১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রামমন্দিরের জন্য আইন প্রণয়নের দাবি

-

এখন এ কথা একেবারে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ভারতীয় জনতা পার্টির কাছে ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে জনগণকে বোকা বানানোর জন্য রামমন্দির ব্যতীত আর কোনো বিষয় নেই। আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত তার বিজয়া দশমীর ভাষণে রামমন্দির বানানোর জন্য আইন প্রণয়নের যে দাবি করেছেন, তা মূলত আদালতে নিজের পরাজয়ই মেনে নেয়ার নামান্তর। কেননা এর আগে মোহন ভাগবত এ কথা বলেছিলেন, তিনি অযোধ্যা বিবাদে সুপ্রিম কোর্টের রায়কেই মেনে নেবেন। ভাগবত এমন এক মুহূর্তে রামমন্দিরের জন্য আইন প্রণয়নের দাবি করলেন, যখন সুপ্রিম কোর্টে অযোধ্যা মামলার ওপর চূড়ান্ত শুনানি শুরু হচ্ছে। এটাই প্রথমবার নয় যে, ভোটারদের বিভ্রান্ত করার জন্য নির্বাচনের আগে রামমন্দিরের সুর তোলা হয়েছে। নির্বাচন যখনই ঘনিয়ে আসে, তখনই সঙ্ঘ পরিবারের ওই লোকেরাই রামমন্দিরের সুর তোলে, যারা পাঁচ বছর পর্যন্ত এ বিষয় নিয়ে টালবাহানা করতে থাকে। খোদ আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতও এ কাতারে শামিল, যিনি গত চার বছরের মাঝে কখনো তার বিজয়া দশমীর বক্তৃতায় রামমন্দিরের উল্লেখ করেননি, আর এখন হঠাৎ তিনি রামমন্দিরের পাশাপাশি ওই সব বিষয়ের পালেও বাতাস দিচ্ছেন, যা সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক বিষয়। এমনিতেই আরএসএস নিজেদের একটি সামাজিক ও সেবামূলক সংগঠন বলে পরিচয় দেয় এবং রাজনীতির সাথে তাদের দূরতম সম্পর্ক আছে বলেও তারা স্বীকার করে না, তবে কার্যত আরএসএস এমন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে, যার রাজনৈতিক ফায়দা হয় বিজেপির। তারা নির্বাচনে সফলতার মালা গলায় পরতে সক্ষম হয়।
মোহন ভাগবত নাগপুরে অবস্থিত আরএসএস হেডকোয়ার্টারে যখন তার বিজয়া দশমীর বার্ষিক অনুষ্ঠানে ভাষণ দিচ্ছিলেন, তখন ওখানে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিতিন গডকড়িসহ মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিসও উপস্থিত ছিলেন। ভাগবত ওই সময় সরকারের কাছে আবেদন করেন, সরকার যেন আইন প্রণয়ন করে অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের পথ সুগম করে। তিনি এ কথাও বলেন, ‘গৌরবের দৃষ্টিতে রামমন্দির নির্মাণ অবশ্যই জরুরি। মন্দির নির্মাণের ফলে দেশে কল্যাণচিন্তা ও সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টি হবে।’ বিস্ময়কর কথা হচ্ছে, নিজেকে বিবেকবুদ্ধির মহারথী ভাবা মোহন ভাগবত চরম নির্বুদ্ধিতার সাথে কর্মসূচি হাতে নিচ্ছেন। তিনি এমন এক সমস্যা নিয়ে পার্লামেন্টের কাছে আইন প্রণয়নের দাবি করছেন, যা মৌলিকভাবে মালিকানা অধিকারের সমস্যা হিসেবে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের মুখোমুখি হয়েছে। আদালতকে প্রমাণের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত দিতে হবে, যেখানে ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২ সালে পর্যন্ত বাবরি মসজিদ দণ্ডায়মান ছিল, ওই ভূমির মালিক কে? আদালত এ কথা আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তারা অযোধ্যা মামলার সমাধান কারো ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তির পরিবর্তে মালিকানা অধিকারের প্রমাণের ভিত্তিতে ফায়সালা প্রদান করবেন। এমন মুহূর্তে পার্লামেন্টের কাছে একতরফাভাবে কোনো এক গোষ্ঠীর পক্ষে আইন প্রণয়নের দাবি করা কতটুকু সঙ্গত? সুপ্রিম কোর্ট এ বিষয়ে এটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন, সরকার কোনো এক ধর্মের সম্পর্কে আইন প্রণয়ন করতে পারবে না, কেননা এটা সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারার পরিপন্থী। মোহন ভাগবত রামমন্দিরের নির্মাণকে গৌরবের জন্য অপরিহার্য আখ্যায়িত করেছেন এবং এ কথাও বলেছেন, এর দ্বারা দেশে কল্যাণচিন্তা ও সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টি হবে। আরএসএসের বিষয়টাই এমন, তারা প্রত্যেক এমন কাজে গর্ববোধ করে, যা মুসলমানদের ক্ষতিসাধন করে এবং তাদের আইনি ও সাংবিধানিক অধিকার হরণের ব্যবস্থা করে। এ বিষয়টি দুর্বোধ্য যে, জোরপূর্বক মসজিদের জমিতে মন্দির নির্মাণ করার জন্য পার্লামেন্ট দ্বারা আইন প্রণয়নের পর দেশে কল্যাণচিন্তা ও সম্প্রীতি কিভাবে সৃষ্টি হবে? যেখানে অতীতে অযোধ্যা বিবাদের কারণে দেশে এতটা খুনখারাবি ও ধ্বংসযজ্ঞ সাধিত হয়েছে যে, তার উদাহরণ স্বাধীন ভারতের ইতিহাস পাওয়া যাবে না। এ বিবাদে সঙ্ঘ পরিবারের আক্রমণাত্মক মনোভাব দেশে কল্যাণচিন্তার পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করেছে। যদি এ বিষয়ে সরকার আরএসএসের চাপে পড়ে আইন প্রণয়নের দিকে পা বাড়ায়, তাহলে এর দ্বারা দেশের সম্প্রীতি ও কল্যাণচিন্তা বিপদে পড়বে। বিজয়া দশমীতে বার্ষিক অনুষ্ঠানে নিজের বক্তৃতায় অযোধ্যা বিবাদ সম্পর্কে মোহন ভাগবত যতগুলো কথা বলেছেন, তা বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। তার বক্তব্য পাঠ করে মনে হয়েছে, হয় তিনি বোকার স্বর্গে বাস করেন, অথবা তিনি তার অবস্থাকে উটপাখির মতো করে রেখেছেন। মোহন ভাগবতের এ বক্তব্যÑ রামজন্মভূমির জমি বরাদ্দ হওয়া বাকি শুধু, প্রমাণাদির দ্বারা এ কথা প্রমাণিত হয়েছে, এ স্থানে মন্দির ছিলÑ একেবারেই অগ্রহণযোগ্য এবং বাস্তববিরোধী। ভাগবত এ কথাও বলেন, যদি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করা না হতো, তাহলে মন্দির অনেক আগেই হয়ে যেত। তিনি এতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে রাজনীতি করা উগ্রপন্থী শক্তিগুলোকে দায়ী করেছেন। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে এ কথাও বলেন, ‘বিনা কারণে সমাজের ধৈর্যের পরীক্ষা নেয়ার অধিকার কারো নেই।’ মোহন ভাগবতের এ বক্তব্য পাঠ করে কোনো ব্যক্তিই তার হাসি দমিয়ে রাখতে পারবে না। কেননা তার ব্যাপারে ‘চোর উল্টো পুলিশকে শাসায়’ কথাটি বেশ মানায়।
মোহন ভাগবত যে অভিযোগগুলো তার প্রতিপক্ষের ওপর আরোপ করছেন, তার জন্য সবচেয়ে বেশি অপরাধী তিনি নিজেই। কেননা এ বিষয়কে কেন্দ্র করে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে সঙ্ঘ পরিবারের লোকেরা। জানি না মোহন ভাগবত কিসের ভিত্তিতে বলছেন, রামজন্মভূমির জমি বরাদ্দ হওয়া বাকি শুধু এবং সেখানে একটি মন্দির হওয়া প্রমাণিত হয়েছে। মূলত আদালতে এ সময় যে মামলা বিচারাধীন রয়েছে, তাতে মূল সমস্যা মালিকানার অধিকার নিয়ে, যার কোনো প্রমাণ মোহন ভাগবত ও তার সহযোগীদের কাছে নেই। যদি থাকত, তাহলে তিনি আদালত কার্যক্রমকে এড়িয়ে গিয়ে সরকারের কাছে এ বিষয়ে আইন প্রণয়নের দাবি করতেন না। তিনি সরকারের ওপর আইন প্রণয়নের চাপ এ জন্য দিচ্ছেন, মালিকানার মামলা বাবরি মসজিদের অনুসারীদের পক্ষে ফায়সালা হতে যাচ্ছে। এ কথাও সবারই জানা, সঙ্ঘ পরিবার নিছক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অযোধ্যা ইস্যু দাঁড় করিয়েছিল।
কেননা আশির দশকের আগে সঙ্ঘ পরিবার এ বিষয়ে কোনো দাবিও করেনি, কোনো আন্দোলনও করেনি। শাহ বানু মামলায় সুপ্রিম কোর্টের ফায়সালার পর পার্লামেন্ট দ্বারা মুসলিম তালাকপ্রাপ্তা আইন গঠনের পরই এ বিষয়টিকে দাঁড় করানো হয়। এটা একপ্রকার মুসলমানদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিশোধ গ্রহণের ষড়যন্ত্র ছিল। বিস্ময়কর কথা হচ্ছে, মোহন ভাগবত এ বিষয়টিকে জাতীয় স্বার্থের সাথে জুড়ে দিয়ে নেপথ্যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিবিদদের হাতে রাখছেন। এ কথা সবাই জানে, এ বিষয়ে সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতির সবচেয়ে বড় অপরাধী স্বয়ং সঙ্ঘ পরিবারের লোকজন, যারা পদে পদে জাতীয় স্বার্থকে হত্যা করেছে এবং দেশের ঐক্য ও সম্প্রীতি নষ্ট করেছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে মোহন ভাগবতের বক্তব্যের এ মর্ম বের করা হয়েছে, তিনি দুর্নীতি, ঊর্ধ্বমূল্য ও লুটপাটের অভিযোগে বেষ্টিত মোদি সরকারকে বাঁচানোর জন্য অযোধ্যা বিবাদকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে চাচ্ছেন।
কেননা বিগত সাড়ে চার বছরের সময়ের মধ্যে মোদি সরকার জনগণের শান্তির জন্য একটি কাজও করেনি। এভাবেই রামমন্দিরের স্পর্শকাতর বিষয়কে উসকে দিয়ে আরো একবার জনগণকে বেকুফ বানানো হতে পারে এবং তাদের দৃষ্টিকে আসল সমস্যা থেকে সরিয়ে দেয়া যেতে পারে। স্বয়ং মোহন ভাগবত গত পাঁচ বছরের সময়ের মধ্যে তার বিজয়া দশমীর ভাষণে কখনো রামমন্দিরের কথা উল্লেখ করেননি। আরএসএসের ওয়েবসাইটে ভাগবতের ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের বক্তৃতাগুলো বিদ্যমান রয়েছে। ওই বক্তৃতাগুলোতে মোহন ভাগবত একবারও রামমন্দিরের কথা উল্লেখ করেননি। আর এখন এক মাসের মধ্যে তিনবার রামমন্দিরের নাম জপলেন। চারটি প্রাদেশিক অ্যাসেম্বলির নির্বাচন মাথার ওপর। আর সাধারণ নির্বাচন আসব আসব করছে। এমন মুহূর্তে মোহন ভাগবতের রামমন্দিরের জপন পুরোটাই রাজনীতি। এখন প্রয়োজন দেশের ভোলাভালা জনগণের সঙ্ঘ পরিবারে কূটচাল অতি দ্রুত ধরে ফেলা এবং মোহন ভাগবতের ইশারায় পরিচালিত হওয়া মোদি সরকারের কাছে বিগত সাড়ে চার বছরের ব্যর্থতার হিসাব তলব করা।
মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক উর্দু টাইমস
২১ অক্টোবর, ২০১৮ থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
* লেখক : ভারতের বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 


আরো সংবাদ



premium cement
তেহরানের প্রধান বিমানবন্দরে পুনরায় ফ্লাইট চালু হামলায় কোনো ক্ষতি হয়নি : ইরানি কমান্ডার ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ‘কেন্দ্র’ ইস্ফাহান : সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা মিয়ানমারের বিজিপির আরো ১৩ সদস্য বাংলাদেশে রুমায় অপহৃত সোনালী ব্যাংকের সেই ম্যানেজারকে চট্টগ্রামে বদলি দুবাইয়ে বন্যা অব্য়াহত, বিমানবন্দর আংশিক খোলা ভারতে লোকসভা নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শুরু শুক্রবার সকালে ঢাকার বাতাস ‘সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর’ শুক্রবার সকালে ঢাকার বাতাস ‘সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর’ ১৪ বছরেও হত্যাকাণ্ডের বিচার পায়নি এসআই গৌতম রায়ের পবিবার মিলান-লিভারপুলের বিদায়, সেমিফাইনালে আটলন্টা-রোমা

সকল