২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মোদির ক্ষমতায় ফেরার সম্ভাবনা কতটুকু?

-

ভারতের কেন্দ্রীয় সংসদ বা লোকসভা নির্বাচন হওয়ার সময় আরো কাছে ঘনিয়ে এসেছে। গত ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের অভিজ্ঞতার কথা মনে রাখলে বলা যায়, পুরো এপ্রিল-মে মাসজুড়ে এবারো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং তা হবে কয়েকটা পর্বে, যেমন গতবার হয়েছিল নিরাপত্তার স্বার্থে পাঁচ পর্বে দুই মাস ধরে বিভিন্ন দিনে। আর সবশেষে মে মাসের মাঝামাঝি একসাথে ভোট গণনা ও ফলাফল প্রকাশিত হয়েছিল। এমনকি নতুন সরকারও গঠিত হয়ে শপথ নিয়েছিল মে মাসের মধ্যেই। অর্থাৎ এক মাস পর থেকেই নির্বাচনী আমেজ শুরু হয়ে যাবে। নির্বাচন কমিশনের আওতায় চলে যাবে প্রশাসনিক কাঠামো। সরকার চালানো আর রাজনৈতিক তৎপরতার ওপর কমিশনের বিভিন্ন বাধানিষেধ আরোপিত হতে শুরু করবেÑ নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে সব কিছু। মোদির সরকারের ‘ফ্রি হ্যান্ড’ মাতবরিতে রাষ্ট্র-প্রশাসন বিরোধীদের ওপর অপব্যবহারের সুযোগ ইদানীং প্রবল হয়েছে; যেমনÑ অপছন্দের বিরোধী দলকে বেকায়দায় ফেলে বিজেপির কাছে আসতে বা কোণঠাসা হতে বাধ্য করছে। এর সুযোগ আর থাকবে না। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের নামে ভারতের কথিত সিবিআই-ইডি ব্যবহার করে মমতার মতো মোদিবিরোধীদের হয়রানি করার অভিযোগে, মোদির সেসব কাজ করার সুযোগ শেষ হয়ে পরিস্থিতি নির্বাচন কমিশনের অধীনে নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে।
ফলে ইতোমধ্যেই আসন্ন নির্বাচনে কী কী ইস্যু প্রধান হয়ে উঠবে, তাও পরিষ্কার হয়ে গেছে। যে কথা বলছিলাম, সিবিআই-ইডির কথা। ‘মোটা দাগে’ বললে, এটা আমাদের দুদকের মতো না হয়ে, এটা বরং পুলিশ প্রশাসনের অধীনেই এক বিশেষ তদন্ত-অনুসন্ধানের বিভাগ। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল বাইরের যেকোনো হস্তক্ষেপ বা প্রভাবমুক্ত থেকে আদালতের নির্দেশ-সিদ্ধান্তে এর হাতে দেয়া কোনো ঘটনার নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত-অনুসন্ধান রিপোর্ট পাওয়া। বাংলাদেশের দুদকের মতো প্রতিষ্ঠানের চেয়ে সিবিআই এ জন্যই অনেক বেশি সফল, শক্তিশালী ও পেশাদার প্রতিষ্ঠান। মনে রাখতে হবে, তবুও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতার অপব্যবহার ঘটে চলছে; এটা অপব্যবহারমুক্ত প্রতিষ্ঠান বলা যাচ্ছে না।
এর সবচেয়ে বড় প্রকাশ ছিল মমতার রাজ্যের পুলিশ কমিশনারের বিরুদ্ধে মোদির সিবিআই লেলিয়ে দেয়া। এতে মাঠের চেহারা দাঁড়ায় এমন যে, কলকাতায় আসা কেন্দ্রের সিবিআই দলকেই রাজ্য পুলিশের বাধা দেয়া শুধু নয়, উল্টো সিবিআই অফিসারদের গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। সাদা চোখে দেখলে আবার ব্যাপারটিকে মোদির মুখ্যমন্ত্রী মমতার বিরুদ্ধে সিবিআই ঘটিত নেহায়েতই এক অপব্যবহার মনে হলেও এর ভেতরে ভারত রাষ্ট্র অনৈক্যের শিকার হওয়া ইস্যু আরো উদোম হয়ে সামনে আসাও নজরে আসবে। এটি আবার মূলত হলো ভারত রাষ্ট্রক্ষমতার ‘কেন্দ্র বনাম রাজ্যের লড়াই’। তা ভারত রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার সময়ের মৌলিক ও গভীর দুর্বলতা। ভারত এখন মোট ২৯টি রাজ্যের দেশ। কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা মূলত কোন রাজ্যের হাতে? সে রকম কোনো একটা রাজ্য অন্যান্য রাজ্যের ওপর ছড়ি ঘুরাচ্ছে কি না। এসব প্রশ্নকে ভারতের জন্মের সময় থেকেই পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে। অথচ এভাবেই বাস্তবতা হলো। কথিত এই হলো, ‘কেন্দ্রীয় ক্ষমতাটাই’ এক ভুতুড়ে ক্ষমতা হিসেবে থেকে গেছে। এই ক্ষমতা কার হাতে এবং কেন এর জবাব খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ‘হিন্দি-বলয়’ বা ‘হিন্দিতে কথা বলা’ রাজ্য নামে একটি পরিভাষা দিয়ে বলা হয়েছে, এদের হাতেই ভারতের কথিত কেন্দ্রীয় ক্ষমতা এ পর্যন্ত বিরাজ করে এসেছে। আর অন্য সব রাজ্যের ঘাড়ের ওপর কর্তৃত্য চালিয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় এই ক্ষমতা আদায়কৃত রাজস্ব কাকে কতটা দেবে সেটি নিয়ন্ত্রণ করে। এভাবে বাকি সব ক্ষেত্রেই কেন্দ্রের নামে এই ভুতুড়ে ক্ষমতা রাজ্যগুলোর ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতার ভাষায়Ñ ক্ষমতার কেন্দ্র বনাম রাজ্যের বৈষম্যের বিরুদ্ধেই তার মূল লড়াই, এটাই তার রাজনীতি। এরই একটা প্রকাশ হলো সিবিআই প্রতিষ্ঠানকে রাজ্যের বিরুদ্ধে কেন্দ্রের অপব্যবহার করা। আর সব রাজ্যই অনুভব করে ‘কেন্দ্র’ নামে এক ভুতুড়ে ক্ষমতা তার ঘাড়ে চেপে আছে। কিন্তু কী করে এর বিরুদ্ধে লড়বে, তাদের কাছে তা এখনো অস্পষ্ট। মমতাই একমাত্র মুখ্যমন্ত্রী যিনি কেন্দ্র-রাজ্যের ক্ষমতার বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তবে, কী করলে এর সমাধান আসবে তা সুনির্দিষ্ট করে বলার ক্ষেত্রে পুরো ভারতের রাজনীতিবিদ, একাডেমিকসহ সমাজের সবাই অস্পষ্ট। বলা যায়, একাডেমিক স্তরে ইস্যুটি নিয়ে আলোচনাই শুরু হয়নি। তবে মমতা বৈষম্যের কথা তুলে ধরার ক্ষেত্রে সবার চেয়ে এগিয়ে। কিন্তু সমাধান কী? এর এক কথার জবাব হলো কথিত, ভারত রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা ভেঙে দিয়ে এক ফেডারেল কাঠামোর রাষ্ট্রব্যবস্থায় চলে যাওয়া। এর আদর্শ উদাহরণ আমেরিকা, তার ফেডারেল স্টেট কাঠামো। এ কারণে ৫০ রাজ্যের আমেরিকার মাত্র এক-দুইটা রাজ্য বাকি সব রাজ্যের ঘাড়ে চড়ে মাখন তুলে নিয়ে খাচ্ছে, বা মাতবরি করছে এমন অভিযোগ আমেরিকার জন্মের আড়াই শ’ বছর পরও ওঠেনি।
এখনকার সারকথা হলো, কেন্দ্র ও রাজ্যের ক্ষমতার বৈষম্য, এ বিষয়টিকে মমতা নির্বাচনে ইস্যু হিসেবে হাজির করতে সফল হয়েছেন। কেন্দ্রীয় ক্ষমতা অপব্যবহারের দায়ে মোদির বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে সেসব বিরোধী দলকে একাট্টা করতে সক্ষম হয়েছেন। এটাই আসন্ন নির্বাচনে একটা মুখ্য ইস্যু হিসেবে রূপ পেয়েছে।
দ্বিতীয় ইস্যু হলো, চাকরি বা কাজ সৃষ্টি। গত ২০০৪ সাল থেকে পরের ১৫ বছরে ভারতের তিন সরকারের আমলে প্রধান ইস্যু ছিল এটা। অন্য ভাষায়, ইস্যুটির নাম সরকার ‘অর্থনীতিতে ভালো’ করেছে বা সাফল্যের সাথে তা চালাতে পেরেছে কি না। এর জবাব, আসন্ন নির্বাচনের আগের মূল্যায়নে বলা যায়, এই ইস্যুতে মোদি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছেন। এর সর্বশেষ প্রমাণ হলো, এক পরিসংখ্যান রিপোর্ট মোদির সরকার নির্বাচনের আগে প্রকাশ করতে বাধা দিয়েছে, এই অভিযোগে জাতীয় পরিসংখ্যান কমিশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধানসহ দুই সদস্য পদত্যাগ করেছেন। সে রিপোর্ট বলেছে, কাজ সৃষ্টি বা চাকরির সংস্থান এই সরকারের আমলে গত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ।
এই পরিসংখ্যানের মধ্য দিয়ে যে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে তা ভারত রাষ্ট্রের জন্য আরেক কারণে খুব খারাপ ইঙ্গিত। ১৯৮৫ সালের পর থেকে ভারতের ‘কেন্দ্রীয় সরকার’ (যেটা ভুতুড়ে বা অস্পষ্ট সাফাইয়ের ক্ষমতা বা হিন্দি বলয়ের কোটারি ক্ষমতা) ধারণাটাই দুর্বল হতে শুরু করেছিল। কংগ্রেস বা বিজেপির মতো কোনো সর্বভারতীয় দলের আর বিজয় লাভ করে কেন্দ্রীয় ক্ষমতা বলে ভুতুড়ে ক্ষমতায় আসতে সক্ষমতা ছিল নাÑ এ দৃশ্যই প্রধান ফেনোমেনা হিসেবে সামনে আসতে শুরু হয়েছিল। এর বদলে আমরা দেখছিলাম, সর্বভারতীয় দল দু’টি আর এককভাবে নয়, বরং আঞ্চলিক দলের সাথে জোট করে কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করাÑ এই নতুন ফেনোমেনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ বা বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ জোট এভাবে কোয়ালিশন গড়াই সরকার গঠনের প্রধান ধারা বলে হাজির হয়েছিল। আবার গত ৩০ বছরের এই ফেনোমেনার বিরুদ্ধে ব্যতিক্রম হলো, ২০১৪ সালের চলতি মোদি সরকার। এটাও একটা এনডিএ কোয়ালিশন সরকার সে কথা সত্য। কিন্তু এনডিএ জোট গঠন ছাড়াও মোদির বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতাও আছে। মোদি এই ব্যতিক্রম ঘটাতে পেরেছিলেন কেন? কারণ, মূলত কাজ সৃষ্টির ইস্যু। ২০১৪ সালের মোদি প্রবল প্রচারণা চালিয়ে হতাশ ভোটারদেরকে আস্থায় নিতে পেরেছিলেন যে, গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী মোদি সেবার কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করতে পারলে (অর্থনীতিতে ভালো করে) ব্যাপক কাজ সৃষ্টি করতে সক্ষম হবেন। কিন্তু পাঁচ বছর শেষে এবার হতাশ ভোটাররা দেখছেন, সেই আস্থা যেন ধুলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। অর্থাৎ চাকরি সৃষ্টিতে ব্যর্থতা-হতাশার মানে হলো, এবারে ভারতের নির্বাচনে আবার সর্বভারতীয় দল দু’টির ওপর প্রবল অনাস্থা (কেন্দ্রীয় ভুতুড়ে ক্ষমতার ওপর অনাস্থা) স্থায়ী হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা।
এর সোজা অর্থ আরো ব্যাপকভাবে, এবার বিজেপি অথবা কংগ্রেসের নেতৃত্বের আঞ্চলিক দলগুলোকে সাথে নিয়ে কোনো কোয়ালিশন সরকার নয়, বরং (১৯৯৬ সালের দেবগৌড়া সরকারের মতো) কেবল আঞ্চলিক দলগুলোরই কোয়ালিশন সরকার গঠিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। মোদির ‘কাজ সৃষ্টিতে’ চরম ব্যর্থতার প্রভাবে এমন ঘটার সম্ভাবনা প্রবল হয়েছে।
তৃতীয়ত, গরু, গো-মাতা বা গো-রক্ষক মোদি ইস্যু! হিন্দুত্বের হুজুগ তুলে বা জোয়ার তুলে সমাজে মেরুকরণ ঘটিয়ে ভোটের বাক্স ভরতে হবেÑ এটাই বিজেপি-আরএসএসের রাজনীতির সারকথা। এই উদ্দেশ্যে গরুকে হিন্দুত্বের রাজনৈতিক প্রতীক বানিয়ে পাঁচ বছর ধরে মাংস বহন করেছে বা ফ্রিজে রেখেছে অথবা গরু কেটেছে ইত্যাদি হুজুগ তুলে পাবলিক লিঞ্চিংয়ের ব্যাপকতা দেখা গেছে; এর সামাজিক তাণ্ডবে মোদি নিজেকে গরু-পূজারী, গো-মাতা বা গো-রক্ষক হয়ে হাজির করে গেছেন। কিন্তু মোদি ‘গরুর রাজনীতি’তেও পরাজিত।
মূল কারণ, যেকোনো কর্মসূচি অর্থনৈতিক দিকও টেকসই কি না; মানে, সেদিক থেকেও টিকে থাকার সক্ষমতা থাকতে হয়। মোদির গরুর রাজনীতির অর্থনৈতিক দিকও টেকসই কি না তা আগেই পরীক্ষা না করাতে, এর ব্যর্থতা থেকেই মোদি এখানে হেরে গিয়েছেন। যে সমাজে গরু কৃষির উপকরণ সে সমাজে মাংস হিসেবেও গরুর ব্যবহার থাকতে হবে বা থাকবেই। এমনকি ধর্মীয় বা কোনো কারণে, মাংস নিজেরা না খেলেও অন্তত রফতানি করতে হবে। এই সত্য মোদি মানতে চাননি, বোঝেননিÑ তাই তিনি ব্যর্থ। মূল ব্যাপারটি হলো, একটা বয়সের পরে গৃহপালিত গরুকে আর কৃষিতে বা মাল টানার কাজে ব্যবহার করা যায় না। তখন থেকে গরুকে আর বসিয়ে খাওয়ানো মালিকের পক্ষে দায় হয়ে যায়। এর সামাজিক সমাধান ছিল, গরুকে বিক্রি করে দেয়া। এর সোজা অর্থ হলো, মাংসের উৎস হিসেবে ব্যবহারের জন্য গরুকে ব্যবহার করতে দিয়ে দেয়া, যার মাধ্যমে গরুর জীবনচক্রের একটা সমাপ্তি টানা। কিন্তু মোদির হিন্দুত্ব মাংসের জন্য গরুকে বিক্রি করতে দেয়া যাবে না বলে অবিবেচক বাধা তৈরি করে। কিন্তু গরুকে সেই পর্বে খাওয়াবে কে, এর কোনো বিকল্প ব্যবস্থা করলেন না। নামকাওয়াস্তে কিছু গো-শালা বানালেও তা রক্ষণাবেক্ষণ আর গরুকে খাওয়ানোর বরাদ্দ নিশ্চিত করলেন না। বাস্তবে কতগুলো গো-শালা বানাবেন? বাড়ি থেকে গো-শালা বেশি দূরত্বের হলে গাড়ি ভাড়া করে কেউ গরু দিতে যেতে চাইবে না। এতে আবার গরুকে খাওয়ানোর দায়িত্ব নিতে অপারগ কৃষক এবার গরুর দড়ি খুলে ছেড়ে দেয়াকেই একমাত্র ও সহজ উপায় মনে করল। কিন্তু তাতেও ‘গরু খাবে কী’ ব্যাপারটা শেষ হলো না। গরু তাই এবার ব্যাপক হারে কৃষকের ফসলি জমিতে গিয়ে হামলে পড়ল। ফলে রাত-দিন জমি পাহারা দিয়ে ফসল বাঁচানো এক বিরাট মাথাব্যথা আর খরচের নতুন খাত হিসেবে হাজির হলো। ব্যাপারটা এতই মারাত্মক যে, গত ডিসেম্বরে রাজস্থানের রাজ্য নির্বাচনে ‘ছাড়া গরু’ মোকাবেলা করা নির্বাচনী ইস্যু হয়ে হাজির হয়েছিল। অর্থাৎ ছাড়া গরু ইস্যু উল্টো মোদির ভোট কেটে রাজস্থানে বিজেপিকে পরাজিত করেছিল। তাই এখন চাকরি সৃষ্টি না করতে পারার ব্যর্থতা, না ছাড়া গরুর সমস্যাÑ কোনটা মোদির প্রধান ব্যর্থতা বলে হাজির হবে, তা নিয়ে এখন জল্পনা-কল্পনা।
চতুর্থত, হিন্দুত্বের নাগরিকত্ব বিল। নতুন এই আইন লোকসভায় বা কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টে আনা বিল হলেও এটা মোদি করেছিলেন মূলত সারা ভারতে এটা প্রযোজ্যÑ তেমন ভেবে নয়, বরং বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ ও আসামসহ নর্থইস্টÑ এ দুই পকেটের রাজ্যগুলোর জন্য। তারা আবার মোট আট রাজ্যের (নর্থইস্ট সাত রাজ্য আর পশ্চিমবঙ্গ) হলেও এখানে লোকসভার মোট আসন হলো ৬৬টা। ভারতের লোকসভার মোট ৫৪০ আসনের মধ্যে সরকার গড়ার জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় আসন পেতে হয় ২৭২টিÑ এ পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামসহ নর্থইস্টের মোট ৬৬ আসনের কথা মাথায় রেখে মোদি নাগরিকত্বের বিলটা এনেছিলেন। কিন্তু তার কপাল এখন একেবারেই ফাটা, যেখানে হাত দেন সব ব্যর্থ।
তার অনুমান ছিল এই বিল তাকে নির্বাচনের ৬৬ আসনে বিজেপির পক্ষ জিততে মাইলেজ দেবে। এটা ছিল তার সবচেয়ে ভুল অনুমান। কারণ ইতোমধ্যেই তিনি ব্যর্থ। কারণ, নর্থইস্ট সাত রাজ্যে তা ‘ব্যাকফায়ার’ করেছে। মোদির ভোট পাওয়া দূরে থাক, ওই সাত রাজ্যে তারা এখন ইউনিয়ন ভারতের সাথে থাকা ছেড়ে, ‘ভেগে যাওয়া’র আন্দোলন শুরু করে দিয়েছে। ওদিকে আসামে এখন রাজ্য সরকারে আছে বিজেপি। কিন্তু আসামের মূল নাগরিকদের সব দল ও পক্ষই এখন বিজেপির বিরুদ্ধে। জনসম্মতির রেটিংয়ে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় বিজেপি। বাকি থাকল পশ্চিম বাংলা। কিন্তু সেখানে মোদির বিরুদ্ধে মমতার সংগ্রাম ও বিরোধিতা প্রবল আর সফলই বলা যায়। কারণ, মমতা তার নেতৃত্বে আঞ্চলিক দলগুলোকে বিজেপির এবং মোদির বিরুদ্ধে একাট্টা করতে সক্ষম হয়েছেন, আর স্বভাবতই এতে মোদির বিরুদ্ধে ‘বাংলার স্বার্থের ধারক’ হলেন মমতাÑ এ কথা বলে পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ ভোটারের সহানুভূতি তিনি নিজের ব্যাগে তুলে ফেলেছেন।
তাহলে কী দাঁড়াল? কারা এই বিলের পক্ষে? বাংলাদেশের মতো পড়শি দেশের যেসব হিন্দু আছেন, এদের অনেকে মোদির ভক্ত। কিন্তু তাতে মোদির কোনো লাভ নেই এ জন্য যে, তারা কেউ ভারতের ভোটার নন। কাজেই পড়শি দেশের হিন্দুদের স্বার্থে পশ্চিম বাংলার হিন্দুরা কতটা মোদির ভোটের বাক্সে ভোট দেবেন তা এখন প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ, মমতার কারণে কেন্দ্র ও রাজ্য ক্ষমতার লড়াইয়ে পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় স্বার্থে তারা এখন হিন্দিবলয় বিরোধী; মমতা সেখানে মোদিকে ‘ভিলেন’ হিসেবে দেখাতে পেরেছেন।
ওদিকে খোদ মোদি সরকারের দায় আরএসএস নিতে চাচ্ছে না। তারা এখন মোদি সরকারের বিরুদ্ধে জন-অসন্তোষের পক্ষে সহানুভূতি দেখিয়ে নিজের ইমেজ বাঁচাতে ব্যস্ত। আনন্দবাজারের শিরোনামÑ ‘বেকারত্ব বাড়ছে, বিরোধীদের সুরে সঙ্ঘ প্রধান, অস্বস্তিতে মোদি’। ওদিকে বিজেপি দলের ভেতরেই মোদি-অমিত গ্রুপের বিরোধিতাকারীরাÑ যেমনÑ শত্রুঘœ সিনহা বা যশবন্ত, সিনহা অরুণ সুরিÑ এরা প্রকাশ্যেই বিরোধিতায় নেমেছেন। এমনকি মমতার সমাবেশ র্যালিতেও অংশ নিচ্ছেন।
তাই সব মিলিয়ে আমরা লক্ষ করছিÑ আসন্ন নির্বাচনী ফলাফলের ঝোঁক হলো, মোদির বিজেপির ক্ষমতায় ফিরে আসার সম্ভাবনা সবচেয়ে কম। কিন্তু তা সত্ত্বেও আবার বিকল্প হিসেবে কংগ্রেসের নেতৃত্বে কোনো কোয়ালিশন ক্ষমতার দাবিদার নয়, বরং কেবল আঞ্চলিক দলগুলো। এদেরই কোনো কোয়ালিশন সরকারের সম্ভাবনা ক্রমেই জেঁকে বসা, এটাই প্রবল হচ্ছে। হ
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement