আকৃষ্ট করার জন্য আরো একটি নিশ্চিত উপায় হিসেবে হিন্দু জাতীয়তাবাদী নতুন কৌশল বের করেছে। এটি প্রতিশ্রুত আর্থিক সংস্কারের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ব্যর্থ সংগ্রামের পরে হাজির করা হয়েছে।
ফরেন পলিসি মনে করছে, সংবিধানের ধারা ৩৭০ বাতিল করা হবে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। ভারত একতরফাভাবে কাশ্মিরের মতো অত্যন্ত বিতর্কিত অঞ্চলের মর্যাদা পরিবর্তন করছে, যা বিশ্বের সর্বাধিক সামরিকীকরণকৃত স্থানের একটি। নয়াদিল্লি এটি বুঝতে পেরেছে যে, এর জন্য মূল্য দিতে হবে। এ কারণেই এ বিষয়ে ঘোষণার আগে একটি কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থাও গ্রহণ করে রেখেছিল।
অনেক কাশ্মিরির জন্য, অনুচ্ছেদ ৩৭০-এর ব্যবহারিক অর্থের চেয়ে প্রতীকী গুরুত্ব বেশি ছিল। ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর দীর্ঘকালীন দমনপীড়ন স্বায়ত্তশাসনের ধারণাটির গুরুত্ব কমিয়ে দিয়েছিল। নিরাপত্তা কর্মীদের কাছ থেকে নিয়মিত দমনপীড়নের শিকার হওয়ার পাশাপাশি অনেক কাশ্মিরি তাদের মত প্রকাশ এবং চলাচলের ওপর প্রতিদিনের বিধিনিষেধের মুখোমুখি হন। তবুও অনেক কাশ্মিরি মুসলমান, জম্মু ও কাশ্মিরের প্রভাবশালী দল এবং ভারতীয় দখলদারিত্বের শিকার ভুক্তভোগীদের জন্য অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিল করা একটি দুঃস্বপ্নের দৃশ্য। কারণ, এটি তাদের এমন একটি ভারতীয় রাষ্ট্রের আরো কাছে নিয়ে এসেছে, যাতে তারা অব্যাহত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হবেন। তাদের বেশির ভাগই এখন ভারতীয় শাসনমুক্ত থাকতে চান বলে ফরেন পলিসি উল্লেখ করেছে।
ফরেন পলিসির এই মূল্যায়নে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ কতটা রয়েছে তা নিয়ে যে কেউ বিতর্ক তুলতে পারেন। তবে যারা নিউ ইয়র্ক টাইমস বা ওয়াশিংটন পোস্টের মতো যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংবাদপত্রের কাশ্মির বিষয়ক লেখাগুলো পড়বেন, তারা বুঝতে পারবেন মোদির পদক্ষেপকে আমেরিকান ডিপস্টেট ইতিবাচকভাবে নেয়নি। আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে ট্রাম্প প্রশাসন ভারত ও পাকিস্তান পরস্পরের সাথে আলোচনা করে এই সমস্যার সমাধান করার কথা বলেছে। ট্রাম্প বারবার এই ইস্যু নিয়ে মধ্যস্থতার কথা বললেও চীন-রাশিয়ার মতো সুস্পষ্ট অবস্থান যুক্তরাষ্ট্র না-ও নিতে পারে। ওয়াশিংটনের এখন এক দিকে শান্তিপূর্ণভাবে আফগানসঙ্কট সমাধানের জন্য পাকিস্তানের প্রয়োজন; অন্য দিকে প্রতিরক্ষা সামগ্রী বিক্রির জন্য ভারতকে বৈরী না করার বিষয়টিও দেশটির সামনে রয়েছে। ফলে দেশটি একটি মধ্যবর্তী অবস্থান নিতে পারে, আর এই অবস্থান শেষ পর্যন্ত দিল্লির বিপক্ষেই যাবে।

চীনের শক্ত অবস্থান
বিশ্ব শক্তিগুলোর মধ্যে এখন চীন ও রাশিয়া যেকোনো আন্তর্জাতিক সঙ্কটের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দেশ। অতি সম্প্রতি ভারতের বিদেশমন্ত্রী সুব্রাহ্মণিয়াম জয়শঙ্কর চীন সফর করেন। অবশ্য কাশ্মির পদক্ষেপের আগেই এই সফরের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অনেকে এই সফরকে জরুরি হিসেবে বিবেচনা করেন এবং এটিকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশির সদ্যসমাপ্ত চীন সফরের সাথে সংযুক্ত করছেন। ভারত একতরফাভাবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যের স্বায়ত্তশাসনকে বাতিল করে ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদাকে পরিবর্তন করেছে; এই ইস্যুতে চীনের প্রভাবশালী সরকারি পত্রিকা গ্লোবাল টাইমসে চীনা অবস্থানের প্রতিফলন ঘটেছে। এতে বলা হয়েছে, নয়াদিল্লির ঘোষণায় চীন ও ভারতের মধ্যে বিরোধের অঞ্চলটিকেও উত্তপ্ত করা হয়েছে। ফলে এর চেইন প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। পাকিস্তান ঘোষণা করেছে, তারা ভারতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক হ্রাস করবে এবং বাণিজ্য সম্পর্ক এর মধ্যে স্থগিত করেছে। কাশ্মির ইস্যু অত্যন্ত জটিল এবং ভারতের এই পদক্ষেপ চীনের স্বার্থকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশ্যে বলেছে, ভারতের পদক্ষেপ ‘অগ্রহণযোগ্য’।
গ্লোবাল টাইমস বলেছে, নয়াদিল্লি সীমান্ত ইস্যুতে খুবই বেপরোয়া। দেশটি একতরফা ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং আঞ্চলিক পরিস্থিতির ওপর প্রভাব পড়ে, এমন স্থিতাবস্থা ভঙ্গ করে। এর পদক্ষেপগুলো আশপাশের দেশগুলোর স্বার্থকে চ্যালেঞ্জ জানায়। তবে তারা চান যে, এই দেশগুলো উসকানিমূলক আচরণকে হজম করবে এবং ভারতের তৈরি করা নতুন ব্যবস্থাকে মেনে নেবে।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির এই মুখপত্র বলেছে, জাতিসত্তা বা ধর্মের ভিত্তিতে কার্যকর একটি স্বশাসিত অঞ্চলকে কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চলে পরিবর্তন করা সব দেশেই অত্যন্ত সংবেদনশীল ব্যাপার। কাশ্মির এমন একটি বিতর্কিত অঞ্চল, যেখানে বিংশ শতাব্দীতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তিনটি বিশাল যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। পাকিস্তান বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভারতের পদক্ষেপে প্রভাবিত হয়েছে। পাকিস্তান যদি শক্তিশালী পাল্টা ব্যবস্থা না নেয় তবে তা হবে অকল্পনীয়।
পত্রিকাটি মন্তব্য করেছে, পাকিস্তান ও ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের মুসলমানদের বিরোধিতার প্রকৃত একটি পরিণতি এখানে আসতে পারে। মুসলমানরা সম্মিলিতভাবে ভারতের এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা ভারতের পক্ষে কঠিন হবে। আমরা দেখতে পাই না যে, এ অঞ্চলটি পুরোপুরি দখল করার মতো ভারতের রাজনৈতিক এবং অন্যান্য সংস্থান রয়েছে।
নয়াদিল্লির অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসের কথা উল্লেখ করে গ্লোবাল টাইমস বলেছে, ভারতের ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে মোদি প্রশাসনের ক্ষমতা এবং মর্যাদা সংহত হয়েছে বলে তারা মনে করছেন। তাদের ধারণা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পাশ্চাত্যও ভারতের সাথে থাকতে পারে। ভারতও এমন মনে করে যে, চীন বাণিজ্য যুদ্ধ এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে ব্যস্ত; তাই সীমান্ত বিষয় নিয়ে কাজ করার জন্য এটি এখন ভালো সময়। তবে এটি কোনো বড় শক্তির জন্য সঠিক কৌশল নয়। ভারতের ওপরে উঠতে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশ প্রয়োজন। এমনকি ভারত যদি তার ভূ-রাজনৈতিক কৌশল ও একতরফাবাদকে সফল করে তোলে, তবে তা নতুন বিদ্বেষকে জাগিয়ে তুলবে। দক্ষিণ এশিয়ায় একতরফাবাদ নিয়ে খেলা ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করা মোটেই বাহুল্য নয়।
গ্লোবাল টাইমসের সম্পাদকীয়ের অনুসিদ্ধান্ত হলো, ‘আঞ্চলিক, জাতিগত এবং ধর্মীয় বিরোধগুলো কাশ্মিরে এখন ঘনীভূত। এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ অঞ্চল নয়। জাতিসঙ্ঘ কাশ্মিরের মর্যাদার বিষয়ে প্রস্তাব পাস করেছিল। অঞ্চলটির প্রকৃতি পরিবর্তন করতে ভারতের বলপূর্বক পদক্ষেপটি সহজেই এগিয়ে যেতে পারার সম্ভাবনা নেই। নয়াদিল্লির একতরফা সিদ্ধান্তের প্রতি নতুন ও পুরাতন ঘৃণা সামনে দেশটিকে কঠিন ফাঁদে ফেলবে। নয়াদিল্লি যদি তার বেপরোয়া কূটনৈতিক পদক্ষেপগুলোকে সমর্থন করার জন্য জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করে, তবে একটি অত্যন্ত মন্দ স্ফুলিঙ্গের সূচনা হবে। ভারতকে ক্রমবর্ধমানভাবে উগ্রবাদী হতে হবে। আর একটি অতি জাতীয়তাবাদী ভারতের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এশিয়ার সাধারণ ভূ-রাজনৈতিক প্যাটার্ন এ জাতীয় ভারতকে গ্রহণ করবে না। যুক্তিসঙ্গত এবং বন্ধুত্বপূর্ণ প্রধান শক্তি হলে তাতে ভারতের ভবিষ্যৎ আরো উজ্জ্বল হবে।’

রাশিয়াও পাশে থাকছে না?
কাশ্মির ইস্যু নিয়ে মহাশক্তিগুলোর কাছে ভারত নিজের অবস্থানকে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারছে না। ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র আগে থেকেই কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন প্রত্যাহারকে গ্রহণ করেনি। রাশিয়াই কেবল বলেছিল, এটি ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ’ বিষয়। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে সেই অবস্থান থাকেনি। পাঁচ বিশ্বশক্তিই একযোগে বলেছে, ভারতের উচিত পাকিস্তানের সাথে আলোচনায় বসে এ ইস্যু মীমাংসা করা। দিল্লি মনে করেছিল, এস৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাসহ যেসব অস্ত্রশস্ত্র রাশিয়ার কাছ থেকে ভারত কিনছে, তাতে মস্কো দিল্লিকে সমর্থন করবে। কিন্তু দিল্লির চাইতেও অনেক কঠিন সম্পর্ক রয়েছে বেইজিংয়ের সাথে মস্কোর। ফলে রাশিয়া হিসাব-নিকাশ করেই তার অবস্থান পরিষ্কার করেছে বলে মনে হয়। ফ্রান্স ও জার্মানির মতো দেশও কাশ্মির প্রশ্নে ভারতের পাশে না থাকার কারণে দেশটির শীর্ষ নিরাপত্তা বিশ্লেষক সি রাজা মোহন গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় প্রকাশিত এক কলামে। তিনি বলেছেন, ভারতের অভ্যন্তরীণ জনমতকে প্রভাবিত করতে যে ভাষা বা কৌশল ফল দেয়, সেটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সমর্থন পেতে কাজ করে না। বরং অনেক সময় উল্টোও হতে পারে। বাস্তবেও তাই দেখা যাচ্ছে। উগ্রতা দিয়ে মোদি সরকার ভারতে এমন এক আবহ তৈরি করেছে, যাতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও কাশ্মির ইস্যুতে সমালোচনা করতে কিছুটা সতর্ক হচ্ছে। কিন্তু ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পাকিস্তানের ব্যাপারে আগে ব্যবহার না করার বিদ্যমান নীতি পরিবর্তন করে পাকিস্তানে পারমাণবিক হামলার যে হুমকি দিয়েছেন, তার তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। ইমরান খান এ ব্যাপারে বলেছেন, ভারতের উগ্র ফ্যাসিবাদী মানসিকতার বিজেপি এবং আরএসএস নেতত্বের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র থাকা বিশ্বের জন্য নিরাপদ নয়। এর মাধ্যমে ভারত জনগণকে যে এক সময় নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিল, তার এক ধরনের কবর রচনা হয়ে গেল।

পূর্ব সীমান্তেও উত্তেজনা
ভারতের উগ্র নীতি কেবল কাশ্মির বা পাকিস্তানে সীমিত থাকছে না। এর টার্গেটে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশ ও চীনের মতো প্রতিবেশীও। আকসাই চীন দখলের হুমকির বিষয়টি গ্লোবাল টাইমস আগেই উল্লেখ করেছে। ভারতের পত্রিকাসহ গণমাধ্যমের বক্তব্যে এখন বাংলাদেশও যে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে, তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত আসা শুরু হয়েছে। দুই দিন আগের (১৯ আগস্ট ২০১৯) ইন্ডিয়ান একপ্রেসে ত্রিপুরায় চাকমাদের একটি সচিত্র খবর প্রকাশ করা হয়েছে, যেখানে ত্রিপুরার ১১টি স্থানে সভা করে দাবি করা হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারত যেন তার অংশ করে নেয়। এর আগে ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ হুমকি দিয়ে রেখেছেন, ভারতের প্রতি ইঞ্চি ভূমিতে অভিযান চালিয়ে অনুপ্রবেশকারীদের ধরে তাদের দেশে (পড়–ন, বাংলাদেশ) পাঠানো হবে।
আগামী ৩১ আগস্ট আসামে ‘নাগরিক পঞ্জি’র চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে। ইতোমধ্যে ৪০ লাখ লোককে ‘অনাগরিক’ চিহ্নিত করে তাদেরকে আলাদা ক্যাম্পে স্থানান্তর করা শুরু হয়েছে। এসব বিষয়ের ওপর আলোকপাত করে ‘কাশ্মির ইস্যু ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে মন্তব্য করে বাংলাদেশে তার ইস্যুটি হারিয়ে ফেলছে বলে উল্লেখ করেছেন বিশিষ্ট বিশ্লেষক ফরহাদ মজহার। তার মতে, ‘ফিলিস্তিন যেমন আন্তর্জাতিক ইস্যু, কাশ্মিরও তাই। সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ থাকার অর্থই হচ্ছে কাশ্মির ভারতীয় সংবিধানের অধীনস্থ কোনো ভূখণ্ড বা রাজ্য নয়। এই অনুচ্ছেদ বাতিল করার অর্থ হচ্ছে, হিন্দুত্ববাদী ভারতের পররাজ্য দখল ও আগ্রাসন। আজ যদি ভারত একতরফা হিন্দুত্ববাদী সিদ্ধান্তে কাশ্মির দখল করে নিতে পারে, কাল তারা দুর্বল কোনো প্রতিবেশী দেশ গ্রাস করে নিতে পারবে আঙুলে তুড়ি মেরে। যারা দাবি করে ‘কাশ্মির ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ তারা ভারতীয় আগ্রাসনের আগাম বাহিনী বা দখলদার হয়েই এ কথা বলে। কেউ চোখ রাঙিয়ে কথা বললেও বাংলাদেশের জনগণকে ভারতের আগ্রাসী ভূমিকার বিরুদ্ধে কথা বলতেই হবে।’ তিনি আরো বলেছেন, এই উপমহাদেশ নানান জাতিগোষ্ঠী, ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভাষায় সমৃদ্ধ। নানান জনগোষ্ঠী ও রাজ্যে স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা অক্ষুণœ রেখে ঐক্য ও সম্প্রীতির ইউনিয়ন গড়ে তোলা এবং উপমহাদেশকে শান্তি ও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া মোটেও কঠিন নয়। কিন্তু হিন্দুত্ববাদ চায় অন্যদের নির্মূল করে হিন্দু, হিন্দি ও হিন্দুস্তানের ‘রাম রাজ্য’ কায়েম করতে। ‘হিন্দুত্ববাদ’ মূলত ভারত ভাঙার রাজনীতি, গোলকায়নের কালে সবাইকে নিয়ে নতুন করে গড়ার দূরদর্শিতা নয়। এর সাথে সাধারণ হিন্দুর স্বার্থ জড়িত নেই, জড়িত করপোরেট স্বার্থÑ যারা ভারতকে নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নিতে তৎপর।
ভারতের সংবিধান থেকে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাদ দেয়ার মধ্য দিয়ে উপমহাদেশব্যাপী আরেকটি বড় তুফানের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সাথে দেখা করেছেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে আসামে নাগরিক পঞ্জির কারণে ৪০ লাখ লোক বাদ দেয়া এবং তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর কথাও আছে। সংবিধান ও আইনকে হাতিয়ার বানিয়ে এক দিকে জম্মু ও কাশ্মিরের ভূখণ্ড দখল, অন্য দিকে নাগরিক ও মানবিক অধিকার হরণ করে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রহীন করার হিন্দুত্ববাদী নীতি একই সূত্রে গাঁথা। বাংলাদেশের জনগণ যদি অত্যাসন্ন বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে চায়, তাহলে অবিলম্বে কাশ্মিরি জনগণের লড়াই এবং মানবিক, নাগরিক ও রাষ্ট্রীয় অধিকারবঞ্চিত ভারতীয়দের সাথে একাত্ম হতে হবে।
ভারতের উগ্রবাদী শক্তি এখন যে লড়াই শুরু করেছে তাতে দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশই নিরাপদ থাকতে পারবে বলে মনে হয় না। এ জন্য যার যার অবস্থান থেকে আগ্রাসন তথা প্রতিবেশীদের গ্রাস করে অখণ্ড ভারত তৈরির যেকোনো প্রচেষ্টা রুখে দিতে হবে। ভারত সহাবস্থানের নীতিতে বিশ্বাস করলে, সেটি খুব ভালোভাবেই সম্ভব ছিল। কিন্তু সব মিলিয়ে রশিকে বেশি পাকিয়ে শক্ত করতে গেলে যেভাবে তা ছিন্ন হয়ে যায়, সে রকম একটি অবস্থার সম্মুখীন দিল্লি কাশ্মির ও উত্তর-পূর্ব ভারত নিয়ে হতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এ কারণে নতুন করে স্বাধীন নাগাল্যান্ডের দাবি উঠছে। হ
mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement