২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বৈদ্যনাথপুরের বৈশাখী মেলা

-

পয়লা বৈশাখের কথা মনে গড়তেই স্মৃতিতে ভেসে ওঠে বৈদ্যনাথপুরের গাছতলার কথা। চোখ বন্ধ করলেই দেখি, খালের ওপর কাঠের ভাঙা সাঁকো। এই পুল পার হলেই বৈদ্যনাথপুরের গাছতলা। নববর্ষ বলতে আমরা ওই গাছতলাকেই বুঝতাম।
মেঘনা ও কাঁঠালিয়া নদী দ্বারা পরিবেষ্টিত গোটা বিশেক গ্রাম নিয়ে আমাদের ছিল আলাদা এক ‘দ্বীপ’, যা দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। বর্ষায় নাও ছাড়া এক গাঁ থেকে আরেক গাঁয়ে যাওয়া অসম্ভব ছিল। এলাকাটি ‘মাছের স্বর্গরাজ্য; হলেও নতুন বছরের শুরু পান্তা-ইলিশ দিয়ে হতে কোথাও দেখেনি। গৃহস্থ পরিবার হিসেবে শীতের শেষে গরম পড়তে শুরু করতেই পান্তা খাওয়া শুরু করতাম। পেঁয়াজ ও পোড়া মরিচ দিয়ে পান্তাভাত ছিল নিত্যদিনের নাশতা। কখনো কখনো পেঁয়াজ-মরিচের বদলে যোগ হতো শাক, ভর্তা ও ভাজা মাছ।
বাবা নববর্ষে পছন্দ করতেন না কোনো আড়ম্বর। কোনো দিন গাছতলার মেলায় নিয়ে যাননি। গাছতলার পথে দুই গাঁয়ে দুই বোনের বাড়ি। পর্ব উপলক্ষে নতুন জামাইদের ‘পর্বি’ দেয়ার প্রথা ছিল। বাবাও দুই জামাইয়ের জন্য ‘পর্বি’ পাঠাতেন। ১০ টাকা করে তা দিয়ে আমাকেই পাঠাতেন বাবা। আমরা সারা বছর এ দিনটির অপেক্ষায় থাকতাম। এক আনা-দু’আনা করে এক টাকা পর্যন্ত জমিয়ে রাখতাম এ দিনের জন্য।
আমাদের গ্রাম থেকে মাইল তিনেক দূরে বৈদ্যনাথপুর। দুইটি গ্রাম ও তিনটি মাঠ পার হয়ে তারপর খাল। খালের ওপর কাঠের ভাঙা সাঁকো। খাল পার হলেই জোড়া বটগাছ। বৈদ্যনাথপুর গাঁয়ের মাথায় জোড়া বটগাছের তলায় মেলা জমত।
এ সময় খালে এক হাঁটু কাদা থাকত। সাঁকোর একপাশে বাঁশের হাতল। জোড়াতালি দেয়া বুড়ো লোকের দাঁতের মতো নড়বড়ে খুঁটি। মাঝখানে দড়ি দিয়ে বাঁধা একজোড়া কাঠ। সাঁকোয় উঠতে গেলেই নড়তে শুরু করে। ভয়ে বসে পড়তে হয়। নিচের দিকে তাকিয়ে কাঁপতে কাঁপতে ফিরে আসতেন অনেকে। যথেষ্ট অভিজ্ঞ ও বীরত্ব প্রদর্শনের কসরত ছাড়া কেউ সাঁকো ব্যবহার করত না। বীরত্ব প্রদর্শনকারীদের মধ্যে দু-চারজন পড়ে খালের কাদাজলে একাকার হয়ে হাসির খোরাক হতেও দেখা গেছে। খড়কুটো ও আবর্জনার স্তূপে নাকাল অবস্থায় আমরা খাল পার হতাম।
বিশ গাঁয়ের মাঝখানে এই গাছতলা। সে পথে প্রথমেই বড় বোনের বাড়ি। চারদিকে আমগাছ। আমাদের জন্য বোন আগেই কাঁচা আমের আচার বানিয়ে রাখতেন। সে এলাকায় রাস্তার পাশেও ছিল অনেক আমগাছ। কোনো কোনো গাছের কচি আম ঝুলে থাকত মাটির কাছাকাছি। গাছে ঢিল মারা ছাড়াও সুযোগ পেলেই নুইয়ে থাকা আমের গুটি ছিঁড়ে নিতাম। ছোট আমের গুটি খোসাসহ চিবিয়ে খেতাম।
বৈশাখী মেলার মেয়েদের প্রধান আকর্ষণ, রঙিন ফিতা, সিঁথিপাটি, চম্পাফুল, খোঁপার কাঁটা, ইমিটেশনের অলঙ্কার, স্নো, পাউডার, আলতা, নেলপলিশ, আতর ইত্যাদি কসমেটিকস জাতীয় সাজসজ্জা আর আমাদের পছন্দ বাঁশি, বড়ইয়ের ভর্তা, জিলাপি উখড়া (গুড়ে পাক দেয়া খই) ও মুড়ির মোয়া। এক-দেড় কিলোমিটার দূর থেকেই সোরগোল কানে আসত মেলার। মা বলতেন, হাটবাজার ও মেলায় এমন সোরগোল জিন-পরী ছাড়া হয় না। কোনো কোনো বাঁশির শব্দ বিশেষ করে ‘মেড়াবাঁশি’ অনেক দূর ছড়ায়। চিকন বাঁশের নল দিয়ে বিশেষ কায়দায় বানানো
একপ্রকার বাঁশির নাম মেড়া (ভেড়া)। নলের মোটা মাথায় বেলুন লাগানো থাকে। চিকন মাথায় জোরে ফুঁ দিয়ে বেলুনে বাতাস ভর্তি করে ছেড়ে দিলে ভেড়ার মতো ‘ভ্যাঁ’ শব্দে বেলুনের বাতাস কমতে থাকে। হুঁইসেল বাঁশির কর্কশ শব্দ, মুরলি বাঁশির মধুর ধ্বনি, ক্যানভাসারের উচ্চস্বরে চিৎকার ও চেঁচামেচি মিলে বিচিত্র ধ্বনি কানে ঢুকলে মাথা ঠিক রাখা দায় হয়ে পড়ে। মুরব্বিরা বলতেন, হারিয়ে গেলেই ভলান্টিয়ার ধরে নিয়ে যাবে। ওরা হাতে রুল, গায়ে খাকি পোশাক, কোমরে
বেল্ট, মাথায় ক্যাপ পরে, বুকে লাল ফিতা গেঁথে ঘুরে বেড়াতেন। তাদের নাম শুনলেই ভয়ে শরীর ঘামতে শুরু করত।
দুই দুলাভাই গাছতলা নিয়ে আমাকে নাগর দোলা ও বায়স্কোপ দেখিয়ে আনতেন। এদিক-ওদিক যাওয়া দূরের কথা, ভলান্টিয়ারদের ভয়ে মাথাই উঠাতাম না। নতুন পাতিলে খই-জিলাপি ও ভর্তা (আচার) কিনে দিতেন দুলাভাই, বসে বসে খেতাম। বাঁশির মধ্যে আমার শখ হারমোনিয়াম বাঁশি। বাঁশের বাঁশি যেখানে এক আনা সেখানে হারমোনিয়ামের দাম ১০ আনা। বাজাতে না পারলেও হারমোনিয়ামের সুর ভালো লাগত। বেলা একটার দিকে মেলা জমতে শুরু করত। তিনটার দিকে লোকে লোকারণ্য। লোকের ভিড়ে হাঁটা-চলাই দায়।
মাঝে মধ্যেই শুরু হতো ঝড়। কাল বৈশাখীর ভয়ে বেলাবেলি খই, বাতাসা, ভর্তা (আচার), জিলাপিসহ বাড়ির পথে রওনা হতাম। মালা বানিয়েও জিলাপি আনা যেত। মোর্তার (যা দিয়ে পাটি বানানো হয়) আঁশে জিলাপি গেঁথে মালা বানিয়ে বাড়ি ফিরে আসতাম। মুখে থাকত বাঁশি, হাতে ঝুলত জিলাপির মালা। অসাবধানে হাঁটা-চলায় দু-একটা জিলাপি ঝরে পড়ত। ঈশান কোণে কালো মেঘ জমতে শুরু করলে কলজে শুকিয়ে যেত। বাঁশি পকেটে পুরে, জিলাপির মায়া ত্যাগ করে দিতাম দৌড়। দীর্ঘ দৌড়ের পর বাড়িতে খুব কম জিলাপিই পৌঁছত।


আরো সংবাদ



premium cement