২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

শিল্পের ভিত্তি হচ্ছে মালিক-শ্রমিক মৈত্রী

-

তৈরী পোশাক শিল্প দেশে দ্রুত বিকাশমান একটি খাত। গত শতকের আশির দশকে গোড়াপত্তনের পর অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, বাধা-বিপত্তি মোকাবেলা করে এ খাতে সাফল্যের দেখা মেলে। শুরুতে তরুণ উদ্যোক্তারা ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে এলেও ভারত, শ্রীলঙ্কা ও ভিয়েতনামের চেয়ে সস্তা শ্রম হওয়ায় দ্রুত কাক্সিক্ষত সাফল্য আসে। সেই সফলতার ধারাবাহিকতায় এ খাতে এখন লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
তৈরী পোশাক রফতানিতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান এখন দ্বিতীয়। যাদের শ্রম-ঘামে শিল্পটি পায়ের তলায় শক্ত মাটি পেয়েছে, মজবুত ভিতে দাঁড়িয়েছে; তাদের অর্থাৎ শ্রমিকদের ভাগ্যের কাক্সিক্ষত পরিবর্তন ঘটেনি। শরীরের রক্ত পানি করে ন্যায্য পাওনা মেলেনি। উদয়াস্ত কাজ করে তাদের প্রাপ্তি শুধু বঞ্চনা। তারা যে তিমিরে ছিলেন, সেখানেই রয়ে গেছেন। পরিবারের সদস্যদের সুষম খাবার সুদূরপরাহত। সমৃদ্ধির সোনার পাথরবাটি অধরাই রয়ে গেছে।
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, কিভাবে তৈরী পোশাক শিল্পের অনেক মালিক দ্রুততম সময়ে অঢেল সম্পদের মালিক হচ্ছেন। এর একটি সহজ জবাবÑ শ্রমিক ঠকিয়ে। শ্রম শোষণে। শ্রমিকের ঘাম চুরি করে অনেক উদ্যোক্তা শ্রমিক ঠকানোকে কোনো অন্যায় কিংবা অপরাধ মনে করেন না। তাদের চোখেমুখে পুঁজির সর্বগ্রাসী চরিত্র স্পষ্ট। নৈতিকতা বলে যে কিছু আছে, তা বোঝার উপায় নেই। কিভাবে সমাজের ওপরতলার বাসিন্দা হওয়া যাবে, ধনিক-বণিক শ্রেণীতে নাম উঠবে এবং অভিজাত সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হওয়া যায়, সেই স্বপ্নে তারা বিভোর। তাদের ওপরে ওঠার সিঁড়ি শ্রমিকেরা। এর বেশি কিছু নয়। সেই তারাই প্রকৃত মজুরি না দিয়ে দশকের পর দশক ধরে শ্রমিক ঠকাচ্ছেন। তবে এ কথাও ঠিক, কিছু উদ্যোক্তা তাদের কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা দিতে কার্পণ্য করেন না। এ ছাড়া, অনেক মালিক লোকসান গুনে ব্যবসায় গুটিয়ে নিয়েছেন। অনেকে পথে বসেছেন, এমন উদাহরণও আছে।
নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও গত বছর তৈরী পোশাক খাতে রফতানির প্রবৃদ্ধি ছিল ১৫ শতাংশ। শ্রমিকদের ঘাম-শ্রমে যে শিল্পের উত্তরোত্তর বিকাশ, সেই শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করা সরকার ও মালিকদেরই দায়িত্ব। অথচ শ্রমিকের মজুরি নিয়ে পুরনো পথে হেঁটেছেন পোশাক শিল্পের মালিকেরা। তারা বাড়িভাড়া, যাতায়াত, খাদ্য ও চিকিৎসাভাতা কিছুটা বাড়িয়ে দিলেও মূল মজুরি বাড়াতে কৃপণতা করেছেন। গত পাঁচ বছরে শ্রমিকের মূল মজুরি ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধির বিষয়টিও আমলে নেয়া হয়নি। ফলে নতুন শ্রমিকের মজুরি বাড়লেও দক্ষ বা পুরনোদের বেতন বাড়েনি বললেই চলে। মজুরিকাঠামোর এ কৌশলের কারণে সম্প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন শ্রমিকেরা। তৈরী পোশাক খাতের উত্তরোত্তর শ্রী বৃদ্ধি ঘটলেও শ্রমিকদের চেহারা দিনে দিনে ম্লান হচ্ছে। নতুন মজুরিকাঠামো ঘোষণার মধ্য দিয়ে এর উৎকট প্রকাশ ঘটেছে।
শ্রমিকদের দাবি ছিল, তাদের ন্যূনতম মজুরি ১০ হাজার টাকা করার; কিন্তু নতুন মজুরি বোর্ড আট হাজার টাকা নির্ধারণ করে। অথচ মালিকেরা ঠিকই নিজেদের সুযোগ-সুবিধা সরকারের কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছেন। পোশাক রফতানিতে সম্প্রতি চলতি অর্থবছরের উৎসে কর দশমিক ৬০ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ২৫ শতাংশ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। গত অর্থবছরে উৎসে কর ছিল দশমিক ৭০ শতাংশ। মজুরি বৃদ্ধির অজুহাতে উৎসে কর তিন ভাগের এক ভাগে নামিয়ে এনেছে মালিকপক্ষ।
গত ২৫ নভেম্বর পোশাক শিল্পের জন্য নতুন মজুরিকাঠামোর প্রজ্ঞাপন জারি করে শ্রম মন্ত্রণালয়। ডিসেম্বরে নতুন মজুরিকাঠামো কার্যকর হয়। চলতি মাস থেকে নতুন কাঠামো মেনে বাড়তি মজুরি পেতে শুরু করেন শ্রমিকেরা। সাম্প্রতিক সময়ে কয়েক দিন ধরে চলা শ্রমিক আন্দোলন ও তাদের কর্মসূচি নিয়ে ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজতে ব্যস্ত ছিল একটি শ্রেণী; কিন্তু আন্দোলন কেন হচ্ছে, তার কারণ অনুসন্ধানে রাষ্ট্র অথবা মালিকপক্ষের তেমন কোনো গরজ ছিল না। যতক্ষণ না হতাহতের ঘটনা ঘটে; মালিকপক্ষের একপক্ষীয় চিন্তাই এ জন্য দায়ী। নিজেদের সুবিধাচিন্তায় তাদের হৃদয় আচ্ছন্ন। ঘোর তখনই কাটে যখন আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। অবশেষে সাম্প্রতিক আন্দোলনে এক শ্রমিক নিহত ও বহু আহত হওয়ার পর সরকারের টনক নড়ে। মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠকে বসেন দুই মন্ত্রী।
মজুরি নিয়ে যে শ্রমিক বিক্ষোভ, তাতে জানমালের ক্ষতির পাশাপাশি বিপুল মানুষ দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন। সাম্প্রতিক আন্দোলনে সাভারে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে সুমন মিয়া নামে এক শ্রমিক নিহত হন। সুমনের এ অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর পর শ্রমিক-মালিক প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠকে নতুন বাণিজ্যমন্ত্রী ও শ্রম প্রতিমন্ত্রী মজুরি বোর্ডের অসঙ্গতি ও ত্রুটিবিচ্যুতি দূর করার কথা বলেন। মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কমিটিও করে দেন তারা। টানা শ্রমিক বিক্ষোভের মুখে সর্বশেষ মজুরিকাঠামোর ছয়টি গ্রেড সংশোধন করে মোট বেতন ১৫ টাকা থেকে ৭৮৬ টাকা বাড়িয়েছে সরকার। ১৩ জানুয়ারি শ্রম মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে মালিক-শ্রমিক ও প্রশাসনের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত ত্রিপক্ষীয় কমিটির বৈঠক শেষে এ সিদ্ধান্ত হয়।
এ সংশোধনীর পর অনেক শ্রমিক প্রশ্ন তুলেছেনÑ সংশোধিত মজুরিতে তাদের যে বেতন বাড়ানো হয়েছে, সেই অঙ্কটি দেখে কি মজুরি-বৈষম্য নিরসনের কোনো লক্ষণ প্রতীয়মান হয়? এটাকে কেউ যদি শুভঙ্কের ফাঁকি মনে করেনÑ তা কি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়া যাবে? যেকোনো শুভবুদ্ধির মানুষ বলতে বাধ্য হবেন, এই যে মজুরি সংশোধন; তা শ্রমিকদের সাথে আরো একটা রসিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
আন্দোলনকারী শ্রমিকদের অভিযোগ ছিল, ২০১৩ সালে যখন সর্বশেষ বেতন বাড়ানো হয়, তখন তৃতীয় গ্রেডে মূল বেতন ছিল চার হাজার ৭৫ টাকা। বছরে ৫ শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধির পর ওই গ্রেডের একজন শ্রমিকের মূল বেতন পাঁচ হাজার ২০৪ টাকা হওয়ার কথা ছিল। আর নতুন কাঠামোতে তৃতীয় গ্রেডের মূল বেতন ঘোষণা করা হয় পাঁচ হাজার ১৬০ টাকা। তাদের এ হিসাবে তৃতীয় গ্রেডে বেতন কমেছে ৪৪ টাকা; একইভাবে চতুর্থ গ্রেডের মূল বেতন ৭৯ টাকা এবং পঞ্চম গ্রেডে ১৬৪ টাকা বাড়ানো হয়। অথচ সপ্তম গ্রেডে নতুন শ্রমিকদের বেতন বাড়ে দুই হাজার ৭০০ টাকা।
দেশে তৈরী পোশাক খাতের শ্রমিকেরা অন্য অনেক দেশের তুলনায় কম মজুরি পান। এ শিল্পের মালিকদের বুঝতে হবে, শ্রমিক ঠকিয়ে কখনো শিল্পের বিকাশ সম্ভব নয়। এ সহজ কথাটি তারা যত তাড়াতাড়ি অনুধাবন করবেন, তত দ্রুত শ্রমিক অসন্তোষের অবসান হবে। শ্রমিকের যাপিত জীবন স্বাভাবিক না হলে কাক্সিক্ষত উৎপাদন ব্যাহত হয়। মুনাফাও আশানুরূপ হবে না। উদ্যোক্তাদের মাথায় রাখতে হবে, কোনো শিল্প তখনই টেকসই হয়, যখন মালিক ও শ্রমিকের সম্পর্ক পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে মজবুত ভিতে দাঁড়িয়ে শক্ত পাটাতন পায়। অন্য দিকে শ্রমিকদেরও এটা বিবেচনায় নিতে হবেÑ তাদের হঠকারী কর্মকাণ্ডে উৎপাদন ব্যাহত হলে মালিক লোকসান গুনবেন। আর গাঁটের পয়সা খরচ করে কেউ লোকসানের ঘানি টেনে ব্যবসায় টিকিয়ে রাখবেন, কারখানা গুটিয়ে নেবেন নাÑ এমন ভাবনা নেহাত বোকামি। এতে আখেরে দুই পক্ষেরই ক্ষতি। শিল্পের উৎকর্ষ সাধনে মালিক-শ্রমিক দু’টি পক্ষ হলেও সম্পর্কটি সমান্তরাল। মূলত মালিক-শ্রমিক মৈত্রীতে শিল্পে আসে কাক্সিক্ষত সাফল্য। এ বাস্তবতা সবাইকে মেনে নিতে হবে। তা হলেই মালিক-শ্রমিকের সম্পর্কে আসবে ভারসাম্য। উভয়ের অবস্থান দাঁড়াবে সঙ্গতিতে।
তৈরী পোশাক শিল্পে অস্থিরতা বিরাজ করলে যেসব দেশ আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী তারা লাভবান হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে জাতীয় অর্থনীতির, যা দেশের অর্থনীতির অগ্রগতিতে বাধার প্রাচীর হয়ে দেখা দেবে। দুইপক্ষকেই চলতে হবে সমঝে। থাকতে হবে মাত্রাজ্ঞান। জানতে হবে কোথায় থামতে হবে। থামার কৌশলও প্রয়োগ করতে হবে মুন্সিয়ানার সাথে।
এমনিতেই রানা প্লাজা ধসে সহস্রাধিক শ্রমিক নিহত ও তাজরীন ফ্যাশনে বহু শ্রমিক পুড়ে অঙ্গার হওয়ার ঘটনায় আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্প খাত পড়েছিল সঙ্কটে। সেই সঙ্কট উত্তরণে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। ভাবমর্যাদা উদ্ধারে এখনো চলছে প্রাণান্তকর চেষ্টা। এ খাতের সাফল্য ধরে রাখতে মালিক-শ্রমিক পরস্পরকে হাত ধরাধরি করে চলতে হবে। তা হলে রক্ষা হবে উভয়ের স্বার্থ। হ
camirhamza@yahoo.com

 


আরো সংবাদ



premium cement