২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

স্ম র ণ : অধ্যাপক মুহম্মদ শামসুজ্জোহা

-

১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারিÑ ২০ বছরের তরুণ হিসেবে আমার মনে এই তারিখটি অম্লান, চিরভাস্বর। এই দিনেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর ও রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক, ড. মুহম্মদ শামসুজ্জোহা শহীদ হন।
৬৯ সালের প্রারম্ভে একনায়ক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে তীব্র গণ-আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সমগ্র পাকিস্তানে। ২০ জানুয়ারি ঢাকায় আসাদুজ্জামানের শহীদ হওয়ার পর থেকেই সারা দেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে সরকারের ওঠে নাভিশ্বাস। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ খবর পৌঁছার পরপরই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা বন্ধ হয়ে যায়। স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল আর প্রতিবাদ সভায় ক্যাম্পাস হয়ে ওঠে জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। ১৭ ফেব্রুয়ারি ছাত্রছাত্রীদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশের লাঠিচার্জে বেশ কিছু ছাত্র আহত হন। ড. জোহা ছিলেন সেই মিছিলের অগ্রভাগে। তিনি সব সময়েই সজাগ ছিলেন, যেন তার প্রিয় ছাত্ররা বেপরোয়া হয়ে না ওঠে। এ লাঠিচার্জে কিছু ছাত্রের আহত হওয়া তার স্নেহকোমল ও দায়িত্বশীল মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। মিছিলে লাঠিচার্জের সময় তিনি পুলিশের সাথে কথা বলেছিলেন। তার বক্তব্য ছিলÑ ‘আমার ছেলেরা তো শান্তিপূর্ণভাবে মনোভাব প্রকাশ করছে। তবুও কেন তোমাদের আপত্তি?’ একজন ছাত্রের ওপর লাঠিচার্জের সময় তিনি ‘ঢাল’ হয়ে দাঁড়ান। ছাত্রটির মাথা ফেটে রক্ত পড়ছিল। তার মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে দেন নিজের জামা ছিঁড়ে।
১৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে প্রতিবাদ সভায় শহীদ জোহা বলেছিলেনÑ ‘আমি ধন্য! ছাত্রের পবিত্র রক্তে আমার জামাটি রঞ্জিত হয়েছে। তা যতœ করে রেখে দেবো। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে যে রক্তদান, তা কখনো বৃথা যায় না।’ তিনি সেই রক্তরঞ্জিত জামাও সবাইকে দেখিয়েছিলেন।
পরদিন প্রতিবাদ সভায় ড. জোহার দেহ উল্টিয়ে অশ্লীল গালি দিয়ে নৃশংসভাবে বেয়নেট চার্জ করে। ড. জোহা মৃত্যুযন্ত্রণায় ‘পানি পানি’ বলে কাতরাতে থাকেন। সেই অবস্থায় পুলিশ ছাত্রদের গুলি করার ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত হয়। এ খবর পেয়ে ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর শামস-উল-হক ঘটনাস্থলে যান। তাকে দেখে সেই লেফটেন্যান্ট ড. জোহাকে তুলে নিয়ে শহরের দিকে যেতে থাকে। তখন বেলা প্রায় সাড়ে ১১টা। পথে তারা গুলি চালিয়ে রাজশাহী সিটি কলেজের ছাত্র নুরুল ইসলামকে হত্যা করে। হাসপাতালে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ড. জোহা শাহাদত বরণ করেন। তখন সময় বেলা ১টা। শহর ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সান্ধ্য আইন জারি করা হয় বেলা ২টা থেকে। ড. জোহার শাহাদত বরণের খবর ক্যাম্পাসে পৌঁছার পরপরই এস এম হলের দক্ষিণে ও তৎকালীন জিন্নাহ হলের পূর্ব দিকে জোহা স্যারের বাসায় সবাই সমবেত হয়। তার একমাত্র মেয়ে তখন মাত্র তিন বছরের শিশু। সবাই সে অবুঝ শিশুর দিকে তাকিয়ে অশ্রু সংবরণে ব্যর্থ হয়েছিলেন। মিসেস জোহা তখন সংজ্ঞাহারা।
পরদিন সকালে বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে সবার প্রিয় জোহা স্যারের নামাজে জানাজা শেষে প্রশাসনিক ভবনের সামনে তাকে দাফন করা হয়। ড. জোহার ত্যাগ ও আদর্শ বৃথা যায়নি। তার এই মহান মৃত্যুর দুই বছর পরই পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়।
আজ শহীদ জোহার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন এবং তার মাগফিরাত কামনা করি সুদূর আমেরিকা থেকে। নিজে তার প্রত্যক্ষ ছাত্র না হলেও গৌরব বোধ করি সে সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পরোক্ষ ছাত্র হিসেবে। আমিন! হ
মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন
Email: shati851@aol.com


আরো সংবাদ



premium cement