১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জনগণকে সরকার কেন ভয় পায়?

-

৬৫ বছর আগে যুক্তফ্রন্ট ১৯৫৪ সালে ক্ষমতায় আসে, যা বর্তমানে গঠিত হয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে একটি জোট। এই ঐক্যফ্রন্ট গঠন করতে সময় লাগে হারিয়ে যাওয়া গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে প্রায় বহু বছর। হারিয়ে যাওয়া গণতন্ত্র এখনো ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। সবেমাত্র সংগ্রাম শুরু। নানা ষড়যন্ত্র শুরু গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে। গণতন্ত্র বাস্তবায়ন করা এত সহজ নয়। ২৩ বছর লেগেছে পাকিস্তানে (১৯৪৭-১৯৭০) গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে। গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠানিক রূপ না দেয়ার কারণে ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পর চারবার গণতন্ত্র আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম। ১৯৭৫, ১৯৮১, ২০০৭ (ওয়ান-ইলেভেন) এবং ২০১৪ সাল এই চারবার আমরা গণতন্ত্রের পাহারাদার হিসেবে মুখ্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হই ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থ চরিতার্থের কারণে। গণতন্ত্র রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত একান্ত প্রয়োজন। দরকষাকষি করে জনগণের ঐক্য মজবুত হয় না। বর্তমান রাজনৈতিক অঙ্গনে সন্তানের কথায় বাবা-মা গণতন্ত্রের সিদ্ধান্ত নেবেনÑ এরকম ঘটনা ২০১৮ সালে পড়ন্ত বেলায় এসে জাতিকে দেখতে হলো। দেশে বহুমত, বহুদলের সংমিশ্রণ আছে। এটা বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশেও আছে। তবে ছোটখাটো মতভেদ ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়া সময়ের দাবি মনে করলে তখনই আপনাআপনি স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটে এবং তখন দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র কায়েম হয়।
৬ নভেম্বর ২০১৮ রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক জনসমাবেশে বর্ষীয়ান নেতা ড. কামাল হোসেন বলেন, দেশের মালিক হলো জনগণ আর সরকার হলো জনগণের সেবক। দেশ সেভাবেই চলবে জনগণ যেভাবে চাইবে। দেশের প্রকৃত মালিকেরা সচেতন হয়েছে। জেগে উঠেছে। গুলি, টিয়ার শেল এবং গরম পানি ছিটিয়ে তাদের মুখের ভাষা কেড়ে নেয়া সম্ভব নয়। জনগণের দাবি উপেক্ষা করলে যে শাস্তি পেতে হবে তা তারা কখনো কল্পনাও করতে পারছে না। যেমনটি অতীতের সরকারও ভাবতে পারেনি। কিন্তু তারা এখন শাস্তি ভোগ করছে ক্ষমতা হারানোর পর। অন্যায়কারীদের শাস্তি ভোগ করতে হবে এটাই চিরন্তন সত্য। কিন্তু এ সরকার বারবার সংবিধানের কথা বলে উল্টো সংবিধান লঙ্ঘন করছে। জনগণকে কেন সরকার ভয় পাচ্ছে। কারণ সরকার জনগণের অধিকারবঞ্চিত করছে। এর জন্য বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। নানাভাবে সংবিধান লঙ্ঘনের জবাবদিহি আদায় করে ছাড়বে জনগণ। এই বর্ষীয়ান নেতা আরো বলেছেন, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে গ্রেফতার করে সংবিধান লঙ্ঘন করেছে এই সরকার। নিজেরা আইন তৈরি করে দেশের সচেতন মানুষকে গ্রেফতার করাও বেআইনি কাজ। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি প্রসঙ্গে ড. কামাল হোসেন বলেন, তার মুক্তি এখন আর চাওয়ার বিষয় নয়, তার মুক্তি এখন হওয়ার বিষয়। প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই মন্তব্য করেছেনÑ চট্টগ্রাম নসিমন ভবনের সম্মুখস্থলে সমাবেশস্থলটি জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। তেমনি ৬ নভেম্বর ঢাকা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভাও মহাসমুদ্রে রূপ ধারণ করেছে। ওই জনসভায় এই বর্ষীয়ান নেতা বলেন, পুরো বাংলাদেশের মালিক জনগণ। লালদীঘির ময়দান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানÑ সব জেলা-উপজেলা শহরের ময়দানগুলোর মালিক জনগণ। তাদের মাঠে জনসমাবেশ করতে অনুমতি লাগবে কেন? মানুষকে প্রায় ৪ ঘণ্টা কষ্ট সহ্য করে আমাদের বক্তব্য শুনতে হয়েছে। নির্ধারিত লালদীঘির ময়দানে এই জনসভা হলে জনগণের কষ্ট সহ্য করতে হতো না। এসব ময়দান জনগণের জন্য নির্মাণ ও বরাদ্দ করা হয়েছিল। অথচ তারা নিজেদের মালিকানা মাঠে নিজেরা বক্তব্য দিতে পারছে না, অন্যদের বক্তব্য শুনতে পারছে না। এটা দুঃখজনক ব্যাপার। আমরা ভুলে যাই কেন যে একদিন আমাকেও বিরোধী দলের ভূমিকায় আসতে হতে পারে। তখন যারা সরকারে আসবে তারা যদি বিরোধী দলকে সভা-সমাবেশ করতে না দেয় তাহলে তারা কী করবেন। কিছুই করার থাকবে না। পেছনের দিকে তাকিয়ে তখন ভাবতে হবে এ কাজ তো আমরাও করেছিলাম।
ক্ষমতা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়। আজ আছি কাল নাও থাকতে পারি। বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতারাও ক্ষমতায় সাড়ে তিন বছরের বেশি দিন টিকে থাকতে পারেননি। আইয়ুব, ইয়াহিয়া, এরশাদ, জিয়া কেউই টিকে থাকতে পারেননি। বর্তমান সরকার সংবিধান সবচেয়ে বেশি লঙ্ঘন করেছে। সংবিধানকে নিজেদের মতো সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে, ভেবেছে এটা করলে পৈতৃক সূত্র ধরে আজীবন ক্ষমতায় টিকে থাকা যাবে। ধ্রুব সত্য যে, যারা সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে অসাংবিধানিক কাজ করেছেন তাদের একদিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। জনসভা করা জনগণের মৌলিক অধিকার। সিলেটে ঐক্যফ্রন্টকে জনসভা করতে অনুমতি দেয়া হয়নি। পরে আদালতের মাধ্যমে অনুমতি পাওয়া গেছে। ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেন জনগণকে উদ্দেশ করে বলেছেন, আপনারা যে সভা-সমাবেশে দূর-দূরান্ত থেকে বাধাবিপত্তি সহ্য করে হেঁটে সভাস্থলে এসেছেন পত্রিকায় ছবি ছাপা হয়েছে। এগুলো দলিল হিসেবে সংগ্রহ করে রাখুন। একদিন না একদিন এসব কুশাসনের বিচার করতেই হবে। আমরা মানুষের জীবনের নিশ্চয়তা চাই তেমনি তাদের ভোটেরও নিশ্চয়তা চাই, আমার ভোট আমি দেবো অন্যরা কেন আমার ভোট দেবে। ভোট পাহারাদার হিসেবে জনগণকে একাদশ সংসদে বড় ভূমিকা রাখার দায়িত্বের কথাও ড. কামাল হোসেন তিনটি বৃহৎ শহর চট্টগ্রাম, সিলেট ও ঢাকায় জানান দিয়েছেন।
আমরা সবাই জানি ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর বলা হয়েছিল এটা নিয়ম রক্ষার নির্বাচন-পরবর্তী অল্প সময়ের ব্যবধানে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে আরেকটি নির্বাচন দেয়া হবে। কিন্তু এরপর ৫ বছর নির্বাচন দেয়া হয়নি। এটা সংবিধানবিরোধী এবং ঘোরতর অপরাধ। এতবড় অপরাধ করার পরও শক্তি প্রদর্শন দেখিয়ে পার পেয়ে গেছে। এবার সেটা হবে না। জনগণের জন্য তৈরি করা সাত দফা দাবি সেভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে ভবিষ্যতে কেউ আর অসাংবিধানিক উপায়ে ক্ষমতায় আসতে না পারে। আসলে আমাদের ৪৭ বছরের ইতিহাস থেকে জনগণ শিক্ষা নিলেও রাজনীতিবিদেরা শিক্ষা নেয়নি।
তার জন্য আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর ভোগান্তি বেড়েছে এবং রাজনীতিকদের ভুলের কারণে আমাদেরও ভোগান্তি বেড়েছে। উল্লেখ্য, ৮০ দশকের পর এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ১০ বছর যেমন লড়াই করতে হয়েছে। তেমনি বিগত ১০ বছর আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে জনগণ গণতন্ত্র এবং অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা জন্য লড়াই করেছে। জনসভা গণতন্ত্রের বহু অংশের একটি অংশ মাত্র। সেটা বাস্তবায়নে সরকারের এত ভয় কিসের। ভোট দেবে জনগণ যাকে ভালো মনে করবে তাকেই জনগণ ভোট দেবে। সরকার বলছে অনেক উন্নয়ন হয়েছে, তাহলে জনগণকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ দেখি না। সরকারের ভয় একটি জায়গায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি যে দিন বাতিল হয়, সে দিন থেকেই তো জাতিকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এই কলঙ্কের বোঝার ভার যদি তারা সইতে না পেরে সমুদ্রে ডুবন্ত জাহাজের মতো ডুবে যায়। হত্যা, লুট, ধর্ষণ, গায়েবি মামলা এবং আটত্রিশ হাজার মানুষকে যারা খুন করেছে তাদের তো বিচার হবে এ ধরনের আশঙ্কাও তাদের মধ্যে কাজ করেছে। জেলে যাওয়ার আগে খালেদা জিয়া একটি কথা অতি উচ্চমনের মানসিকতার জোরে বলেছিলেন, আমি নাও থাকতে পারি, তবুও শেষ কথা বলছি জনগণের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করতে পারলে জনগণের বিজয় সুনিশ্চিত।
বেগম জিয়ার সেই কথার প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে এখন প্রবল শক্তিশালী রূপ ধারণ করে আছড়ে পড়বে সমুদ্রের কিনারার জলোচ্ছ্বাসের মতো। গণগ্রেফতার তার পূর্ব লক্ষণ। এটা সমুদ্রের নিম্নচাপ হলে যেমন হয় সেরকম একটা অবস্থা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্টি হয়েছে। ড. কামালের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট থেকে আগামী দিনের সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন জীবনের দিকনির্দেশনা আসবে। বেগম জিয়া ও তারেক রহমান নেই তাতে কিছুই যায় আসে না। লাখো কোটি মানুষের আন্দোলনের জোয়ারে দুষ্টচক্ররা ভেসে যাবে সমুদ্রের খড়খুটার মতো। একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন যারা চায় না তারাই ভিন্ন কিছু চায়। সেটা হলো স্থায়ী স্বৈরশাসন। আইয়ুবের স্বৈরশাসনে, এরশাদের স্বৈরশাসনে দেশের প্রচুর উন্নয়ন হয়েছিল। কিন্তু গণতন্ত্রের উন্নয়ন যেটাÑ সেটা হলো প্রকৃত উন্নয়ন, সেটা তারা দিতে পারেনি বলে ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম স্থানে তাদের নাম লিপিবদ্ধ হয়েছে। এখনো মানুষ আইয়ুব ইয়াহিয়া, এরশাদকে স্বৈরশাসক বলে ডাকে। আমরা চাই দেশের মানুষকে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন উপহার দিয়ে কলঙ্কমুক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, আরেকটি ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন শাসকদল আওয়ামী লীগ গৃহপালিত বিরোধী দল জাতীয় পার্টিকে সাথে নিয়ে করতে যাচ্ছে। এটা অনেকটা দৃশ্যমান হলেও আগামী ১০ দিনের মধ্যে অনেক কিছুই পরিবর্তন ঘটতে পারে। আমরা চাই সরকারের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হোক। জনগণ ভাবছে পুরো প্রশাসন দলীয় ক্যাডার বাহিনী দিয়ে সুসজ্জিত। এ ছাড়া সময় হাতে খুব কম। এই সংসদ থাকা অবস্থায় নির্দলীয় নির্বাচনী সরকার বিল পাসে সরকারের সাথে আলোচনায় বসতে হবে। একতরফা একটি নির্বাচন যাতে সরকার করতে না পারে। সরকার আলোচনায় না বসলে আন্দোলন করে শান্তিপূর্ণ একটি বিপ্লব ঘটিয়ে জনগণের সরকার গঠন করা ছাড়া বিকল্প পথ খোলা থাকবে না। অন্য দিকে, এবার নির্বাচন বর্জন করলে বিএনপির নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ঐক্যফ্রন্টকে একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যা হবে রাজনীতিতে টিকে থাকার সিদ্ধান্ত। অন্য দিকে সচেতন মানুষের একটি দাবি কে ক্ষমতায় এলো সেটা দেখার বিষয় নয়। আমার ভোট আমি দিতে পারব কি নাÑ সেটাই বিবেচ্য বিষয়। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধটা ছিল গণতন্ত্র রক্ষা আর অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে জাতিকে মুক্তি দেয়া। ভোলায় সরকারের এক মন্ত্রী বলেছেন, ঐক্যফ্রন্টের সাত দফা দাবি সংবিধানবিরোধী। তা হলে আমরা বলব, ভোটারবিহীন সংসদও সংবিধানবিরোধী। ১৫৪ জন সদস্য বিনা ভোটে পাস। এই সংসদে যত সংশোধনী আনা হয়েছে তার সাংবিধানিক ভিত্তি নেই। যেহেতু নবম সংসদের সংবিধান বৈধ, সেই আলোকেই নির্বাচন হতে হবে। হ
লেখক : গ্রন্থকার
Email: harunrashidar@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement