২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আফগান শান্তি আলোচনা ও ইতিহাসের প্রতিশোধ

-

গত ৯ নভেম্বর মস্কোয় অনুষ্ঠিত হলো আফগান শান্তি আলোচনা। এই প্রথমবারের মতো একটি আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনে অংশ নিলো আফগানিস্তানের তালেবান। এই সম্মেলন উদ্বোধন করেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। মধ্যস্থতাকারী রাশিয়ার আশা, এই যৌথ প্রচেষ্টা আফগানিস্তানের ইতিহাসে ‘নতুন পৃষ্ঠা খুলে দেবে’। আলোচনার শুরুতে এই আশা ব্যক্ত করেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, আফগান নেতা ও তালেবানের উপস্থিতি সরাসরি আলোচনার জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আপনাদের গঠনমূলক ও আন্তরিক আলোচনার মধ্য দিয়ে আফগান জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটুক। বৈঠকের উদ্দেশ্য তুলে ধরে বিবদমান পক্ষগুলোকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সঙ্ঘাতমুক্ত আফগানিস্তান গঠনের আহ্বান জানিয়ে সের্গেই ল্যাভরভ বলেন, ‘সন্ত্রাস উচ্ছেদে প্রত্যেকের উচিত আফগানিস্তানকে সহায়তা করা। আফগানিস্তান ও প্রতিবেশীদের ভোগান্তি বাড়াতে পারে, এমন কোনো কাজ করা কারো উচিত হবে না। সঙ্কট সমাধানের একমাত্র পথ হতে পারেÑ সবপক্ষের একতার ভিত্তিতে রাজনৈতিক পন্থায় এগিয়ে চলা।’
দীর্ঘদিন ধরে আফগানিস্তানে যুদ্ধরত পক্ষগুলোর সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসে রাশিয়া। এর আরেকটা তাৎপর্যপূর্ণ দিক হচ্ছে আঞ্চলিক শক্তিগুলোও এতে সম্পৃক্ত হয়েছে। রাশিয়াই এই যোগাযোগ প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দিচ্ছিল এবং ধীরে ধীরে এর আওতা সম্প্রসারিত করেছে। শেষ পর্যন্ত ১২টি দেশ এতে সম্পৃক্ত হয়। বিভিন্ন স্তরে সযতœ প্রয়াসে গড়ে তোলা আপস-মীমাংসার মাধ্যমে যুদ্ধরত পক্ষগুলোকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে রাশিয়া।
আফগান প্রশাসনের প্রতিনিধি ছাড়াও প্রভাবশালী আঞ্চলিক শক্তি পাকিস্তান, ভারত ও চীনও এতে অংশ নেয়। বৈঠক পর্যবেক্ষণের জন্য মস্কোতে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস একজন প্রতিনিধি পাঠায়। মস্কো জানিয়েছিল, বৈঠকে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ইরান, চীন, পাকিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার সাবেক পাঁচ সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বৈঠকে নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ না থাকায় আফগান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এতে অংশ নেয়নি। তবে আফগানিস্তানের উচ্চ শান্তি কাউন্সিলের কয়েকজন সদস্য এতে যোগ দিয়েছিলেন। হাই পিস কাউন্সিলের মুখপাত্র সৈয়দ ইহসান তাহেরি বলেন, তাদের সংস্থার চারজন সদস্য আলোচনায় অংশ নিয়ে আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করে আসছেন, বৈঠকে পিস কাউন্সিলের সদস্যরা সরকারের প্রতিনিধিত্ব করছেন না। আফগান সরকারের সাথে সব ধরনের আলোচনা নাকচ করে দেয়ার পরও শান্তি পরিষদের প্রতিনিধি দলের প্রধান দীন মোহাম্মদ আলোচনায় বসার আহ্বান জানান তালেবানকে। তিনি বলেন, ‘কোনো শর্ত ছাড়াই তালেবানের সাথে আলোচনায় আমরা প্রস্তুত।’ বৈঠকের সময় ও স্থান নির্ধারণের জন্য তাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
আফগান সরকার আশা প্রকাশ করে, এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে কাবুল ও তালেবানের মধ্যে সরাসরি আলোচনার পথ খুলে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র এর আগে রাশিয়ার শুরু করা এই প্রক্রিয়াকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তারা তালেবানের সাথে সরাসরি আলোচনা চালাচ্ছিল। সেই যুক্তরাষ্ট্রও এ সম্মেলনে দূতাবাসের একজন কর্মকর্তাকে পাঠালো। অন্য দিকে, তালেবানের সাথে আলোচনায় বসার প্রশ্নে ভারতের অবস্থানেও পরিবর্তন ঘটেছে। আগে তারা তালেবানের সাথে এরকম আলোচনার বিরোধী ছিল। কিন্তু এই আলোচনায় ভারত থেকে একটি ‘অনানুষ্ঠানিক’ প্রতিনিধিদল গেছে। তাতে ভারতের দু’জন সাবেক কূটনীতিকও ছিলেন।
তালেবানের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ বলেন, সংগঠনের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিদল পাঠানো হয়েছে। তারা কাবুল প্রশাসনের সাথে ‘কোনো ধরনের সমঝোতা’ করবেন না। এই সম্মেলনের উদ্দেশ্যÑ কোনো দলের সাথে আলোচনা করা নয়, মূলত আফগানিস্তানের সমস্যা সমাধানে শান্তিপূর্ণ উপায় খোঁজা। এর আগে গত সেপ্টেম্বরে মস্কো এই ‘শান্তি আলোচনা’ করতে চেয়েছিল। কিন্তু আফগান সরকার রাজি না হওয়ায় ওই প্রচেষ্টা সফল হয়নি।
আফগানিস্তানে একজন মার্কিন সেনার উপস্থিতি থাকলেও সরকারের সাথে কোনো আলোচনায় বসবে না বলে মস্কো শান্তি আলোচনায় জানিয়ে দেন তালেবান নেতারা। তালেবান নেতা শের মোহাম্মদ আব্বাস স্তানিকজাই বলেন, বহিরাক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করাই তালেবানের প্রধান লক্ষ্য। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পুতুল সরকারের সাথে আমরা কোনো আলোচনা করবে না। বিদেশী সেনা প্রত্যাহারে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনা চান বলেও জানান তিনি। তালেবান নেতা বলেন, ‘আফগানিস্তানে একজন মার্কিন সেনার উপস্থিতিও সহ্য করব না আমরা। মার্কিন জোটের হামলা অবসান ঘটানোই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পেরেছে আলোচনার মাধ্যমেই আফগান সঙ্কটের সমাধান করতে হবে। তাদের সাথে আলোচনা যদিও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। পারস্পরিক আস্থা সৃষ্টির পর্যায়ে রয়েছে, বলা যায়।’ তালেবানের এমন মন্তব্যের পর যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, তালেবানকে কখনোই ক্ষমতায় ফিরতে দেবে না ওয়াশিংটন।
তবে মস্কোয় তালেবানের সাথে এক টেবিলে আলোচনায় বসে যুক্তরাষ্ট্র যেন ইতিহাসের সবচেয়ে অবমাননাকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হলো। কেননা একই টেবিলে বসার মাধ্যমে তালেবানকে প্রকারান্তরে আফগানিস্তানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি বলে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। একই টেবিলে আলোচনায় তাদের সাথেই বসা হয়, যাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আগেই মেনে নেয়া হয়। সুতরাং আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়মতান্ত্রিক পরাজয় স্বীকার করা বলা যেতে পারে এটিকে। কাবুলের আশরাফ গনির সরকার এই আলোচনায় একেবারেই গুরুত্বহীন হয়ে গেল। আর ভারত অনেকটা বাধ্য হয়েই এতে অংশ নিয়েছে। এই আলোচনার সময়ের পাশাপাশি স্থানও অত্যন্ত তাৎপর্যবহ। অর্থাৎ সেই সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী মস্কো, আফগানিস্তানের বর্তমান প্রতিরোধ শক্তি তালেবানের গুরু কমান্ডারদের হামলায় পরাজয়ের জের ধরে যে সোভিয়েত ইউনিয়ন টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘকাল ধরে তাদের আন্তর্জাতিক মিত্রদের দ্বারা প্রচারণা চালিয়ে আসছে যে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ যদি আফগান মুজাহিদদের পৃষ্ঠপোষকতা না করত, তা হলে তাদের পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নকে নাস্তানাবুদ করা সম্ভব হতো না। কিন্তু এখন তো প্রশ্ন তোলা যায়, ন্যাটোজোটের মাধ্যমে পুরো পশ্চিমা শক্তিবলয় যখন সেই আফগানদের বিরুদ্ধে লড়তে নেমেছে, তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে কারা?
নাইন ইলেভেনের ঘটনার প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটোর আগ্রাসন শুরু হলে অনেকেই প্রস্তুত ছিলেন এ কথা মেনে নিতে যে, আফগানিস্তান এবার সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের মুখে নিজেদের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারবে না। কেননা যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনসহ কয়েকটি শক্তি বছরের পর বছর প্রস্তুতির পর এই হামলা শুরু করেছিল। আফগানিস্তানের ভূপ্রকৃতির কথা মনে রেখে ইউরোপ ও আমেরিকায় দীর্ঘ প্রশিক্ষণ ও মহড়া দেয়া হয়। পরাশক্তিগুলোর এখানে পরাজয়ের কারণগুলো চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়। ব্রিটেনের দায়িত্ব ছিল আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চল সামাল দেয়া। কেননা অতীতে এখান থেকেই তাদের পরাজিত হয়ে ফিরে যেতে হয়েছিল। তবে তারা এলাকাটির কৌশলগত পরিস্থিতির ব্যাপারে ভালোভাবে সচেতন ছিল। তাই প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানকে ধমকিয়ে তাদের আকাশপথ ও গোয়েন্দা বিভাগের সহায়তা নেয়া হলো। কিন্তু এতসব প্রস্তুতি সত্ত্বেও এখন তাদের তালেবানের কাছে অনুরোধ জানাতে হচ্ছে আফগানিস্তানে কিছু সৈন্য রাখতে দেয়ার জন্য, যাতে চীনসহ এ অঞ্চলে প্রভাব বজায় রাখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো ও ইসরাইলের ধারণা ছিল, তালেবানকে পরাজিত করে আফগানিস্তানে একটি নামমাত্র দেশীয় বাহিনী গঠন করে দেয়া হবে এবং তাদের জন্য থাকবে ভারতের সামরিক ছত্রছায়া। তেমনি যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটোর একটি বাহিনী এখানে সব সময় উপস্থিত থাকবে। ফলে এক দিকে চীনকে সামাল দেয়া যাবে, অন্য দিকে পরমাণু শক্তিধর পাকিস্তানকে চাপে রাখা যাবে। পাকিস্তান তখন চীনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতির ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হবে। কখনো অন্যথায় করতে চাইলে ভারতের মাধ্যমে তা সামাল দেয়া যাবে এবং পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী মধ্যপ্রাচ্যে কোনো ভূমিকা পালনের ইচ্ছা বাদ দেবে এবং নিজেদের সীমান্তের মধ্যে গণ্ডিবদ্ধ হয়ে থাকবে। এক দিকে ভারত, অন্য দিকে আফগান সীমান্ত নিয়েই পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে ব্যস্ত থাকতে হবে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো পাকিস্তানের সামরিক সহায়তা পাবে না এবং ইসরাইলের সামনে হয়ে থাকবে অসহায়। এ দিকে, গোয়াদর বন্দর পর্যন্ত চীনের পৌঁছানোর স্বপ্ন থেকে যাবে স্বপ্নই। আর আফ্রিকায় বিনিয়োগের কোনো সুফল পাবে না চীন। অন্য দিকে, রাশিয়া ককেশাসের দিক থেকে সিরিয়া পর্যন্ত নিজের স্বার্থ নিরাপদ করলেও আফগানিস্তানের এই পরিস্থিতির কারণে পিছু হটতে বাধ্য হবে এবং ভবিষ্যতে ইসরাইল যখন মুসলিম ‘উগ্র’পন্থীদের দমনের বাহানায় মধ্যপ্রাচ্যে নিজের সীমানা সম্প্রসারিত করতে থাকবে, তখন রাশিয়ার পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা তার থাকবে না। এ ছাড়া, চীনের জ¦ালানি চাহিদার শতকরা ৭০ ভাগ মেটানো উপসাগরীয় দেশগুলোর তেলসম্পদ চলে যাবে ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে; ফলে চীন বেকায়দায় পড়বে। এ দিকে, মধ্যপ্রাচ্যে আস্তে আস্তে প্রভাব বিস্তারকারী তুরস্কের পক্ষে শুধু নিজের সীমান্তের মধ্যে সীমিত হয়ে থাকা নয়, ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক আগের মতোই স্বাভাবিক করা ছাড়াও উপায় থাকবে না। অথবা কোনো ‘সামরিক বিপ্লবের মাধ্যমে’ সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হবে। এই পরিকল্পনা নিয়েই আফগানিস্তানে এসেছিল মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর আড়ালে জায়নবাদীদের সামরিক জোট।
কিন্তু পৃথিবীতে বসে অপশক্তি একটি পরিকল্পনা করে। আর আসমানে মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে আরেকটি পরিকল্পনা তৈরি হয়। সেটিই বাস্তবায়িত হয় যেটি আসমানে তৈরি হয়। সবাই জানে, গুয়ানতানামো কারাগার থেকে তালেবানের কয়েকজন কমান্ডারকে মুক্তি দিয়ে তাদের কাতারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। প্রথম বছর তাদের ওপর ভ্রমণনিষেধাজ্ঞা ছিল। পরে তারাই হলো কাতারের রাজধানী দোহায় তালেবানের যোগাযোগ দফতরের প্রতিনিধি। আসলে এ সবকিছু হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছায়। নইলে কাতারের মতো একটি দেশের নিজের পক্ষ থেকে এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার সাহস থাকতে পারে না। ২০০৫ সালের পর তালেবানকে যখন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সামরিক উপায়ে পরাজিত করা অসম্ভব মনে হতে লাগল, তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছে তৃতীয় কোনো দেশে তালেবানের একটি যোগাযোগ কেন্দ্র থাকুক, যেখানে বসে তালেবানের সাথে দরকষাকষি করা যায়। সরাসরি আফগানিস্তানে এটি সম্ভব ছিল না। কারজাই সরকার এ ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছিল এ জন্য যে, অন্যরা যেন মনে করতে না পারে যে, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি তালেবানের সাথে আলোচনা করতে চাইছে। যা হোক, যুক্তরাষ্ট্র এই উঁচু নাক বাঁচানোর ঘোরে আচ্ছন্ন থাকায় আফগানিস্তানে তালেবানের হাতে শুধু মার খেতে থাকেনি, বরং সারা বিশ^ এই খেলা থেকে বেখবর রইল। আফগানিস্তানের এই পরিস্থিতিই যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ইরাক থেকে দ্রুত সেনাপ্রত্যাহারে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। এই ত্বরিত প্রত্যাহারের ফলে ইরাকের শূন্য ময়দান পূরণ করল ইরান। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে কয়েকবার গোপনে ও প্রকাশ্যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আলোচনার। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র নিজের দুর্বলতা প্রকাশিত হওয়ার ভয়ে এসব উদ্যোগ বানচাল করে দেয়। অন্য দিকে, তালেবানের অবস্থান সবসময় এই ছিল যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনা হতে পারে কেবল তখন, যখন আফগানিস্তান থেকে সবশেষ বিদেশী সৈন্য চলে যাবে। আসলে তালেবান তো চায় মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তান ছেড়ে যাক। কিন্তু উপায়ের ব্যাপারে কোনো দায়িত্ব নিতে রাজি নয় তালেবান। তারা মস্কোর এ সর্বশেষ আলোচনায়ও মার্কিন কর্তৃপক্ষের ওপর আস্থা রাখতে রাজি হননি। বরং তারা আন্তর্জাতিক নিশ্চয়তার কথা বলেছেন। এটাও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অসম্মানের বিষয়। তাই এতে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। অতীতে তালেবানের সাথে আলোচনায় পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্র দূরে রাখতে চেয়েছে। তাদের ধারণা ছিল তালেবানের ব্যাপারে পাকিস্তানকে শুধু ডিকটেশন দিলেই চলবে। তাই যুক্তরাষ্ট্র তালেবানের সাথে আলোচনার ইচ্ছা পূরণ করতে চেয়েছে উপসাগরীয় মিত্র দেশগুলোর মাধ্যমে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আফগানিস্তানের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে গিয়ে খুব সাবধানতা অবলম্বন করেছে এবং নির্দিষ্ট সীমার বাইরে হস্তক্ষেপ করতে চায়নি।
এ ব্যাপারে কাতারের মাধ্যমে প্রথম চেষ্টা করা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ইঙ্গিতে তালেবান ও কারজাই সরকারের মধ্যে সমঝোতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকে কাতার। তালেবানের তখনকার রাজনৈতিক প্রধান তৈয়েব আগা কাতার সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে দেখা করেছিলেন বলে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় খবর বের হয়েছিল। পরে জানা গিয়েছিল যে, তিনি জার্মানিতে এই আলোচনার অগ্রগতির চেষ্টা চালাচ্ছেন, যা ‘বন-২ সম্মেলনে’ রূপ নেবে। আরব সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়, তখন দুবাইয়ে একটি গোপনীয় অথচ গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছিল। এই বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন কাতারের রাজকীয় সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এবং কারজাই সরকারের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল। আফগান প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন পাকিস্তানে আফগান রাষ্ট্রদূত ওমর দাউদজাই। এই বৈঠকে তালেবানের সেসব মৌলিক শর্ত ও দাবি নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়, যেগুলোর মাধ্যমে উভয় পক্ষের আলোচনার পরিবেশ তৈরি করা যায়। দাবিগুলোর শীর্ষে ছিল, আফগান কারাগারে বন্দী তালেবান নেতাদের অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি। অন্য দিকে, আরব সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়, আরব আমিরাত সরকার বৈঠকের কথা জানতে পেরে কাতারের কাছে প্রতিবাদ জানায় যে, তাদের দেশকে এ ধরনের গোপন বৈঠকের জন্য যেন ব্যবহার না করা হয়, বরং কাতার তার নিজ ভূখণ্ডই যেন ব্যবহার করে। এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনায় কোনো প্রকার ভূমিকা পালনে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিল আরব আমিরাত।
আগেই বলা হয়েছে, আফগানিস্তান ত্যাগের আগে যুক্তরাষ্ট্র চাইছিল, তাদের পরাজয়ের ভাবখানা যেন কিছুতেই প্রকাশ না পায়। এ জন্য তারা আফগানিস্তানকে তিন ভাগ করার পরিকল্পনা করেছিল। উত্তর ভাগটি ন্যস্ত করার কথা ছিল উত্তর জোটের কাছে। কাবুলসহ মধ্য আফগানিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শহর যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছিল। সেখানে কয়েক হাজার মার্কিন সৈন্যের জন্য একটি ঘাঁটি রাখার কথা ছিল, যেন প্রয়োজনে বিমানের সাহায্যে তাদের সহায়তা পৌঁছানো যায়। আর পাকিস্তান সংলগ্ন দক্ষিণাঞ্চলে আফগানিস্তানের ন্যাশনাল আর্মিকে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দেয়ার পরিকল্পনা ছিল, যাতে পাকিস্তান থেকে রসদ যাওয়ার পথ নিরাপদ থাকে।
কিন্তু এসব পরিকল্পনা ছিল অবাস্তব। কেননা এই পরিস্থিতিতে তালেবান আরো খোলাখুলি লড়াই শুরু করে আরো অনেক এলাকা দখলে নিতো। তখন আফগান ন্যাশনাল আর্মি ও উত্তর জোটের সব সৈন্য ছিল পাখতুন ছাড়া অন্যান্য গোষ্ঠী থেকে নেয়া। আর তালেবানের দখলে ছিল আফগানিস্তানের প্রায় শতকরা ৭০ ভাগ এলাকা। অতএব, আফগান ন্যাশনাল আর্মির তখন কী দুর্গতি হতো, তা সহজেই অনুমান করা যায়। বর্তমান পরিস্থিতি হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের আগেই ইঙ্গ-মার্কিন শক্তির স্বার্থ হাসিলের নতুন হাতিয়ার কথিত ইসলামিক স্টেট আফগানিস্তান থেকে উধাও হয়ে গেছে। তাই যুক্তরাষ্ট্রকে নিজের স্বার্থেই যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি এখান থেকে সরে যাওয়ার উপায় খুঁজতে হচ্ছে। আর সে জন্যই চিরবৈরী রাশিয়ার রাজধানীতে তালেবানের সাথে আলোচনায় অংশ নিতে হলো তাদের। ইতিহাসের কী নির্মম প্রতিশোধ! ৩০ বছর আগে ওয়াশিংটনে বসে আফগানিস্তান থেকে তৎকালীন সোভিয়েত বাহিনী প্রত্যাহারের বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল। আর এখন মস্কোয় বসে আলোচনা করা হচ্ছে সেই আফগানিস্তান থেকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটোবাহিনী প্রত্যাহারের।


আরো সংবাদ



premium cement