১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

প্রকৃতি কিছু মানুষকে জাগতিক বাস্তবতা বিষয়ে উদাসীন করে জন্ম দেয়

-

ইতিহাস ইতিহাসকেই রক্ষা করতে চায় এবং ইতিহাস শব্দের দ্রুততম অর্থ হলো সভ্যতার বিবরণ। মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে তবে কি সৃজনশীল মানুষ অর্থাৎ পৃথিবীর কবিরাই ওই দৈত্যের প্রাণ ভোমরা কোথায় লুকায়িত, কোন সমুদ্রের নিচে, কোন সিন্দুকের ভেতর তা জানেন? দার্শনিকরা যদি হঠাৎ বলেন, দর্শনের কাজ হলো জগতের ব্যাখ্যা নয় জগৎটাকে বদলানো। তবে কবিরা কেন বলতে পারবেন না জগৎটা বদলে যায় কোনো দার্শনিক নিয়মে নয়। কোনো ডায়ালেক্টিক পদ্ধতিতে নয়। কোনো শ্রেণী সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় নয়। জগৎটা বদলে যায় মানুষের স্বপ্নে। মানুষের আশায়, মানুষের বিশ্বাসে ও মানবতার ধর্মে। সর্বোপরি মানুষের বিজ্ঞানে ও প্রযুক্তিতে। এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শুধু গবেষণায় আয়ত্ত হয়নি। ল্যাবরেটরিতে কিংবা মানুষের মস্তকে অকস্মাৎ তা স্ফুলিঙ্গরূপে আবির্ভূত হয়। মানুষ হঠাৎ পেয়ে যায়। যেমন একজন কবি ছন্দ, মিল, ও উপমা অলৌকিকভাবে একদিন পেয়ে গিয়ে এক অসাধারণ কাব্য সৃষ্টি করেন।
আমদের দেশে যেকোনো কারণেই হোক কাব্যই হয়ে উঠেছে আধুনিক ও মননশীল সাহিত্যের প্রতিভূ। অথচ কে না জানে সারা পৃথিবীতেই আধুনিক মননশীল সাহিত্য হিসেবে এ সময়ের পাঠকের কাছে কবিতা সে সম্মান পাচ্ছে না। বরং গল্প-উপন্যাস অর্থাৎ সাম্প্রতিক ফিকশন ন্যায়সঙ্গতভাবেই পাঠকের কাছে আধুনিক পাঠ্য বিষয় হিসেবে মর্যাদায় সমাসীন। কবিতা আমাদের দেশে কেন এতটা অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করেছে তা দুর্বোধ্য নয়। কারণ এদেশে সব সময় প্রগতিশীল মানুষ হিসেবে নিয়ম ভাঙা সৃজনশীল হিসেবে কবির একটা স্পষ্ট ভূমিকা ছিল। কিন্তু অতি সম্প্রতি গদ্য বা কথাশিল্প তার নিজের ভূমিকা ও মর্জাদা আদায় করে নিতে আগুয়ান হয়েছে। এতে অবশ্য কবিদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কাজের কাজ হলো সমকালীনতার সাক্ষ্য দেয়া নয় বরং সমকালীনতার মধ্যে যে রহস্য আছে সেই রহস্যের নিগূঢ় অন্তরালকে উন্মোচন করা। অর্থাৎ মানুষের মনে আশা-ভরসা ও স্বপ্ন সৃষ্টি করা। এখানে কোন কবি প্রধান ভূমিকা পালন করবেন বা করছেন এটা ধর্তব্যের বিষয় নয়। কারণ দেখা গেছে যে, সমকালের অনেক প্রধান কবি আয়ু ফুরিয়ে গেলে নিঃশেষিত হয়ে যান। এমনকি পাঠক নিজের অজান্তেই সেই কবির নাম উচ্চারণ করতে ভুলে যায়। যেহেতু কবরের মাটি ফাটিয়ে ওই কবির প্রাত্যহিক সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় তার নামটি মুদ্রিত করার জন্য প্রত্যাবর্তনে আর পারঙ্গম হন না সম্ভবত সে কারণেই বিস্মৃতির অন্ধকারে একধাপ মাটির নিচেই তাকে পরকালের অপেক্ষা করতে হয়। তিনি পরকাল মানুন আর না মানুন অপেক্ষার জগতে তাকে থাকতেই হবে সুবিচারের আশায়।
আমাদের সাম্প্রতিক কবিতা মূলত একবিংশ শতাব্দীর কবিতা হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত। দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, এ সময়ের কবিতার সমস্ত উপমা, উৎপ্রেক্ষা ও বিবরণ অত্যন্ত গতানুগতিক এবং গত শতাব্দীর অনুষঙ্গে ঠাসা। প্রেম যে কবিতার একটি মহার্ঘ বিষয় সেটাও যৌনতাড়িত তরুণ কবির পঙ্ক্তি রচনায় হাস্যকর হয়ে উঠেছে। তাদের কবিতা পড়ে মনে হয় তারা তাদের সমস্ত প্রেমের আর্তি মূলত তাদের চেনা কয়েকটি নারীকে ছলেবলে করায়ত্ত করার মরিয়া প্রয়াস মাত্র। প্রেমের কৌশল কখনো প্রেম নয়। প্রকৃতির ভেতর পাখি ধরার শিকারীর ফাঁদের মতো চতুর চেষ্টা। এতে এই যুগের যুবতীদের যেহেতু কোনো আস্থা সৃষ্টি হয় না। সে কারণে তারা কবিতা নয় গদ্য ঘটনার বর্ণনা চায়। ফলে এই জট ছাড়াতে পারে একমাত্র একালের প্রতিভাবান কবিত্বশক্তি। তেমন কবি আমাদের নেই এটা সত্য নয়। আমি কিছু কিছু লক্ষণে তাদের চিনতে পারলেও দৃঢ়মূল শনাক্ত করার মতো শক্তি আমার কোথায়। আমি আগামীকালেকে ঈর্ষা করি না। তবে আগামীকালের সূর্যালোক আমার বয়েসের জন্য যদি আমার কাছে স্পষ্ট না হয় তাহলে হলফ করে একথা কি বলা যায় আমি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা?
জীবনানন্দ দাশ কি জানতেন যে তার মৃত্যুর পর শামসুর রাহমান বা আল মাহমুদ বলে কোনো কবি এসে বাংলা ভাষার মৌচাকে মধু সংযোগ করবে? না, জীবনানন্দ তা জানতেন না। তার রচনায় এমন কোনো আশাও ব্যক্ত করে যাননি। নতুনত্বের স্ফুরণ অনন্ত কাব্যে চিরকালই অভাবিতপূর্বÑ আকস্মিক। প্রতিভাবান কবিত্বশক্তি তার কালকে জিজ্ঞাসা করে আবির্ভূত হয় না এবং কোনো হিসাব দিয়ে কোন জবাবদিহি করে অস্তমিতও হয় না। প্রকৃত কবি তার কবিতার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত থাকেন এমন কথা আমি সাহিত্যের ইতিহাসে খুঁজে পাইনি। আমি নিজেই নিঃশঙ্কচিত্তে আমার আয়ুষ্কাল অতিক্রম করে যাচ্ছি। আমি আমার শাকান্ন আহার করে পরিতৃপ্ত। আমি যিশু খ্রিষ্টের মতো কখনো বলব না যে সিজারের মুখ আঁকা মুদ্রা সিজারকে দাও। আর ঈশ্বরের প্রাপ্য ঈশ্বরকে দাও। আমি বরং কবি হিসেবেই চিরকাল এ কথা বলে যাবো যে, সিজারের মুখ আঁকা মুদ্রাও আমার প্রভুকে দাও। আমার বিশ্বাসের বেদিতে তর্পণ করো। কোরবানি করে দাও নিজেকে আমার প্রভুর বেদিতে।
শেষ পর্যন্ত দার্শনিকতা কাব্যরস সৃষ্টিতে কবিকে নানা ধরনের দুর্বোধ্যতা ও অস্পষ্টতায় নিমজ্জিত করে। বচন সৃষ্টির প্রাথমিক শর্ত হলো আনন্দ। কবির মনে আনন্দের আকাক্সক্ষা জমে উঠলে তিনি উপযুক্ত ভাষায় সে আনন্দ ব্যক্ত করার আয়োজন করবেনই। ছন্দ, মিল-মাত্রাও কবির সহজাত দক্ষতার বিষয়। এ সব কবিকে কখনো ব্যাকুলতায় ভোগায় না। এ নিয়ে তার বিশেষ বিবেচনা থাকতে পারে। কিন্তু আনন্দটাই প্রকাশযোগ্য বেদনা হয়ে তার সত্তাকে আকুল করে।
আমাদের দেশের কবির প্রধান বিপদ হলো রাজনীতি, রাজনীতিবিদদের দ্বারা কবিকে দলীয় পক্ষপুটে টেনে আনা। রাষ্ট্র কবির পৃষ্ঠপোষকতা করুকÑ এটা কবি মাত্রেরই আকাক্সক্ষা। কিন্তু দলীয় রাজনীতি কবিকে বৃত্তাবদ্ধ রাখুক এটা কবিতার জন্য অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। রাজনৈতিক বৃত্তে আবদ্ধ কবিমাত্রেই আক্ষেপের রোগে আক্রান্ত থাকেন। এ রোগ যক্ষ্মার চেয়েও ক্ষয়কারী এবং কর্কটের চেয়ে উৎকট। এদেশের সর্বাধুনিক চিন্তার উদগাতা সব সময় কবিরাই হয়েছে। কিন্তু আক্ষেপের বিষয় এই যে, নির্বোধ রাজনীতি সব সময়ই কবিকে আশ্রয়দাতা ছদ্মবেশে নিরাশ্রয় এবং জনগণ ও সমাজ থেকে অনিকেত রাখতে চাইছে। কবিকে দিয়ে এমন কথা বলাতে চেয়েছে যা কোনো অবস্থাতেই কবির জিহ্বা থেকে নিঃসৃত হতে চায় না। অথচ শাসক ও রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকারীরা নির্বোধ বলে তা সর্বপ্রথম যিনি উপলব্ধি করেন তিনি কবি। রাজার নৈকট্যপ্রাপ্ত রাজকর্মচারীরা নির্বুদ্ধিতার প্রশংসাকারী। এটাই তাদের জীবিকা। কবি চিরকালই জীবিকা বিষয়ে উদাসীন প্রাণী।
তবুও আমাদের দেশে কাব্য সৃষ্টি হয়। এর কারণ এদেশের প্রকৃতি এবং ঘন সবুজ পল্লবে আচ্ছাদিত রসালো মাটি। প্রকৃতি কিছু মানুষকে জাগতিক বাস্তবতা বিষয়ে উদাসীন করে জন্ম দেয়। এ জন্যই ‘সবাই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’ আমি তরুণ কবিদের সর্বপ্রকার কাব্য প্রয়াসকেই সমর্থন করতে চাই। তবে কবি হিসেবে আমার ঈর্ষা ও সমালোচনার কথাও আমি অস্বীকার করি না। প্রচলিত প্রথা হলো যে কবিতা তারুণ্যের মুখাপেক্ষী।
কিন্তু আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে জানি কবিতা তথা সৃজনশীল সাহিত্য বহু বিচরণশীল অভিজ্ঞতা ও বার্ধক্যেরও মুখাপেক্ষী। ব্যাপক পাঠ ও পর্যবেক্ষণের কাতরতায় কম্পমান। কবি অধ্যাপনাবৃত্তি গ্রহণ না করুক এটাই আমার পছন্দ। তবে কবিকে বলতে হবে। বক্তৃতায় এবং বিবরণদানে কবির মধ্যে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততা একান্ত কাম্য। মনে রাখতে হবে তরুণ শব্দটির অর্থ হলো কম বয়সী, কম অভিজ্ঞতা ও অল্প বোধসম্পন্ন চঞ্চল প্রাণ। এমন একটা তারুণ্য জগতের সব কবিকেই অতিক্রম করে আসতে হয়। কিন্তু বার্ধক্য ও পূর্ণতা কবিকে প্রবীণ করে তোলে। এ কথা ভুলে গেলে চলে না। হ


আরো সংবাদ



premium cement
মসজিদের ভেতর থেকে খাদেমের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার মোরেলগঞ্জে সৎভাইকে কুপিয়ে হত্যা দুবাই পানিতে তলিয়ে যাওয়ার কারণ কি কৃত্রিম বৃষ্টি ঝরানো? এ দেশের ঘরে ঘরে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দিতে হবে : ডাঃ শফিকুর রহমান পিছিয়েছে ডি মারিয়ার বাংলাদেশে আসার সময় ইরানে হামলা : ইস্ফাহান কেন টার্গেট? মাত্র ২ বলে শেষ পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড প্রথম টি-টোয়েন্টি জেলে কেজরিওয়ালকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ দলের ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের জেরে সাংবাদিকসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা তোকে যদি এরপর হলে দেখি তাহলে খবর আছে, হুমকি ছাত্রলীগ নেতার বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক মামলা করা হয়নি : প্রধানমন্ত্রী

সকল