২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানল

জলবায়ু পরিবর্তনের আলোকে বিশ্লেষণ

-

জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্বব্যাপী চলছে পরিবেশ বিপর্যয়। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার দাবানলে যে বিপর্যয় হয়ে গেল তা বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে বেশ সাযুজ্য রয়েছে। গত ৬ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া দাবানলটি ক্যাম্প ফায়ার থেকে শুরু হলেও এর সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের বেশ সম্পর্ক রয়েছে।
ক্যালিফোর্নিয়ার ওই দাবানলে এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ৮০ জন। এখনো নিখোঁজ রয়েছে প্রায় এক হাজার। দাবানলে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় দেড় লাখ একর জায়গা। ধ্বংস হয়েছে ১০ হাজারের বেশি বাড়িঘর। একই সাথে পুড়ে গেছে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা। প্যারাডাইস শহরে আগুন এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে যে লোকজন যানবাহন পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেনি।
ক্যালিফোর্নিয়াতে নভেম্বর মাসে বৃষ্টির পরিবর্তে দাবানল আগামী দিনের জলবায়ু পরিবর্তনের একটি সতর্কবাণী। ২০১৭-১৮ সালে আমেরিকায় স্মরণকালের মধ্যে ভয়ঙ্কর হ্যারিকেনের ঝাঁপটা এবং এই বছর আমরা দেখেছি ওমান থেকে কুইবেক পর্যন্ত গ্রীষ্মকালীন প্রচণ্ড তাপমাত্রা। অত্যধিক খরায় ইউরোপের শস্য বিনষ্ট হওয়ার মতো অনেক ঘটনা ঘটেছে। আগামীতে এ ধরনের প্রভাব আরো প্রকট আকার ধারণ করতে পারে এবং পুরো পৃথিবীর কোনো অঞ্চলই এর থেকে নিষ্কৃতি পাবে না। ইতোমধ্যে লক্ষ করেছি যে, জলবায়ু পরিবর্তন শুধু উন্নয়নশীল দেশই নয় উন্নত বিশ্বকেও সমানভাবে আঘাত করছে।
ধ্বংস হয়ে যাওয়া ক্যালিফোর্নিয়ার প্যারাডাইস শহরে গিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ দেখে দুঃখ পেয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প; কিন্তু এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন নয়, দুর্বল বন ব্যবস্থাপনা’ এ জন্য দায়ী। যদিও পরে কোনো এক সাক্ষাৎকারে জলবায়ু পরিবর্তনের সামান্য প্রভাব আছে বলে তিনি স্বীকার করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দুর্বল ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করলেও বিশেষজ্ঞরা দাবানলের প্রধান কারণ হিসেবে আবহাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তন ও জনসংখ্যার আচরণকেই এ জন্য দায়ী করেছেন।
ক্যাম্প ফায়ার দাবানল ছাড়াও ক্যালিফোর্নিয়ার দমকল কর্মীদের লস অ্যাঞ্জেলেসের নিকটবর্তী উওলসি ফায়ারসহ আরো কয়েকটি দাবানলের মোকাবেলা করতে হয়েছে। উওলসি দাবানল মোট এক লাখ একর এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং এখানে প্রাণ হারিয়েছে তিনজন।
ইতোমধ্যে ক্যালিফোর্নিয়ার দাবানলের ফলে হাজার হাজার মাইল জুড়ে অনেকে নানা স্বাস্থ্য জটিলতায় ভুগছেন। শ্বাসকষ্টে ভুগছেন বয়োজ্যেষ্ঠ ও শিশুরা। বিমান চলাচল বিঘিœত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে ‘ক্লাইমেট সিস্টেমে’। গাছ পুড়ে যাওয়ায় আরো অধিক পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হচ্ছে (যেমনটা হয়ে থাকে কয়লা পোড়ানোর ক্ষেত্রে)। ফলে ক্যালিফোর্নিয়া ফিউয়েল এফিসিয়েন্সি টেকনোলজি উন্নয়ন করে গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমনে যে উন্নতি করেছিল তা কিছুটা হলেও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
আমার আজকের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, এই বিভীষিকাময় দাবানলের সম্ভাব্য কারণগুলো উদঘাটন করা এবং ভবিষ্যতের জন্য জনসচতেনতা তৈরি করা। প্রকৃতপক্ষে এই দাবানলের কারণ একটি নয়। এর কারণগুলো বুঝতে হলে বনাঞ্চলের দাবাগ্নির বিষয়টি ব্যাখ্যার জন্য বৈশ্বিক থেকে আঞ্চলিক এবং স্থানীয় কারণগুলোর প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করতে হবে।
বৈশ্বিক : প্রথমেই জেনে নিই বৈশ্বিক কারণগুলো কী কী। মানুষের কর্মকাণ্ডের ফলে বায়ুমণ্ডলের চক্রে পরিবর্তন হচ্ছে। প্রায় ৪০ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড বেড়ে গেছে ফসিল ফিউয়েল (মিথেন) জ্বালানোর কারণে এবং এর অর্ধেকই বেড়েছে ১৯৮৫ সালের পরে। অন্যান্য গ্যাস যেমন মিথেন নাইট্রাস অক্সাইডও বেড়েছে। এগুলো হিট ট্র্যাপিং গ্যাস। এই গ্যাসগুলো আমাদের ভূমি, সাগর ও বায়ুমণ্ডলকে উষ্ণ করে তুলছে। ফলে বর্তমান বৈশ্বিক তাপমাত্রা শিল্পযুগের চেয়ে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। ২১০০ সাল নাগাদ (আইপিসিসি এর ৫’র মতে) ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার পরিকল্পনা চলছে। একে আমরা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন (গ্লোবাল ওয়ার্মিং) বলি। এটা সার্বিকভাবে অবশ্যই একটা কারণ। তবে ক্যালিফোর্নিয়ায় এবারের দাবানলের ক্ষেত্রে এটাকে প্রত্যক্ষ কারণ না বলে পরোক্ষ কারণ বলা যেতে পারে।
আঞ্চলিক : ক্যালিফোর্নিয়ায় নভেম্বর মাসটি শুরু হয় বৃষ্টি দিয়ে। এবার শুরু হয়েছে দাবানল দিয়ে। ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসেও এমনটি হয়েছিল। ১৯৭০ সালের পর থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানল বেড়েছে পাঁচ গুণ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক কারণ হলো, ক্যালিফোর্নিয়া কয়েক বছর ধরেই খরায় আক্রান্ত। ইউএস ড্রট (যুক্তরাষ্ট্রের খরা) মনিটরের মতে, এ মুহূর্তে ক্যালিফোর্নিয়া দীর্ঘমেয়াদি খরায় আক্রান্ত। এটা শুরু হয়েছে ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে। বর্তমানে দুই-তৃতীয়াংশ ক্যালিফোর্নিয়া অস্বাভাবিকভাবে শুকনো। গত সাত মাস ছিল চতুর্থ উষ্ণতম সময় এবং ২০১৮ সালের গ্রীষ্মকাল ছিল দ্বিতীয়তম উষ্ণ সময়। অত্যধিক খরা থাকাও ছিল ক্যালিফোর্নিয়াতে এবারের দাবানলের একটা অন্যতম কারণ। এটাকে প্রত্যক্ষ কারণ বলা যেতে পারে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, ক্যালিফোর্নিয়ায় এই দীর্ঘমেয়াদি শুষ্ক আবহাওয়ার জন্য বৈশ্বিক উষ্ণায়ন দায়ী।
স্থানীয় : প্রকৃতপক্ষে স্থানীয় বায়ুপ্রবাহের কারণে দাবানলটি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল। এটা ‘সান্তা আনা উইন্ডস’ নামে পরিচিত। এই বায়ুপ্রবাহ ক্যালিফোর্নিয়ায় পাহাড়ের ওপরের দিকে তৈরি হয় এবং দক্ষিণে নিচের দিকে ধাবিত হয়। এই বায়ুপ্রবাহ অত্যন্ত শুষ্ক ও গরম। এটি অত্যন্ত শক্তিশালীও বটে। ঘণ্টায় ৪০ থেকে ৬০ কিলোমিটার বেগে প্রবাহিত হয়। ক্যালিফোর্নিয়ায় এটাকে ডেভিল উইন্ডও বলা হয়। এটা অবশ্য সব সময় হয় না। ১৯৮২ সালে একবার ৬০ কিলোমিটার বেগে প্রবাহিত হয়েছিল। ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানলের এটা প্রত্যক্ষ কারণ হলেও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন যে কাজ করেনি তা আমি বলছি না। দেখা যাচ্ছে ওপরের তিনটি কারণই দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার বনাঞ্চলকে এবার আগুন লাগার ক্ষেত্রে সরাসরি না হলেও সহায়ক (ফায়ার সেন্সেটিভ ইকোসিস্টেম) হিসেবে ভূমিকা রেখেছিল। আর তিনটি কারণেই কোনো-না-কোনোভাবে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সম্পৃক্ত।
বন ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা : শেষ কারণটি হচ্ছে বন ব্যবস্থাপনায় কিছুটা দুর্বলতা। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে দীর্ঘকাল খরা থাকার কারণে আগে থেকে ক্যালিফোর্নিয়ার বনে প্রায় ১২৯ মিলিয়ন মৃত গাছ ছিল। সঠিক সময় এই মৃত গাছগুলো পরিষ্কার না করার কারণে আগুনের ফুয়েল হিসেবে কাজ করেছে। ফলে অতি অল্প সময়ে আগুন ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে ও বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।
আমি শেষ করতে চাই ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর জেরি ব্রাউনের বক্তব্য দিয়ে। তিনি বলেন, ‘ক্যালিফোর্নিয়ার দাবানলের জন্য ব্যবস্থাপনায় হয়তো কিছুটা দুর্বলতা ছিল, কিন্তু যারা এই দাবানলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি অস্বীকার করছেন তারা প্রকৃতপক্ষে এ সমস্যাকে আরো ভয়ঙ্কর করে তুলছেন।’ হ
ড. মো: রাশেদ চৌধুরী আমেরিকার হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ফ্যাকাল্টি এবং জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর মেরিন অ্যান্ড অ্যাটমসফেরিক রিসার্চের প্যাসিফিক ‘ইএনএসও’ অ্যাপ্লিকেশন ক্লাইমেট সেন্টারের প্রধান বিজ্ঞানী


আরো সংবাদ



premium cement