২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নাম পরিবর্তন ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ

-

ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীনকাল থেকে নাম পরিবর্তনের ধারা চলে আসছে। বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন সময় স্থান ও নিদর্শনের নামকরণ ও নাম পরিবর্তন হয়ে থাকে। অবশ্য ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক কারণে নাম পরিবর্তন বেশি হয়েছে। ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্র ভারতে বেশ ক’বছর ধরে বিভিন্ন এলাকা ও স্থাপনার মুসলিম নাম পরিবর্তন করে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু নাম দেয়া হচ্ছে। হিন্দুত্ববাদী বিজেপির নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর যেন নাম পরিবর্তনের প্রতিযোগিতা চলছে। সম্প্রতি ভারতের উত্তর প্রদেশের (আল্লাহাবাদ) এলাহাবাদের নাম পরিবর্তন করে প্রয়াগরাজ রাখা হয়েছে। এলাহাবাদ উত্তর প্রদেশের একটি ঐতিহাসিক শহর। ১৬ শ’ শতাব্দীতে দিল্লির মুঘল সম্রাটরা এই শহরের নাম রেখেছিলেন এলাহাবাদ। প্রায় ১০ লাখ লোকের বাস এখানে। এখানেই জন্ম হয়েছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওয়াহের লাল নেহরুর। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অনেক বৈঠক ও সংগ্রামের স্মৃতি বহন করে চলেছে এই শহর। এভাবে বিভিন্ন এলাকার শত শত বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যও নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে।
ভারতে মুসলিম নাম ‘আহমেদাবাদ’ পরিবর্তন করে রাখা হচ্ছে অ্যামদাবাদ। আসাম রাজ্যের বাংলাভাষী বরাক উপত্যকা। বছর কয়েক আগে সেখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, নাম আসাম ইউনিভার্সিটি। শিলচর শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে যে স্থানে বিশ্ববিদ্যালয়টি অবস্থিত, তার নাম দরগাকুনা। হজরত শাহজালাল রহঃ-এর সঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার মধ্যে একজন দরবেশ ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে সেখানে বসতি স্থাপন করেছিলেন। এ কারণে, তার স্মৃতিধন্য এলাকাটির নাম হয়েছে দরগাকুনা। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এলাকার ডাকঘরটির নামও ছিল দরগাকুনা। প্রায় ২০-২২ বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এলাকাটির যখন গুরুত্ব বেড়ে গেল, তখন ডাকঘরটির নামও পাল্টে দেয়া হয়। ‘দরগাকুনা’ হয়ে গেল ‘দুর্গাকুনা’। এটা পরিষ্কার, কাজটি করা হয়েছে সরকারিভাবে। বিষয়টি প্রথম ধরা পড়ার পর স্থানীয় লোকজন যখন নাম-বিকৃতির প্রতিবাদ করলেন, বলা হলোÑ ‘ভুল হয়ে গেছে, সংশোধন করা হবে’। কিন্তু ভুল আর সংশোধন করা হয়নি এবং এ জন্য কোনো উদ্যোগই নেয়া হচ্ছে না।
কিছু দিন আগে উত্তর প্রদেশের ঐতিহ্যবাহী মুঘলসরাই রেলস্টেশনের নাম পাল্টে রাখা হয় হিন্দ্ত্বুবাদী দীনদয়ালের নামে। মুসলিম শাসক আওরোঙ্গজেব সড়কের নামও করা হয় পরিবর্তন। সম্প্রতি ভারতের রাজস্থানে আটটি গ্রামের মুসলিম নাম পরিবর্তন করে হিন্দুয়ানী নাম দেয়া হয়েছে। রাজস্থান রাজ্যের বারমের জেলার ‘মিয়া কা বড়া’ গ্রামের নাম বদল করে করা হয়েছে ‘মহেশপুর’। রাজ্যের অপর একটি গ্রামের ‘ইসমাইলপুর’ নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে ‘পিচানবা খুর্দ’। রাজ্য সরকারের উদ্যোগে এমন আরো ছয়টি গ্রামের নাম বদলানো হয়। এগুলোর বেশির ভাগই ছিল মুসলিম নাম। গত ১ জুন আটটি গ্রামের নাম পরিবর্তনের আবেদন মঞ্জুর করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। হরিয়ানা রাজ্যের মুসলিম অধ্যুষিত ছোট্ট গ্রাম মরোরার প্রবেশমুখে বিশাল একটি বিলবোর্ডে হিন্দি ও ইংরেজিতে লেখা ‘ট্রাম্প গ্রামে স্বাগতম’। এতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাসিমুখের ছবি দেখা যায়। উত্তর প্রদেশের আলিগড় জেলায় বিভিন্ন স্থানে ‘আলিগড়’ শব্দের স্থানে লেখা হচ্ছে ‘হরিগড়’।
মধ্যপ্রদেশের আজমগড়কে বলা হচ্ছে ‘আরইয়মগড়’। মির্যাপুরকে পরিবর্তন করে লেখা হচ্ছে ‘মিরজাপুর’। স্থানটিতে নাকি হিন্দুদের দেবী মিরজা বাস করতেন। লখনৌ শহরের প্রসিদ্ধ ‘বেগম হজরত মহল’ পার্ককে বলা হচ্ছে ‘উর্মিলা বাটিকা’। মুসলিম ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন নাম পরিবর্তনের কাজ অতীতেও হয়েছে সুচতুরভাবে। যেমনÑ পশ্চিমবঙ্গের মেদিনিপুর একসময় ছিল মদিনাপুর। পরে অত্যন্ত নামটিকে বিকৃত করা হয়েছে। হুসাইন সাগর নামক যে বিখ্যাত হ্রদটি সারা হায়দরাবাদ শহরের পানির প্রয়োজন মেটায়, তাকে এখন বলা হয় ‘বিনায়ক সাগর’। কারণ, কোনো এক হিন্দু নাকি বলেছেন, তাদের পৌরাণিক দেবতা গণেশের মূর্তিকে এ সাগরে ডুবিয়ে রাখা হয়েছিল। এমনকি ‘হায়দ্রাবাদ’ শহরটির নাম পরিবর্তন করে ‘ভাগ্যনগর’, ‘ফয়যাবাদকে’ সাকেট এবং লখনৌকে লক্ষণপুর নামকরণ ভারত সরকারের কাছে দাবি জানানো হচ্ছে। হয়তো কয়েক বছরের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে মুসলমানদের ঐতিহ্যবাহী কোনো স্মৃতি অবশিষ্ট থাকবে না। (সূত্র : ইন্ডিয়ান টাইমস, অ্যারাবিয়া জার্নাল, বিবিসি, বিভিন্ন দৈনিক)
আমাদের দেশে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে স্থাপনা বা এলাকার নামের যেমন পরিবর্তন হয়েছে, তেমনি মুসলিম বা ইসলামি নামও বিয়োজন হয়েছে। ভারতে নাম পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়া কখনো বাংলাদেশে হয়নি, বরং মুসলিম নামই পরিবর্তন করা হয়েছে। অবিভক্ত ভারতের সিলেটের করিমগঞ্জে ব্রিটিশ আমলে মুসলিম ধনাঢ্য ব্যক্তি এহিয়া সাহেব ‘এহিয়া কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পরপর নাম পরিবর্তন করা হয়। সিলেটে তার প্রতিক্রিয়া হয়নি। সিলেটের হিন্দু ঐতিহ্যবাহী প্রতিটি প্রতিষ্ঠান আজো স্বনামে অবস্থান করছে। যেমনÑ মুরারিচাঁদ কলেজ, মদনমোহন কলেজ, রাজা গিরিশচন্দ্র হাইস্কুল, দুর্গাকুমার পাঠশালা, সারদা হল প্রভৃতি। অনুরূপভাবে, সিলেটের বিশ্বনাথ ও জগন্নাথপুর উপজেলা হিন্দুদের দু’জন দেবতার নামে, যা পরিবর্তনের চিন্তা কেউ করেনি। এমনিভাবে, চট্টগ্রামে জেএমসেন স্কুল-কলেজ, নারায়ণহাট আদর্শ কলেজ, স্যার আশুতোষ কলেজ, মুজাফফরাবাদ যশোদা নগেন্দ্র নন্দী মহিলা কলেজ, কুণ্ডেশ্বরী মহিলা কলেজসহ সারা দেশে অমুসলিম ধর্মীয় নামের হাজারো স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠান বা এলাকা রয়েছে। কোনো মুসলমান কখনো এসব নাম পরিবর্তনের প্রশ্ন তোলেনি। অস্বাভাবিক ও দুঃখজনক হলেও সত্য স্বাধীন সোনার বাংলাতেও বিভিন্ন সময় ‘মুসলিম’ বা ইসলামধর্মীয় শব্দ মুছে দেয়ার বা পরিবর্তন করার অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। অনেকে দুঃখ করে বলেন, বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ভারতের তুলনায় ধর্মনিরপেক্ষতায় আমরা (বাংলাদেশ) যেন কয়েক পা এগিয়ে!
মুসলমানদের কৃষ্টি-ঐতিহ্য রক্ষার জন্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল বলে এর মনোগ্রামে উৎকীর্ণ হয়েছিল, ‘রাব্বি জিদনি ইলমা’ বাক্যটি, যার অর্থ ‘হে আল্লাহ, আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করুন।’ বাদ দেয়া হয়েছে। বিদ্বেষের শিকার হয়েছে জাহাঙ্গীনগর ‘মুসলিম’ বিশ্ববিদ্যালয়, ফজলুল হক মুসলিম হল। সারা বাংলাদেশে বহু স্থাপনার নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। তখন নিম্নোক্ত নামগুলো কি পরিবর্তন করা যেত না যেগুলো ব্রিটিশরা পরিবর্তন করেছিল। যেমনÑ ময়মনসিংহের পূর্ব নাম মোমেনশাহী, এরপর হয় নাসিরাবাদ। কিন্তু উপনিবেশবাদী ব্রিটিশরা কথিত ভুলের অজুহাতে এর নামকরণ করে ‘ময়মনসিংহ’। ইতিহাসের ‘ভুল’ সাক্ষ্য বহন করে বিধায় নামটি পরিবর্তন করা কি জরুরি নয়? অনেক ক্ষেত্রে আউলিয়াদের নামে নামকরণ বা পরিবর্তনকে সৎ উদ্দেশ্যে করা হয়েছে বলে মনে হয় না। সবাই মনে করে, এসব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ ও জাতীয়তাবাদীরা সুযোগ পেলে ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেÑ এসব তার উদাহরণ।
এবার চট্টগ্রামের সন্তান জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর নামাজে জানাজার আগে (২০ অক্টোবর ২০১৮) চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন ঐতিহ্যবাহী মুসলিম হলের নাম পরিবর্তন করে আইয়ুব বাচ্চুর নামে করার ঘোষণা দেন। তিনি মন্ত্রণালয়ে নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব পাঠানোর কথাও বলেছেন। এতে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বিশেষত, অনলাইনে ঝড় ওঠে। সবার অভিমত, জনপ্রিয় শিল্পী বাচ্চুর নামে নতুন সাংস্কৃতিক ভবন করা যায় বা নির্মাণাধীন যেকোনো মিলনায়তনের নাম দেয়া যায়। এতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু জনপ্রিয় শিল্পীকে বিতর্কিত করা উচিত নয়।
১৯৫৩ সালে কে সি দে রোডে বর্তমান মুসলিম ইনস্টিটিউট হল নির্মিত হয়েছিল। কেউ কেউ অতি উৎসাহী হয়ে শিল্পী বাচ্চুর নামে জে এম সেন হলের নামকরণের দাবি করছেন; এটা সাম্প্রদায়িক ও অযৌক্তিক দাবি। অনেক গবেষক ও চিন্তাবিদের মতে, ধর্মনিরপেক্ষ ভারত ও বাংলাদেশে নাম পরিবর্তনে যে সাম্প্রদায়িক আচরণ লক্ষ করা যাচ্ছে, এতে দু’দেশে পরিকল্পিতভাবে মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্য মুছে দেয়ার একটি অঘোষিত ধারাবাহিক ষড়যন্ত্র চলছে। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের যথাযথ ভূমিকা রাখা জরুরি। জনপ্রতিনিধিরা জনগণের সেবক। তাই তাদের জনগণের মনের ভাষা বুঝতে, সে অনুযায়ী কর্মসূচি বা কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। জনপ্রতিনিধির আসনে বসে অদূরদর্শী ও অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত নেয়া বা ঘোষণা দেয়া দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক নয়। হ
E-mail: faridulislam.ctg@gmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement