২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

জাতীয় অধ্যাপক নুরুল ইসলাম

-

বাংলাদেশের চিকিৎসাক্ষেত্রে প্রফেসর নুরুল ইসলাম ছিলেন একজন অনন্য ব্যক্তিত্ব। অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী এই ব্যক্তিত্ব ইসলাম ছিলেন একাধারে বিরল সাফল্য ও জনপ্রিয়তা অর্জনকারী চিকিৎসক এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও গবেষক। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল তার সংগঠন-ক্ষমতা ও প্রশাসনিক দক্ষতা।
মেধার পরিচয় ও সাফল্যের প্রতিশ্রুতি অল্প বয়স থেকেই নুরুল ইসলামের জীবনে পরিলক্ষিত হয়। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পঞ্চাশ দশকের শুরুর দিকে এমবিবিএস পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে কর্মজীবন শুরু করেন। অল্প সময়ে তিনি শিক্ষক ও চিকিৎসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভে সফল হন। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় যে ক’জন খ্যাতিমান চিকিৎসক ছিলেন, তাদের মধ্যে নাম করা যেতে পারে ডা: মহীবুর রব (Internal Medicine), ডা: হাফিজ উদ্দিন (Gynecologist & Obs), ডা: শামসুদ্দিন (Cardiologist), ডা: রেফায়েত উল্লাহ (Ophthalmology), ডা: মিসেস সাইদ (Gynecologist), ডা: নন্দী (General Medicine) প্রমুখ।
পেশাগত জীবনের শুরুতেই ডা: ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত বেশ কয়েকজন চিকিৎসকের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। একজন চিকিৎসকের কাছে রোগীর প্রত্যাশা যে অর্থপূর্ণ ও সহৃদয় মনোযোগ, বিচক্ষণতা সহযোগে রোগীর কষ্টের মূলে পৌঁছানোর সক্ষমতা, পদমর্যাদা নির্বিশেষে রোগীর সাথে সুজনসুলভ আচরণÑ এসব গুণ ছিল ডা: নুরুল ইসলামের সহজাত। তাই তিনি জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য কোনো চেষ্টা না করতেই জনপ্রিয়তা তার অনুসরণ করেছিল।
পেশাজীবনের শুরুতেই বক্ষব্যাধিতে তার সবিশেষ মনোযোগ ছিল। তাই সরকারি বৃত্তি লাভ করে ব্রিটেনের ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ তার জন্য ছিল কাক্সিক্ষত প্রাপ্তি। সাফল্যের সাথে সেখান থেকে টিডিডি ডিপ্লোমা অর্জন করেন। তখন এই তরুণ চিকিৎসক স্কটল্যান্ডের Royal College of Physicians and Surgeons, Edinburgh-এর সৌজন্য ও সহযোগিতায় এমআরসিপি পরীক্ষা গ্রহণের বিরল সুযোগ পেয়ে যান। এই সুযোগ কোনো কাকতালীয় ব্যাপার ছিল না। পেশাগত জীবনের শুরু থেকেই নিয়মিতভাবে British Medical Journalসহ উন্নত বিশ্বের বেশ কিছু গবেষণা জার্নালে তার গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ হয়। ফলে ব্রিটিশ চিকিৎসাবিজ্ঞান মহলে তিনি অপরিচিত ছিলেন না। সবাই জানেন, এমআরসিপি পরীক্ষাটি সে যুগে ছিল অত্যন্ত কঠিন ও সময়সাপেক্ষ। অন্তত তিন-চার বছরের পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া, বিশেষত কোনো Royal Medical College-এর অধীনে অবস্থান ছাড়া এ ধরনের সদস্য পদ তথা Fellowship অর্জন অসম্ভব ছিল। অসাধারণ মেধা ও অদম্য শ্রমের মাধ্যমে সব কিছুই সম্ভবÑ নুরুল ইসলাম তার জীবনে অনেকবারই তা প্রমাণ করেছেন। মাস ছয়েকের মধ্যেই প্রথমবারের মতো পরীক্ষার সুযোগ পেয়ে প্রথম প্রচেষ্টাতেই তিনি Royal College of Physicians and Surgeons (Edinburgh)-এর সদস্যপদ লাভ করার সম্মান অর্জন করেন।
সুদীর্ঘ পেশাগত জীবনে প্রফেসর নুরুল ইসলাম চিকিৎসক হিসেবে, সংগঠন ও প্রশাসনিক দায়িত্বের সুবাদে অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যে জীবন কাটিয়েছেন। তা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে একজন গবেষক ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের একনিষ্ঠ সাধক।
Cecil and Loeb সম্পাদিত Text Book of Medicine বিশ্বখ্যাত এবং মেডিক্যাল শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অবশ্য পাঠ্যগ্রন্থ। প্রায় প্রতি বছর নতুন নতুন তথ্যসমৃদ্ধ হয়ে এর সংস্করণ ছাপা হয়ে থাকে। বেশ কয়েক বছর আগে মুদ্রিত এই অমূল্য গ্রন্থটির একটি কপি বর্তমান লেখকের দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। বইয়ের এই সংস্করণে প্রফেসর ইসলামের আবিষ্কৃত Tropical Isionophilia রোগটির ওপর তার লিখিত প্রবন্ধটি অন্তর্ভুক্ত দেখতে পাই এবং নির্ঘণ্ট দেখে জানতে পারি, ওই সংস্করণে এশিয়া থেকে আর কোনো চিকিৎসাবিজ্ঞানীর লেখাই স্থান পায়নি। বলা বাহুল্য, এটা দেখে বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে বিপুল গর্ব অনুভব করেছিলাম।
প্রফেসর ইসলাম চিকিৎসাশাস্ত্রে আধুনিক তথা সাম্প্রতিক সময়ের সব development সম্পর্কে নিজেকে অবহিত রাখতে চেষ্টার ত্রুটি করতেন না। তেমনি তার আগ্রহ ছিল ভারতীয়, চৈনিক ও মধ্যপ্রাচ্যের ইউনানী পদ্ধতির ক্রমবিকাশের ইতিহাসে। তিনি নিজে একজন খ্যাতিমান Allopath n‡qI Homeopathy ও ইউনানি পদ্ধতিকে প্রাপ্য স্বীকৃতির মর্যাদা দিতে কুণ্ঠিত হননি। উল্লেখ্য, প্রফেসর ইসলাম Hamdard Bangladesh শাখার দীর্ঘ দিন বোর্ড চেয়ারম্যান ছিলেন। তার সংগ্রহে ছিল A History of Medicine in China এবং শিবকালী ভট্টাচার্য লিখিত দশ খণ্ডের ভারতীয় বনৌষধি শাস্ত্রের ইতিহাস।
প্রফেসর ইসলামের সাথে পরিচিতির সুযোগে জানতে পারি, একজন চিকিৎসকের পেশাগত ব্যবহারিক জীবনে National Formulary নামক গ্রন্থটির কত ব্যাপক প্রয়োজন। তার সংগ্রহে দেখেছিলাম British Formulary, American Formulary এবং সাম্প্রতিক Bangladesh Formulary।
ষাটের দশকের আগে আমার জানা মতে, এ দেশে Postgraduate বা ¯œাতকোত্তর পর্যায়ে উচ্চতর শিক্ষার প্রত্যক্ষ সুযোগ ছিল না। এ ব্যাপারে প্রফেসর নুরুল ইসলাম ছিলেন অবিসংবাদিত পথিকৃৎ। ১৯৬০-এর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রতিষ্ঠা লাভ করে Institute of Postgraduate Medicine and Research, যা সংক্ষেপে IPGMR নামে পরিচিতি লাভ করেছিল। এই সময়ে অধ্যাপক নুরুল ইসলামের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে Faculty of Postgraduate Medicine খোলা হয়। এর অধীনে M.Phil I M.D ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি হলো। এ দেশে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে এটা ছিল যুগান্তকারী পদক্ষেপ এবং এই পদক্ষেপের পেছনে চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিশারদ নুরুল ইসলামের ভূমিকা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের প্রায় সব মেডিক্যাল কলেজে ও মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র অধ্যাপকদের নামের সাথে FCPS, M.D পদবিগুচ্ছের সংযোজন তার কীর্তির নীরব স্বাক্ষর।
মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনকালে সর্বপ্রথম একটি নতুন ওষুধনীতি প্রণীত হয়েছিল, যা ছিল সে সময়ের জন্য অতি প্রয়োজনীয়। তখন ওষুধ প্রস্তুতকারী সব কোম্পানির মালিকানা (দু-একটা ছাড়া) বিদেশীদের হাতে ছিল। তারা অতিপ্রয়োজনীয় কাঁচামাল পূর্ণমাত্রায় না দিয়ে; অন্য দিকে বেশি দাম নির্ধারণ করে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছিলেন। প্রফেসর ইসলামের নিরলস গবেষণার মাধ্যমে এই প্রবঞ্চনার প্রকৃত চেহারা তদানীন্তন সরকারের তথা সারা দেশের মানুষের কাছে উদঘাটিত হয়। বিদেশী কোম্পানিগুলোর এই প্রবঞ্চনার অল্প সময়ে অবসান ঘটে সরকারের সময়োচিত হস্তক্ষেপে। বলা বাহুল্য, বিদেশী ওষুধ কোম্পানিগুলো অচিরেই এ দেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে বিদায় নেয়। ফলে এ দেশে ওষুধ শিল্পের এক নবযুগের সূচনা হয়। এর সুফল এখন দেশের মানুষ ভোগ করছে। আমাদের দেশের ওষুধ এখন উন্নত বিশ্বেও সমাদৃত।
১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হলে প্রফেসর নুরুল ইসলাম তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেন। এখানে জানানো প্রয়োজন, ১৯৮৫ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে সিনেট সদস্য হিসেবে চট্টগ্রামে তিনি একটি মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন, যার নামকরণ করা হয়েছিল Institute of Applied Health Sciences, সংক্ষেপে আইএএইচএস। যথাসময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনক্রমে প্রতিষ্ঠানটির বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা কমিশনকে বিষয়টি পাঠানো হয়। প্রফেসর ইসলামের আগ্রহ ও ইচ্ছার প্রতি সম্মান দেখিয়ে তৎকালীন ভিসি তাকে প্রকল্পটির কো-অর্ডিনেটর নিযুক্ত করেন। কিন্তু অচিরেই তিনি উপলব্ধি করলেন, সরকারি আমলাতন্ত্রের কবলে পড়ে তার প্রস্তাবিত মেডিক্যাল কলেজের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। স্বপ্রণোদিত হয়ে তিনি প্রস্তাবটিকে বেসরকারি খাতে বাস্তবায়নের অনুমতি চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের অনাপত্তি জানিয়ে দেন। আইএএইচএস থেকে ইউএসটিসি বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তরণের তথ্যটি এখন বিস্মৃতির গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তবে এই ক্যাম্পাসের অ্যানাটমি ভবনটি আইএএইচএসের কালের সাক্ষী হিসেবে আজো দণ্ডায়মান।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ন’মাস ধরে প্রফেসর ইসলাম নিজের ও তার পরিবারের সদস্যদের জীবনের ঝুঁকি সত্ত্বেও, বঙ্গবন্ধুর মা-বাবাকে সম্মানিত রোগীর মর্যাদা দিয়ে পিজি হাসপাতালে পরম যতœ ও মমতায় তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। পরম করুণাময়ের ইচ্ছায় তিনি এ দায়িত্ব পালনে সফল হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি এমনই ছিল তার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
বাংলাদেশের এই সুসন্তানকে তার স্বদেশ জীবদ্দশায় নানা সম্মানে ভূষিত করেছে। এর মধ্যে ছিল স্বাধীনতা পুরস্কার ও জাতীয় অধ্যাপক পদে নিযুক্তি। জাতীয়পর্যায়ে এ দু’টি ছিল তার সর্বোচ্চ অর্জন।
তিনি ছিলেন চট্টলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন; আর পিতৃভূমির প্রতি ছিল তার সীমাহীন মমতা। অল্প সময়ের মধ্যে ইউএসটিসির সাফল্য বিশ্ববিদ্যালয়টিকে সারা দেশে জাতীয় অধ্যাপক নুরুল ইসলামের সমার্থক করে তুলেছে। প্রাতঃস্মরণীয় মানুষটির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। তার স্মৃতি অম্লান হোক। হ
লেখক : সাবেক ভিসি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 


আরো সংবাদ



premium cement
অধিকার প্রতিষ্ঠায় দেশপ্রেমিক জনতার ঐক্যের বিকল্প নেই : ডা: শফিকুর রহমান সোনাগাজীতে জামাতে নামাজ পড়ে বাইসাইকেল পুরস্কার পেল ২২ কিশোর গফরগাঁওয়ে পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ দিশেহারা : আমিনুল লিবিয়ায় নিয়ে সালথার যুবককে নির্যাতনের ঘটনায় মামলা, গ্রেফতার ১ মনুষ্য চামড়ায় তৈরি বইয়ের মলাট সরানো হলো হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আওয়ামী লীগকে বর্জন করতে হবে : ডা: ইরান আমরা একটা পরাধীন জাতিতে পরিণত হয়েছি : মেজর হাফিজ তরুণীর লাশ উদ্ধারের পর প্রেমিকসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা ভিয়েনায় মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রদূতদের ইফতারে ইসলামিক রিলিজিয়াস অথোরিটি আমন্ত্রিত এবার বাজারে এলো শাওমির তৈরি বৈদ্যুতিক গাড়ি

সকল