১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আদর্শ, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ

-

আদর্শ, নৈতিকতা ও মূল্যবোধÑ এই শব্দগুলো অহরহ ব্যবহৃত হচ্ছে। মূলত গভীর তাৎপর্যবাহী শব্দগুলোর ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। আমরা অনেক ক্ষেত্রে এগুলোর প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্য না জেনেই শব্দগুলো ব্যবহার করে থাকি। আমরা যদি আদর্শের কথা বলি তাহলে বলতে হয়, পৃথিবীতে একাধিক আদর্শিক মতবাদ প্রচলিত আছে। যেমন, ইসলামী আদর্শ, সমাজতান্ত্রিক আদর্শ, গণতান্ত্রিক আদর্শ। আমাদের বক্তব্যের মধ্যে আমরা কোন আদর্শের প্রচার করতে চাই তা স্পষ্টভাবে বলা প্রয়োজন। তেমনিভাবে ‘নৈতিকতা’ শব্দটিও একাধিক অর্থে ব্যবহার করা হয়। যেমন, পাশ্চাত্য সভ্যতায় উভয়ের সম্মতিতে বিবাহপূর্ব যৌন মিলন তাদের মাপকাঠিতে অনৈতিক বিষয় নয়। এমনকি পশ্চিমা বিশ্বে বিবাহপূর্ব সন্তানকে সমাজ ও রাষ্ট্র স্বীকৃতি প্রদান করেছে। অথচ আমাদের সমাজে যেকোনো ধর্মের আওতায় এ ধরনের যৌন মিলনকে অনৈতিক সম্পর্ক হিসেবে গণ্য করা হয়।
অপর দিকে আমাদের সমাজে যেকোনো পরিবেশে মদ পান গুরুতর অনৈতিক কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়। আজকাল মূল্যবোধ শব্দের ব্যাপক ব্যবহারও লক্ষ করা যায়। এই শব্দের অর্থ মানুষের আচরণ পরিচালনকারী নীতি ও মানদণ্ড। মানুষের আচরণের মানদণ্ড বিশ্বাস ও নীতির ওপর নির্ভর করে। পৃথিবীর সব মানুষের বিশ্বাস একই হয় না। একজন ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী মানুষ ইসলামের আদর্শিক বিশ্বাসের ভিত্তিতেই মূল্যবোধ নির্ণয় করে। ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী ব্যক্তি অপরকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য সালাম দিয়ে থাকে। অপর দিকে, অন্য ধর্মের মানুষেরা তাদের নিজ নিজ ধর্মীয় মূল্যবোধের ভিত্তিতে অপরকে সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী মানুষেরা নিজেদেরকে ‘স্রষ্টার প্রতিনিধি’ বলে মনে করে থাকে। সে কারণে স্রষ্টার দেয়া ইসলামী বিধানের আলোকে তার মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে। স্রষ্টার প্রতিনিধি হিসেবে মূল্যবোধের ধারক ও বাহক কখনো স্রষ্টার বিধানের বাইরে জীবনকে পরিচালিত করতে পারে না। মহানবী সা: ও তার সহচরবৃন্দের জীবনাদর্শ পর্যালোচনা করলে আমরা এ কথার সত্যতা উপলব্ধি করতে পারি। জীবনের চরম সন্ধিক্ষণেও মহানবী সা: ও তার সহচরেরা নৈতিকতা, আদর্শ ও মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত হননি। সে কারণে তাদের মাধ্যমে এক সোনালি সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব হয়েছিল। আজকের দিনে ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী ব্যক্তিরা ইসলামের আদর্শকে ব্যক্তিজীবনে সঠিকভাবে লালন করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এ কারণে তাদের মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিশেষ কোনো পরিবর্তন ঘটছে না। মুখে মূল্যবোধের কথা বলে অনেকে ভিন্ন ধরনের সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সমাজতান্ত্রিক আদর্শের একজন মানুষ ‘শ্রমিকরাজ’ কায়েমের লক্ষ্য নিয়ে তার মূল্যবোধ লালন করে থাকেন। জীবনের সব ক্ষেত্রে তিনি ‘শোষণমুক্ত সমাজ’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তার মূল্যবোধকে প্রকাশ করে থাকেন।
সমাজতান্ত্রিক নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও আদর্শে বিশ্বাসী ব্যক্তি হিসেবে লেনিন ও মাওসেতুংয়ের নাম উল্লেখ করা যায়। তারা রাশিয়া ও চীনে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন। অথচ আজকের দিনে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের নেতারা শ্রমিকরাজ প্রতিষ্ঠার স্লোগান দিয়ে নিজেরা আয়েশি জীবনযাপন করে থাকেন। এমনকি সমাজতন্ত্রের সূতিকাগার রাশিয়া ও চীন সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধ থেকে পিছু হটে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার দিকে ক্রমান্বয়ে ঝুঁকে পড়ছে। গণতান্ত্রিক আদর্শ বিকশিত হয়েছিল মানুষের মৌলিক অধিকার যথা বাকস্বাধীনতা, পরমতসহিষ্ণুতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য নিয়ে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে। অথচ বর্তমানে সে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশের অবনতি ঘটেছে।
আমরা যে মূল্যবোধের প্রচার করি মূলত অনেক ক্ষেত্রে তা ব্যক্তিজীবনে বাস্তবায়ন করতে সচেষ্ট হই না। সঙ্কীর্ণ স্বার্থের আবর্তে নৈতিকতা, আদর্শ ও মূল্যবোধ বিসর্জিত হচ্ছে। অবশ্য ব্যতিক্রমধর্মী কিছু মানুষ আছেন, যারা চরম মুহূর্তেও নৈতিকতা, আদর্শ ও মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত হন না। তাদের সংখ্যা বর্তমান সমাজে খুবই কম। সে কারণে সমাজে ও রাষ্ট্রে অবক্ষয় ও বিশৃঙ্খলা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। আমরা মর্মার্থ না বুঝে উল্লিখিত শব্দগুলো ব্যবহার করে থাকি। ফলে সাধারণ মানুষ এসব শব্দের প্রকৃত তাৎপর্য বুঝতে অনেক ক্ষেত্রে গলদঘর্ম হয়ে থাকে। মূলত আমরা অনেকে দুর্বোধ্য ভাষার আবরণে নিজের প্রকৃত বিশ্বাস আড়াল করার অপচেষ্টা করে থাকি। আবার অনেকে আদর্শের আড়ালে সত্য ঢেকে ফেলার অপচেষ্টা চালাই। ফলে আমাদের এ ধরনের আচরণে মানুষ প্রতারিত হয়। আমরা যদি আদর্শ, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে জীবনকে পরিচালিত করতে পারি, তাহলে সুখী ও সমৃদ্ধ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement