২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বিপর্যয় ও ধ্বংস বাড়ছে

অন্য দৃষ্টি
-

জার্মানির ওল্ফবার্গে সোস্যাল বিজনেস একাডেমিয়া সম্মেলনের ফাঁকে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এখনই পথরেখা ঠিক না করলে ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে বিপর্যয় থেকে বাঁচানো যাবে না। তিনি দুটো বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত দেনÑ একটি হচ্ছে পরিবেশ বিপর্যয়; অন্যটি সম্পদ পুঞ্জীভূতকরণ। তিনি বলেন, প্লাস্টিক আমাদের সর্বনাশ করে দিতে পারে। যে অবস্থা চলছে তা হলে টেনেটুনে আমরা সর্বোচ্চ ৩৫ বছর চলতে পারব। এ শতাব্দী পার করার মতো শক্তি নেই। আবহাওয়ার কারণে সর্বনাশ হয়ে যাবে। পৃথিবী আর বসবাসযোগ্য থাকবে না আমাদের জন্য। সম্প্রতি করা গবেষণা প্রতিবেদন নিয়ে আমেরিকান সংবাদমাধ্যম সিএনএন প্রতিবেদন রচনা করেছে। ওই গবেষণায় গবেষকেরা মূলত উষ্ণতা বৃদ্ধির ভয়াবহ দিকটি তুলে ধরেছেন। এর কিছু দিন পর বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া নিয়ে আরেকটি প্রতিবেদন তারা প্রকাশ করেছে। গবেষকদের পাশাপাশি বিশ্বের সংবেদনশীল মানুষ পৃথিবীর আসন্ন বিপদের আশঙ্কা নিয়ে কথা বলছে।
পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী বিলুপ্তি নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদনের আগে ড. ইউনূস যে সম্পদের পুঞ্জীভবনের কথা বলেছেন, সেটির বাস্তবতা দেখা যেতে পারে। সম্পদের কেন্দ্রীভূত হওয়ার প্রবণতাকে তিনি টাইম বোমার সাথে তুলনা করেছেন। এটি যেকোনো সময় বিস্ফোরিত হয়ে পৃথিবীর জন্য সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। দাভোসে ধনী দেশগুলোর সম্মেলনে দাতব্য সংস্থা অক্সফাম ভয়াবহ চিত্রটি তুলে ধরেছে। তাদের দেয়া তথ্য-উপাত্ত ইউনূসের বক্তব্যকে সমর্থন করে। সবচেয়ে আট ধনীর কাছে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের সমান সম্পদ রয়েছে। অক্সফামের হিসাবে সম্পদ পুঞ্জীভূত হওয়ার হার দ্রুতগতিতে বাড়ছে। তাদের হিসাবে বিশ্বের দরিদ্র ৫০ শতাংশ মানুষের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৪২৬ বিলিয়ন ডলার। একই পরিমাণ সম্পদ ২০১৭ সালে পুঞ্জীভূত হয়েছে শীর্ষ আটজন ধনীর কাছে। আগের বছরে অক্সফামের হিসাব মতে, ৬২ জন ধনী লোকের কাছে বিশ্বের অর্ধেক মানুষের সমান সম্পদ ছিল। ২০১৭ সালে অক্সফামের কাছে আসা নতুন তথ্যে দেখা যাচ্ছে, সম্পদ পুঞ্জীভূত হওয়ার চিত্রটি তাদের ধারণাকে একেবারে পাল্টে দিয়েছে। নতুন হিসাবে তারা দেখেছে, চীন ও ভারতে দারিদ্র্য আরো চরম আকারে রয়েছে। দরিদ্রদের সম্পদ কমার হার তাদের ধারণার চেয়ে দ্রুততর। একই সাথে ধনীদের সম্পদ বাড়ার হারও দ্রুততম। ড. ইউনূস এটাকে একটা আসন্ন বিপর্যয় হিসেবে দেখছেন। কারণ, সম্পদশালীদের সম্পদ আহরণের কৌশল যত সূক্ষ্ম হচ্ছে; দরিদ্রদের সম্পদ রক্ষা করার শক্তি ততই দুর্বল হচ্ছে। এর ফলে একটা সময় সম্পদের অধিকার নিয়ে পৃথিবী একেবারে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে। ইউনূসের সর্বশেষ উদ্ভাবন সামাজিক ব্যবসায়। তিনি এই ব্যবসার বিস্তৃতি নিয়ে সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তিনি শুরু করেছিলেন গ্রামীণ ব্যাংক দিয়ে। এই ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ে অনেক সমালোচনা রয়েছে। এমন একটা ব্যবস্থা তিনি প্রচলন করেছেন, যা সুদি ব্যবস্থাকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিয়েছে। দরিদ্র মানুষের একটা অংশ গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ নিয়ে সর্বস্ব হারানোর উদাহরণ রয়েছে।
আসা যাক পরিবেশগতভাবে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে। সংবাদমাধ্যম সিএনএন এক গবেষণা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, পৃথিবীর মোট তাপের ৬০ শতাংশেরও বেশি শোষণ করে নেয় সাগর-মহাসাগরগুলো; যা জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এ সংক্রান্ত নেচার পত্রিকায় সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, জীবাশ্ম জ্বালানির মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতি সম্পর্কে গবেষকদের যে ধারণা ছিল, তার থেকেও বেশি ক্ষতি হয়ে থাকে।
ন্যাশনাল ওশেনোগ্রাফিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিরিক অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের পরিবেশের অতিরিক্ত ৯০ শতাংশ তাপ শোষণ করে সাগর-মহাসাগরগুলো। এ গবেষণাটির লেখক লরেল রেসপ্লানডি বলেন, ২০১৪ সালে জাতিসঙ্ঘ জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তঃসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) গবেষণায় যে তথ্য দেয়া হয়েছিল, তার থেকে বেশি তাপ শোষণ করে সাগরগুলো। তিনি এবং তার সহকর্মীরা গবেষণার মাধ্যমে এই তথ্য জানতে পেরেছেন। ফলে সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত কারণে ঝড়ঝাঁপ্টা বেড়েছে। আবার তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সাগরের তলদেশে প্রাণী মারা যাচ্ছে।
এই গবেষণা এমন সময় প্রকাশ হলো, যার কয়েক সপ্তাহ আগে জাতিসঙ্ঘ সতর্ক করে বলেছিল, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ভয়ঙ্কর বিপর্যয় থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে মাত্র আর ১০ বছর সময় আছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সংস্থাটি বিভিন্ন দেশের সরকারের প্রতি দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। শক্তির একক জুলের হিসাব অনুযায়ী, ১৯৯১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ১৩ জেটা জুল তাপ শোষণ করে সাগরগুলো। এক জেটা জুল ১০ হাজার কোটি বিলিয়নের সমান। জাপান ও ইন্দোনেশিয়ায় সুনামি এবং আমেরিকার উপকূলে উপর্যুপরি টর্নেডো ভবিষ্যতে আরো বড় বিপর্যয়ের আভাস দিচ্ছে।
মানুষের সৃষ্ট অনাচারে বিশ্বপ্রাণিকুলের অবস্থা আরো বেশি সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়ছে। পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত করার মাধ্যমে প্রাণিকুলের পরিণতি কেমন দাঁড়াচ্ছে তা জানা যাচ্ছে বিশ্ব বন্যপ্রাণী তহবিলের (ডব্লিউডব্লিউএফ) নতুন এক প্রতিবেদনে। ওই প্রতিবেদনের সূত্রে সিএনএন জানাচ্ছে, গত চার দশকে বিশ্বে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা ৬০ শতাংশ কমেছে। দূষণ, বনাঞ্চল উজাড় হয়ে যাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তনসহ মানবসৃষ্ট নানা কারণে এ অবস্থা হয়েছে।
১৯৭০ সাল থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে চার হাজারের বেশি স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, মাছ সরীসৃপজাতীয় প্রাণী ও উভচর প্রাণীর প্রজাতি কমেছে। সংস্থাটি ‘বাসযোগ্য পৃথিবীর প্রতিবেদন ২০১৮’-এ এই তথ্য তুলে ধরেছে। সংস্থাটি বলেছে, স্বভাবগত স্থানান্তর, শিকার, দূষণ, রোগব্যাধি ও জলবায়ু পরিবর্তন ক্রমাগত বাড়বে। ২০৫০ সাল নাগাদ মানুষের পদচিহ্ন পড়েনি এমন জায়গার পরিমাণ এক-চতুর্থাংশ থেকে কমে এক-দশমাংশে পৌঁছবে। বন্যপ্রাণী রক্ষায় ও প্রকৃতির ওপর মানুষের বাজে প্রভাব বন্ধে প্যারিস জলবায়ু চুক্তির আদলে আন্তর্জাতিক চুক্তি করার জন্য প্রতিষ্ঠানটি আহ্বান জানিয়েছে।
ডব্লিউডব্লিউএফ আরো বলেছে, যে হারে মানুষ প্রকৃতিকে ধ্বংস করেছে, এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে বন্যপ্রাণী রক্ষা করা যাবে না। সংস্থাটির মহাপরিচালক মার্কো ল্যাম্বার তিনি বলেন, ‘মাত্র ৪০ বছরে আমরা এত দ্রুতগতিতে বন্যপ্রাণী নিধন করেছি যে এটা অবিশ্বাস্য। আমাদের কাছে এখনো প্রকৃতির ধ্বংস ঠেকানোর ক্ষমতা আছে; অথচ একবিংশ শতাব্দীতেও আমরা আদিম সমাজের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে বন্যপ্রাণী সাবাড় করে দিয়েছি। আমরা মনে করি, প্রকৃতি শুধু উদারহস্তে দেয়ার জন্য। এই ভাবনা বন্ধ করতে হবে।’
পশু, পাখি ও মাছ খাবার গ্রহণের সময় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্লাস্টিক খেয়ে ফেলছে। ড. ইউনূস সত্যিই বলেছেন পলিথিনের কথা। যেভাবে আমাদের পরিবেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে পলিথিন ও প্লাস্টিক-জাতীয় পদার্থ, তাতে মানুষের পেটেও এগুলো চলে যাওয়ার কথা। তবে মানুষ যথেষ্ট বুদ্ধিমান যে পলিথিন খেয়ে ফেলছে না। পশু-পাখি, মাছ কি সেটা পারছে? প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৯০ শতাংশ সামুদ্রিক পাখির পেটে এখন প্লাস্টিকের উপস্থিতি। অথচ ১৯৬০ সালে এই হারটা ছিল মাত্র ৫ শতাংশ। ১৯৭০ সাল থেকে লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ৮৯ শতাংশ কমেছে। একই সময় ব্যাঙ ও মাছের মতো প্রাণী যেগুলো পানির ওপর নির্ভরশীল, এমন প্রাণীর সংখ্যা কমেছে ৮৩ শতাংশ। সমুদ্রের তলদেশে টনকে টন পলিথিন জমা হচ্ছে। এতে করে পানি দূষিত হয়ে মারা যাচ্ছে মাছ ও সমুদ্রের বিভিন্ন প্রাণী এবং উদ্ভিদ।
বাস্তবে কি মানুষ পলিথিন বা প্লাস্টিক-জাতীয় পদার্থ না খেয়ে নিজেকে রক্ষা করতে পারছে? খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মানুষের শরীরেও প্লাস্টিক ঢুকে পড়ছে। পাখি ও সামুদ্রিক মাছ ভক্ষণের মাধ্যমে মানুষের দেহে এই ভয়াবহ ক্ষতিকর পদার্থ প্রবেশ করছে। বাংলাদেশে পলিথিন ও প্লাস্টিক-জাতীয় পদার্থ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ছে তা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিদিন শুধু ঢাকা শহরে এক কোটির বেশি পলিথিন পরিত্যক্ত হচ্ছে। এভাবে সারা দেশে পলিথিন এখন উচ্চ হারে ব্যবহার হচ্ছে। পলিথিন ছড়িয়ে পড়ছে পুকুর, ডোবা-নালা ও নদীতে। পশু-পাখি ও মাছের পেটে ঢুকছে এসব পলিথিন। খাদ্যচক্রের মাধ্যমে এসব পলিথিন আমাদের দেহে প্রবেশ করার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে।
সূরা আর রুমের ৪১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের ফলে জলে-স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। এসব কুকর্মের কারণে তিনি তাদের শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাতে চান। আশা করা যায়, তারা ফিরে আসবে।’ প্রায় সাড়ে চৌদ্দ শ’ বছর আগে নবী মুহাম্মদ সা:কে সামনে রেখে আল্লাহ কথাগুলো বলছেন, তখনো মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয় পৃথিবীতে ছিল। এমনকি তার আগেও এমন বিপর্যয় ঘটেছে। তার প্রমাণ হচ্ছে, ওই সূরায় তার পরের আয়াতে মানুষকে বলা হচ্ছে জমিনে ভ্রমণ করতে। তাহলে এদের কী পরিণতি হয়েছে তা তারা দেখতে পাবে।
বাস্তবে মানুষের সংশোধনের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ফলে বিপর্যয় ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এর ব্যাপ্তি ও ক্ষতির মাত্রাও বাড়ছে। প্রাকৃতিক পরিবেশের যে বিপর্যয়, সেটিও মানুষই ডেকে আনছে। ফল আরো ভয়াবহ হতে পারে। যার ফলে পৃথিবী নামক গ্রহটি ধ্বংস হতে পারে। এই ধ্বংস সাধনের গতি দিনদিন বাড়ছে। বর্তমান পৃথিবীর যে বিপর্যয় তা যেন সর্ববিস্তারিত। পলিথিনের কারখানা বাড়ছে। উদ্যোক্তা তার লাভকে সর্বোচ্চ করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এতে করে কার কী ক্ষতি হলো সেটি ভাবার সময় তার নেই। নিজের ক্ষতির ব্যাপারেও সে সচেতন নয়।
মানুষের সমাজে শ্রেণিবৈষম্য প্রকট হয়ে উঠছে। এটা এখন এমন পর্যায়ে চলে গেছে, পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত হতে চলেছে। একদল ধনী, অন্যরা সব দরিদ্র। মধ্যবর্তী শ্রেণীটি বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে। এটা পৃথিবীর আসন্ন এক বড় বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে, যাকে ড. ইউনূস ‘টাইম বোমা’ নামে আখ্যা দিয়েছেন। বিশ্বনেতৃত্ব এর সমাধান দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। পৃথিবীর মোড়ল রাষ্ট্রগুলো ধনী-দরিদ্রের গ্যাপ কমানোর পরিবর্তে তা কিভাবে বাড়ানো যায় তার আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে। সংস্কার সাধন ও সংশোধনকামী দেশ ও নেতৃত্ব নেই। ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয় বিশ্বকে ধ্বংসের প্রান্তে নিয়ে যাওয়ার গতি ত্বরান্বিত করবে। হ
jjshim146@yahoo.com

 


আরো সংবাদ



premium cement