২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

গায়েবি মামলার পোস্টমর্টেম

সময়-অসময়
-

দেশব্যাপী গায়েবি মামলার নামে চলছে আইনি বর্বরতা, অর্থাৎ কেউ বর্বরতা চালায় বোমাবাজি করে, কেউ খুন করে দেশী-বিদেশী অস্ত্র ব্যবহারে, কেউ আবার নির্যাতন বা বর্বরতা চালায় ধোঁকাবাজির মাধ্যমে। নির্যাতন-নিবর্তনের অনেক রূপ ও স্বাদ রয়েছে। বিড়াল যখন ইঁদুর নিধন করে, তখন একই সাথে করে না, খেলতে খেলতে যন্ত্রণাদায়ক কষ্ট দিতে দিতে ইঁদুরকে হত্যা করাই বিড়ালের আনন্দ। বিকৃত রুচির খুনিরা ভিকটিমকে এক আঘাতে বা গুলিতে হত্যা করে না, বরং নির্যাতনের মাধ্যমে কষ্ট দিয়ে হত্যা করতে আনন্দ পায়। অপরাধ বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীতে অনেক যৌন বিকৃতির মানুষ আছে; যারা কোনো নারীকে দৈহিকভাবে ভোগ করার পরিবর্তে তাকে বেত্রাঘাতে নির্যাতন করে নারীর আর্তনাদ উপভোগ করে। পিটিয়ে হত্যা করা বা কোনো অপরাধ করা শুধু একটি শারীরিক ইচ্ছা বা শক্তির বিষয় নয়, বরং মানসিকতার প্রশ্ন। একজন আরেকজনকে কিভাবে নির্যাতন করবে, তা নির্ভর করে সে ব্যক্তির নির্যাতনকারী মন-মানসিকতার ওপর।
পত্রিকান্তরে প্রকাশ, সম্প্রতি জাপানি মেয়েরা দুঃখের কান্নাকাটি শোনানোর জন্য সুদর্শন পুরুষ ভাড়া করে। কারণ এতেই তারা আনন্দ পায়। এটাও এক ধরনের রুচির বহিঃপ্রকাশ। ফলে কে কোন ধরনের আনন্দ ভোগ করে, তা নির্ভর করে তার রুচির ওপর নির্যাতন নিপীড়ন করে ক্ষমতাসীনেরা আনন্দ উপভোগ করার ইতিহাস দীর্ঘ দিনের। এতে মিথ্যা ও জঘন্য মিথ্যার আশ্রয় নিতে ক্ষমতাসীনেরা কোনো দিন কুণ্ঠাবোধ করেনি এবং এখনো করে না। এই নির্যাতনী পন্থাকে ব্যবহার করার জন্য আধুনিক সমাজে ক্ষমতাসীনেরা যে পন্থাটি বেশি ব্যবহার করে তা হলো ‘আইন’। কারণ আইনকে সহজে ব্যবহার করার সুযোগ ক্ষমতাসীনদের হাতেই। তবে আইন ও নৈতিকতা এক বিষয় নয়। ‘নৈতিকতা’ ও ‘আইন’ যদি সাংঘর্ষিক হয়, তবে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও সভ্যতা, নৈতিকতাকেই সমর্থন করবে, এটাই প্রত্যাশাযোগ্য। দেশব্যাপী গায়েবি মামলা হচ্ছে। নির্বাচনপূর্ব গায়েবি মামলাগুলোকে জনগণ নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবেই মনে করছে। কোথাও কোথাও মামলা সৃজন করার জন্য অগ্নিসংযোগ জাতীয় ঘটনা ঘটানো হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কল্পনাপ্রসূত ঘটনা থেকেই মামলা, গ্রেফতার, রিমান্ড তথা রিমান্ড বাণিজ্যসহ সবই হচ্ছে। কারণ, এসব মামলায় জামিন নিতে হাইকোর্ট পর্যন্ত আসতে হচ্ছে। গায়েবি মামলায় অনেকের জামিন নামঞ্জুর করা হয়। একজন নির্দোষ মানুষকে আটক রাখা হয় ‘আইন’কে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। এ মর্মে জেলা আইনজীবী সমিতি বা সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির দৃশ্যমান কোনো প্রতিবাদ নেই। কারণ প্রতিবাদে নিজের পেশা নষ্ট হয় বলে আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি আইনজীবী নেতারা হতে চান না। এটাই পাবলিক পারসেপশন, নতুবা দেশবাসীর ওপর আইনি বর্বরতায় আইনজীবীদের নীরব ও প্রতিবাদবিহীন ভূমিকা থাকবে কেন? সুপ্রিম কোর্ট নারায়ণগঞ্জ, ঢাকাসহ বিভিন্ন নির্বাচিত আইনজীবী নেতাদের সাথে আলাপ করে এটাই আমার উপলব্ধি। এ নির্মম উপলব্ধি ভুল হয়েছে কি-না, তা বিবেচনার ভার ভুক্তভোগী ও বিজ্ঞ আইনজীবী সমাজের ওপর দিলাম।
নারায়ণগঞ্জ জেলাধীন সিদ্ধিরগঞ্জ থানার একটি গাড়ি পোড়ানো ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত ৮ নভেম্বর ২০১৮ জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, যা নি¤œরূপÑ
‘সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজীতে মধ্যরাতে ইপিজেডের একটি শ্রমিক বহনকারী পার্কিং করা বাসে (ঢাকা-মেট্রো-ব-১১-২৪৭৯) আগুন দিয়েছে অজ্ঞাত তিন দুর্বৃত্ত। তবে এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে পুলিশ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থলে নিয়োজিত নিরাপত্তা প্রহরীর বক্তব্য নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। নিরাপত্তা প্রহরী বলছেন, অগ্নিকাণ্ডের সন্নিকটেই পুলিশের গাড়ি অবস্থান করছিল এবং গাড়িতে আগুন লাগানোর আগে দুর্বৃত্তরা পুলিশের সাথে কথা বলে এসেছে। আর পুলিশ বলছে, দুর্বৃত্তদের একজন সিদ্ধিরগঞ্জ পুলে কী যেন ঝামেলা হচ্ছে জানিয়ে চলে যায়। এ নিয়ে এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চলের সৃষ্টি হয়। গত মঙ্গলবার রাত পৌনে ১টার দিকে শিমরাইল-নারায়ণগঞ্জ আউলাবন সংযোগ সড়কের পাশে সিএনজি স্টেশনের উত্তর পাশে সড়কের ওপর এ ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে আদমজী ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট এসে আধাঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে আগুন লাগানোর সময় গাড়ির ভেতরে কেউ ছিল না। খবর পেয়েই ঘটনাস্থলের সন্নিকটে সিদ্ধিরগঞ্জ পুলে থাকা থানা পুলিশের পরিদর্শন (তদন্ত) নজরুল ইসলাম ও পরিদর্শক (অপারেশন) আজিজুল হক তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে আসেন। এ ঘটনার সময় ঘটনাস্থলের কাছে থাকা সিদ্ধিরগঞ্জ থানার উপ-পরিদর্শক দিলিপ কুমার বিশ্বাসকে আইনগত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থলে নিয়োজিত থাকা নিরাপত্তা প্রহরী কাঞ্চন জানান, তিন যুবক একটি সিএনজি করে এসে গাড়িটির সন্নিকটে দাঁড়ায়। এর মধ্যে একজনের মুখমণ্ডল গামছা দিয়ে বাঁধা ছিল। অপর একজন ঘটনাস্থলের কাছে পুলিশ পিকআপ নিয়ে দাঁড়ানো পুলিশ অফিসারের সাথে কথা বলেন। এরপরই পুলিশ গাড়িটি ঘুরিয়ে একটু সামনে নিয়ে দাঁড় করায়। পরে ওই তিন দুর্বৃত্ত গাড়িটির পাশে অবস্থান নেন। এ সময় তিনি এখানে অবস্থান করতে তাদের বাধা দিলে তারা নিজেদের পুলিশের সোর্স বলে পরিচয় দেয় এবং জানায় একজন আসামি এ পথ দিয়ে অবৈধ মাল নিয়ে আসছে। তাকে আটক করতেই তারা এখানে একটু আড়ালে দাঁড়িয়েছে। পরে তিনি বাসের সামনে থেকে একটু দূরে সরে এলেই দেখতে পান ওই দুর্বৃত্তরা একটি ইট ছুড়ে গাড়ির গ্লাস ভেঙে ভেতরে কী যেন ছুড়ে দিলো এবং সাথে সাথেই গাড়ির ভেতরে আগুন ধরে যায়। পরে তিনি ধাওয়া দিলে তারা আউলাবন সড়ক দিয়ে পালিয়ে যায়। তিনি আরো জানান, এদের এর আগেও তিনি দেখেছেন। তবে তাদের নাম জানেন না। তারা পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করে থাকে। তবে তিনি তাদের আবার দেখলে চিনতে পারবেন।’
উক্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৫(৩)/২৫ ধারা তৎসহ দণ্ডবিধি আইনের ৪৩৫ ধারায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় ০৭/১১/২০১৮ ১২ নম্বর মামলা করা হয়েছে, যার প্রধান আসামি জাতীয়তাবাদী তরুণ দলের জেলা সভাপতি টিএনএইচ তোফা, যুবদল নেতা ইকবাল হোসেনসহ বিএনপির নেতারা। সাবেক এমপি ও নির্বাচিত কাউন্সিলর কেউ বাদ পড়েনি যার জ্ঞাত সংখ্যা নামধারী ৩১ জন ও অজ্ঞাত ২০-৩০ জন অর্থাৎ সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় জাতীয় নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রে নেতৃত্ব দেয়ার মতো কাউকে ছাড় দেয়া হয়নি। এ মামলায় পুত্রকে অর্থ জোগানদাতা ও পিতাকে বাস পোড়ানোর আসামি করা হয়েছে। মিথ্যা ও নির্লজ্জতায় সীমা ছাড়িয়ে ক্ষমতার লড়াই কতটুকু গড়াতে পারে তাই নীরবে নিভৃতে নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকা ছাড়া জাতির হাতে আর কী রয়েছে? জাতীয় পত্রিকায় ঘটনার বিবরণ ও মামলার এজাহারের বিবরণ আকাশ পাতাল ডিফারেন্স, যা গায়েবি চিন্তার ফসল মাত্র। পুলিশ আইন ১৮৬১ প্রণয়নের মাধ্যমে ব্রিটিশ থেকে পাকিস্তান এবং পাকিস্তান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের পুলিশের সৃষ্টি কিন্তু আচরণের দিক থেকে আইন যেমন সংস্কার হয়নি তেমনি ঔদার্য্যপূর্ণ আচরণ বেড়েছে। ‘দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন’ যেখানে পুলিশের কাজ হওয়ার কথা ছিল, বাস্তবে তা এখন সত্য মিথ্যা যাই হোক না কেন অনৈতিক আচরণের বিষয়টির ওপর তোয়াক্কা না করেই ক্ষমতাসীনদের পারপাস সার্ভ করাই যেন পুলিশের একমাত্র দায়িত্ব। ব্যতিক্রম হাতেগোনা দু-চারজন থাকতে পারে, কিন্তু তারাও এখন কোণঠাসা।
প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর জন্য মিথ্যার আশ্রয় নেয়া কোনো কোনো মানুষের অভ্যাসগত স্বভাব হলেও সামাজিক মূল্যবোধ মিথ্যাকে ঘৃণা করে। কিন্তু বিরোধীদের দমনের জন্য ক্ষমতাসীনেরা যখন মিথ্যাকে সৃজন করে তখন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ হারিয়ে যায়। গণতন্ত্রের চেহারা তখন দিন দিন ফ্যাকাশে হতে থাকে। তখনই মানুষ বলে যে গণতন্ত্র এখন খাদের কিনারায়।
গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা ক্ষমতাসীনেরা যুগে যুগে যে যার মতো করে দিয়েছে। এ জন্য গণতন্ত্রের বীভৎস চেহারা মানুষ দেখলেও এর সুফল ভোগ করতে পারে না। গণতন্ত্রকামীরাও স্বৈরাচারে পরিণত হয় যখন তাদের ক্ষমতার চাদরে স্পর্শ লাগে। ‘গায়েবি মামলা’র হাতিয়ার গণতন্ত্রের চেহারা আরো মলিন করে দিচ্ছে। ফলে এর পরিণতি কী হতে পারে তা সময়ই বলে দেবে।হ
লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
মতলব উত্তরে পানিতে ডুবে ভাই-বোনের মৃত্যু প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের শেষ ধাপের পরীক্ষা শুক্রবার লম্বা ঈদের ছুটিতে কতজন ঢাকা ছাড়তে চান, কতজন পারবেন? সোনাহাট স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করলেন ভুটানের রাজা জাতীয় দলে যোগ দিয়েছেন সাকিব, বললেন কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই কারওয়ান বাজার থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে ডিএনসিসির আঞ্চলিক কার্যালয় এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে কার্যকর পদক্ষেপ নিন : প্রধানমন্ত্রী নারায়ণগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ ওসি আহসান উল্লাহ ‘ট্রি অব পিস’ পুরস্কার বিষয়ে ইউনূস সেন্টারের বিবৃতি আনোয়ারায় বর্তমান স্বামীর হাতে সাবেক স্বামী খুন, গ্রেফতার ৩ ফতুল্লা প্রেস ক্লাবের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত

সকল