২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

আত্মহত্যা একটি সামাজিক সঙ্কট

-

‘আত্মহত্যা’ নিছক ব্যক্তিগত ঘটনা নয়, এটি একাধারে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সমস্যা। কেননা, ব্যক্তির এ চরম আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের ফলে পরিবার থেকে শুরু করে গোটা মানবজাতিই ক্ষতির শিকার হয়ে থাকে। ‘আত্মহত্যা’ বলতে কোনো ব্যক্তির মানসিক অবস্থার সেই পরিণতিকে বোঝায়, যখন ব্যক্তি নিজের প্রাণকে নিজেই হরণ করে। চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে ‘আত্মহত্যা’ মানসিক ব্যাধি; কিন্তু এ ব্যাধির যেসব আলামতের বিষয়ে আলোচনা হচ্ছেÑ তাতে আত্মহত্যা কমছে না; বরং দিন দিন বাড়ছে। এতে বোঝা যায়, ‘আত্মহত্যা’র লক্ষণ এবং প্রতিকার সম্পর্কে গবেষকেরা এখনো অনিশ্চয়তার মধ্যেই রয়ে গেছেন।
‘আত্মহত্যা’র অর্থ দাঁড়ায় নিজেকে বিসর্জন, নিজের প্রাণনাশ, নিজের জীবননাশ (deliberate killing of oneself)। ল্যাটিন suicidium থেকে জানা যায়, sui মানে ‘of oneself’ এবং Pulmonary Interstitial Emphysema (PIE) মতে, s(u)w-o মানে ÔoneÕs own,Õ ইংরেজি suicide শব্দের উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ suicidium থেকেই; বাংলায় suicide-এর প্রতিশব্দ ‘আত্মহত্যা’।
আত্মহত্যা জীবনের সেই পর্যায়, যে পর্যায়ে মানুষ নিজেকে চরম অসহায় মনে করে; সে দুর্গতি, যার থেকে উত্তরণের কোনো উপায় খুঁজে পায় না; সেই যন্ত্রণা, যার উপশমের কোনো প্রতিকার থাকলেও তার জানা থাকে না; সেই অসহায়ত্ব, যখন সহায়তা কিংবা আশ্রয় পাওয়ার মতো কাউকে পাশে দৃশ্যত পায় না; সেই ঘৃণা, যা থেকে নিষ্কৃতি নেই; সেই দুর্ভাবনা, যে দুর্ভাবনার ‘রাত্রি পোহায় না’; সেই অবস্থা যখন মানুষ নিজেরই গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। সেই প্রেক্ষাপটে নিজেকে আর স্বাভাবিক রাখতে পারে না; যে পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানুষ জীবনের কথা ভুলে যায়। অর্থাৎ, Suicide is a matter of individual despair.
কারো মতে, দারিদ্র্য আত্মহত্যার কারণগুলোর অন্যতম। তারা ভারত ও চীনের কৃষক এবং সাধারণ মানুষের আত্মহত্যার দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংবাদের আলোকে আলোচনা করা যেতে পারে। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত সংবাদপত্রগুলোতে আত্মহত্যা সম্পর্কিত যেসব সংবাদ পাওয়া যায়Ñ তাতে অন্ন-বস্ত্রের অভাবই আত্মহত্যার প্রধান কারণ হিসেবে গণ্য হয়েছিল। তখন মানুষের মূল সমস্যা ছিল খাদ্যাভাব। কারণ, সে সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা ও খরা হত ঘনঘন। গুদামে খাদ্যসামগ্রী জমিয়ে রেখে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করার প্রবণতা সে সময়েও ছিল। ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ সালের ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকার একটি খবরের শিরোনাম ছিল, ‘অর্থনৈতিক দুরবস্থা, পারিবারিক অশান্তি ও অন্নবস্ত্রের অভাবে গাইবান্ধায় ১৬৩ জনের আত্মহত্যা’ এবং ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ সালে একই পত্রিকার আরেকটি শিরোনাম ছিলÑ ‘ঝিনাইদহে আত্মহত্যার হিড়িক; আট মাসে ৩০৬ জনের আত্মহত্যা’। এ দু’টি সংবাদে বলা হয়েছেÑ মূলত দারিদ্র্য, খাদ্য ও পরিধেয় বস্ত্রের অভাবই আত্মহত্যার কারণ।
২০১০ থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে আট হাজার ১৮৫ জন লোক আত্মহত্যা করেছে। এতে বলা যায়, বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন এবং প্রতি বছর প্রায় ১১ হাজার লোক আত্মহত্যা করছে। জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাত্র এক দশকে (২০০১-১০) পারিবারিক অশান্তি, যৌন নির্যাতন ও গৃহকর্মী নির্যাতন ও অন্যান্য কারণে মহিলা ও কিশোরী আত্মহত্যার সংখ্যা চার হাজার ৭৪৭ জন। ‘ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তারদের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১১ সালে বাংলাদেশে আত্মহত্যা করেছে ১৯ হাজার ৬৯৭ জন। ২০১২ সালে ‘ডেইলি স্টার’ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের তথ্যানুযায়ী, বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর আত্মহত্যা করছে প্রায় ১০ হাজার লোক। ‘ডেইলি স্টার’-এর অন্য এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০২ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত বাংলাদেশে আত্মহত্যার সংখ্যা ৭৩ হাজার ৩৮৯; এর মধ্যে ৩১ হাজার ৮৫৭ জন গলায় দড়ি ঝুলিয়ে ফাঁসি দিয়েছে এবং বাকিদের বেশির ভাগই বিষাক্ত কীটনাশক পান করেছে।
যুগ যুগ ধরে মনোবিজ্ঞানীরা আত্মহত্যা সম্পর্কে আলোচনা করছেন। ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুরখেইম (১৮৫৮-১৯১৭) Le Suicide গ্রন্থে আত্মহত্যার তিনটি কারণের কথা উল্লেখ করেছেন, (ক) Individual reasons for suicide, (খ) Social forms of suicide এবং (গ) The relation of suicide to society as a whole। ভারতে কৃষকদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। ডুরখেইম বারবার ‘আত্মহত্যা’র সামাজিক মাত্রার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে মূলত সামাজিক অব্যবস্থাই আত্মহত্যার জন্য দায়ী।
আত্মহত্যার বংশগত কারণও থাকতে পারে। দেখা গেছে, যেসব পরিবারে আত্মহত্যাজনিত ঘটনা আগে ঘটেছে, সেসব পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আত্মহত্যার ঝুঁকি বেশি। সোহরাওয়ার্দী কলেজের এক চিকিৎসক দলের রিপোর্ট (২০১০) অনুযায়ী, বাংলাদেশে আত্মহত্যার মাত্রা সবচেয়ে বেশি চুয়াডাঙ্গায়। সেখানে শতকরা ৮৯ ভাগ আত্মহত্যাকারী মহিলা ও অবিবাহিত মেয়ে। বিষণœতা, মানসিক সমস্যা, আবেগপ্রবণতা, অজ্ঞতা, বেকারত্ব, পারিবারিক কলহ, বখাটেদের উৎপাত, প্রেমে ব্যর্থতা, প্রেমের নামে প্রতারণা, নির্যাতন, যৌতুক, সামাজিক বৈষম্য ও অনাচার, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে অযোগ্যদের অবস্থান, শিক্ষকদের নিষ্ঠুরতা, পারিবারিক অশান্তিসহ অনেক বিষয় আত্মহত্যার কারণ।
আত্মহত্যা নিয়ে উদ্বেগের প্রধান কারণ হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে এর প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া। একটি বেসরকারি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার শতকরা ১১.৮০ ভাগ। শিক্ষকদের সাথে অভিমান করে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাইফুর রহমান প্রতীকের আত্মহত্যার খবর শিক্ষকদের আচরণ সম্পর্কে দেশব্যাপী উদ্বেগ সৃষ্টি করে। চিকিৎসক মোস্তফা মোরশেদ আকাশের আত্মহত্যার ঘটনা সামাজিক অবক্ষয়ের একটি রূপ। একজন চিকিৎসক, যিনি মানুষকে সেবার ব্রত নিয়ে জীবনযাপন করার কথা; তিনিই যখন আত্মহত্যার পথ বেছে নেন, তখন স্পষ্ট হয়ে ওঠে, সমাজের ক্ষত কত গভীর। ২০১৯ সালের ২৯ মার্চ গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন সৌমিক মিত্র সবুজ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্য মতে, সবুজ একটি মিডটার্ম পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়ায় এবং শিক্ষকের কাছ থেকে প্রত্যাশানুযায়ী জবাব না পেয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হন। এরপর গ্রামের বাড়ি গিয়ে আত্মহত্যা করেন।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১৫ বছরে আত্মহত্যা করেছেন ২৩ শিক্ষার্থী। তাদের কয়েকজন ভবনের ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। হতাশাই এর কারণ বলে ধারণা করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা সম্পর্কিত ঘটনায় এটি স্পষ্ট যে, আমাদের শিক্ষকসমাজ উপযুক্ত প্রশিক্ষণহীন। ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদাবোধ সম্পর্কে সচেতন না হয়ে কিভাবে শিক্ষকেতার মতো মহান পেশায় নিয়োজিত থাকা যায়? যেকোনো জাতি গঠনে শিক্ষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বলা হয়ে থাকেÑ ‘শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর’। সেই কারিগর যদি অদক্ষ হন তখন জাতি গড়ে ওঠে একধরনের ‘প্রতিবন্ধী’ রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ভিকারুননিসা নূন স্কুল এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার আলামত লক্ষ করলে দেখা যায়, আমাদের সার্টিফিকেটধারী ভদ্রসমাজ ‘আত্মহত্যা’ সম্পর্কে অনেকাংশেই উদাসীন। ফলে এই প্রবণতা বেড়ে চলেছে। আত্মহত্যাকারীর সংখ্যা কত, এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কেন আত্মহত্যা করছে এবং এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? এর স্থায়ী সমাধানের পথেই এগোতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক


আরো সংবাদ



premium cement