২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নারী ও শিশু নির্যাতন

-

চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে দীপিকা আচার্য্য মনিকা নামে এক গৃহবধূকে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টা, ভোলায় ঘুমন্ত গৃহবধূকে পুড়িয়ে হত্যা, শ্রীপুরে গৃহবধূকে পুড়িয়ে হত্যা, বাগেরহাটে গৃহবধূকে পুড়িয়ে হত্যা, প্রবাসীর স্ত্রীকে পুড়িয়ে হত্যা, সাভারে গৃহবধূকে পুড়িয়ে হত্যা, লালমোহনে দুইজনকে পুড়িয়ে হত্যাÑ এ ধরনের খবর প্রতিনিয়তই সংবাদপত্রের পাতায় ছাপা হচ্ছে। নুসরাত হত্যার ঘটনাটিতো দেশব্যাপী বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই যে জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করা হচ্ছে, তার চেয়ে পাশবিক কাণ্ড আর কী হতে পারে? যুবতী, কিশোরী, বাসার কাজের মেয়ে বা স্কুল-মাত্রাসার ছাত্রীকে ধর্ষণের পর পুড়িয়ে হত্যা অথবা গলা টিপে হত্যার ঘটনাও মামুলি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নারী ও শিশু নির্যাতন সংবাদপত্রের পাতার প্রতিদিনের খবর বলা চলে। গত ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত গত চার মাসে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৩৪৫ জন নারী ও শিশু। যার মধ্যে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩১০ জন, হত্যাকাণ্ডের শিকার ১৮০ জন, শ্লীলতাহানির কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১০৭ জন, ধর্ষণের পর হত্যা ১৬ জন, অপহরণ ও যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার ৯২ জন এবং শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে ১৩১ জনকে। এ ছাড়া ২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত গত ১০ বছরে মোট ধর্ষণের শিকার হয়েছে আট হাজার ৭০ জন। ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যা করা হয়েছে ৮৯২ জনকে, যা প্রতি বছরই বেড়েই চলেছে। ২০০৮ সালে ধর্ষণ ও গণধর্ষণ সংখ্যা ছিল ৪৩৯ জন। ২০০৯তে এ সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৫৩৯ জন। ২০১০ সালে আরো বৃদ্ধি পেয়ে ৭০০ জন, ২০১১ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮০০তে। ২০১২ সালে কিছুটা কমে হয় ৬৬৫ জন। কিন্তু ২০১৩ সালে এ সংখ্যার ব্যাপকতা লক্ষ করা গেছে। ওই বছরে ৮৮১ জন, ২০১৪ সালে ৮৪০ জন, ২০১৫ সালে এক হাজার সাতজন, ২০১৬ সালে এক হাজার ছয়জন এবং ২০১৭ সালে এ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় এক হাজার ১৯৩ জনে। এ বছরে গত চার মাসে ২৪৮ জন নারী ও শিশুকে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে। ২০১৩ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ৭৫৫ জনকে।
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দেশে প্রথমবারের মতো নারী নির্যাতন নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে একটি জরিপ চালিয়েছিল। এতে বলা হয় যে, শারীরিক নির্যাতনের শিকার নারীদের মাত্র অর্ধেক চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ পান। এক-তৃতীয়াংশ নারীই স্বামীর ভয়ে বা স্বামী সম্মতি না দেয়ায় চিকিৎসকের কাছ পর্যন্ত যেতেই পারেননি। পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে আগে নারীরা মুখ খুলতেন না। ঘরোয়া ব্যাপার বা লজ্জাজনক মনে করতেন। বর্তমানে মুখ খুলছেন। অন্য দিকে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বহুদিন আগে থেকেই কাজ হচ্ছে। কিন্তু নারী নির্যাতনের মাত্রা বাড়ছেই। এর মূল কারণ হলো- নারী নির্যাতনের বিষয়টি এখনো জাতীয় বিষয়ে পরিণত হতে পারেনি। চোখের সামনে নির্যাতন দেখলেও সবাই মেনে নিচ্ছে। দুর্বল আইনের শাসনও এ ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে। তাই এ ধরনের সংস্কৃতি যত দিন পরিবর্তন না হবে, তত দিন নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব হবে না। জাতিসঙ্ঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় সরকার এ জরিপ করেছে। এ জরিপ প্রকল্পের পরিচালক জাহিদুল হক সরদার বলেছেন, জাতিসঙ্ঘের পক্ষ থেকে সদস্যরাষ্ট্রগুলোতে নারী নির্যাতনের অবস্থান জানার জন্য জাতিসঙ্ঘের পরিসংখ্যান বিভাগের (ইউএনএসডি) নির্ধারিত মানদণ্ডের আলোকে জরিপ চালানোর আহ্বান জানানো হলে ভিয়েতনামের পরেই বাংলাদেশ এ ধরনের জরিপ চালিয়েছে। নির্ধারিত মানদণ্ডে বিবাহিত নারীদের যৌন নির্যাতনের বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তবে কিছু কিছু বিষয়, যেগুলো দেশের জন্য প্রযোজ্য নয়, তা বাদ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ সংশোধিত ২০১৩ অনুযায়ী এসব অপরাধ প্রমাণিত হলে অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন থেকে মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। এ ছাড়া রয়েছে অর্থদণ্ডের বিধান। কিন্তু এতেও কমছে না নারী ও শিশু নির্যাতন। নানা কারণে বিচার পাচ্ছেন না বাদিপক্ষ। আর বছরের পর বছর চলে মামলা। এসব মামলার তদন্তে থাকছে ‘ঘাপলা’ যেমনটি নুসরাত হত্যা মামলার ক্ষেত্রে দেখা গেছে পুলিশের রহস্যজনক ভূমিকা। পুলিশ যখন এজাহারে বর্ণিত আসামির বিরুদ্ধে মামলা প্রমাণ করার মতো তথ্য পায় না, তখন চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। ট্রাইব্যুনাল শুনানিতে সেটা গ্রহণ করলে সেখানেই মামলার ইতি হয়, আসামি অব্যাহতি পায়। তদন্তে প্রাথমিক প্রমাণ পেলে পুলিশ অভিযোগপত্র দেয়, যার ভিত্তিতে শুনানির পর ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ গঠন করেন। অথবা আসামি অব্যাহতিও পেতে পারে। অভিযোগ গঠিত হলে বিচার শুরু হয়। দীর্ঘ সময়ে ন্যূনতম সাক্ষী ও প্রমাণ হাজির করা না হলে আদালত মামলার ইতি টেনে আদেশ দিতে পারেন। তখন সাক্ষীর অভাবে আসামি খালাস পায়। আবার রাষ্ট্রপক্ষ পূর্ণ শুনানিতে সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়ে অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারলে আসামি বেকসুর খালাস পায়।
এ প্রসঙ্গে একটি পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ‘অনেক সময় আসামিরা বিচার শুরুর আগেই অব্যাহতি পেয়ে যায়। আর ৫৫ শতাংশ মামলায় সাক্ষ্য-শুনানির শেষে আসামিরা বেকসুর খালাস পেয়েছে। কিছু মামলা নিষ্পত্তির কারণ নিবন্ধন খাতায় লেখা নেই, কয়েকটির নিষ্পত্তি হয়েছে আসামির মৃত্যুতে। এভাবে ৯৭ শতাংশ মামলার আসামির বিরুদ্ধেই এসব গুরুতর অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। চলমান মামলাসহ মোট দেখা মামলার তিন-চতুর্থাংশের কিছু কম ধর্ষণের অপরাধে করা। প্রায় এক-চতুর্থাংশ হচ্ছে যৌন পীড়নের মামলা। দেখা যায়, ২০১২ সালের পর থেকে মামলা আসা বেড়েছে এবং সেটা মূলত যৌন অপরাধের মামলার জন্য। সাজার হার সবচেয়ে কম যৌন পীড়নের মামলাগুলোতে, সবচেয়ে বেশি হচ্ছে ধর্ষণের পর হত্যা মামলায়।
তবে এই মামলাগুলো সংখ্যায় খুবই কম আর সেখানেও নিষ্পত্তি হওয়া তিন-চতুর্থাংশ মামলায় আসামি অব্যাহতি বা খালাস পেয়েছে। চলমান ছিল তিন হাজার ৫৮৭টি মামলা। ২০০২ সালে আদালতে আসা ১৬টি মামলা তখনো ঝুলছিল। এর বড় অংশ ধর্ষণ ও গণধর্ষণের মামলা। চলমান মামলার প্রায় ৪০ শতাংশ (১ হাজার ৩৪৬টি) ছয় থেকে ১৩ বছর ধরে ঝুলছিল। বিচার শুরু হতে হতেই অনেকটা সময় পার হয়ে যায়। এভাবে ঝুলে থাকার সময়টা ২০ বছর পেরিয়ে যাওয়ারও নজির আছে। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বললেন, ‘অস্বীকার করার উপায় নেই যে প্রসিকিউশন পক্ষের (রাষ্ট্রপক্ষ) দুর্বলতার কারণে আসামিরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, অনেক মামলা শক্তভাবে অতি দ্রুত বিচার করা উচিত। কিন্তু তদন্ত, অভিযোগপত্র দেয়া আর অভিযোগ গঠনে অনেক সময় চলে যায়। বিচারও ধীরগতিতে চলে। মামলা যত গড়ায়, সাক্ষী এনে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে আসামিদের শাস্তি দেয়ার সম্ভাবনা তত কমে।’ হ
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও চেয়ারম্যান, ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন

 


আরো সংবাদ



premium cement